রটে যাচ্ছে আঁধার : কুমার দীপ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন এই আঁধারের কালে ~ অর্বাক আদিত্য
কবিতা অনেক রকম। কবিতাকে বুঝতেও হয় অনেকভাবে। কখনো রূপ, কখনো চাল-চলন, কখনো গড়ন-গুণ, কখনো বলার ধরন। কবিতা, তাকে যেভাবে দেখাতে চায়, সেভাবেই দেখতে হয়। কবিতা যদি চায় তার প্রত্যেকটা অঙ্গ খুলে খুলে দেখাতে, তাহলে তাকে খুলে খুলেই দেখতে হবে। যদি চায় কবিতা তার বেণিবাধা চুল দেখাবে, যদি চায় খোপাবাধা চুল দেখাবে, যদি চায় হাওয়ায় দোলানো খোলাচুল দেখাবে, মোটকথা যেভাবে দেখাতে চাইবে সেভাবেই দেখতে হবে। জটবাধা চুলও দেখাতে পারে কবিতা। কবিতার পূর্ণ অধিকার আছে নিজেকে অনেকরকম করে দেখাবার। তার মতো করে দেখলে স্বাদ পাওয়া যাবে, তৃপ্তি মিলবে। কবিতাকে দেখতে হয় কবিতার দৃষ্টি দিয়ে। কবিতার লবন ঠিকঠাক আছে কিনা, ঝাল, মসল্লা, এলাচ, ডালচিনি ঠিকঠাক আছে কিনা এসবের বিচার করতে গেলে কবিতা ভক্ষণের অনুপোযোগি হয়ে উঠবে। সে যার কবিতাই হোক না কেন। আবার ঠিকঠাক থাকলেও সেটি হয়ে ওঠে মহাবিরক্তিকর। অরুচিকর। হয়তো পেসক্রিপশানে স্বাস্থ্যকর কিন্তু সেই কবিতা স্বাস্থ্যের জন্য সত্যি সত্যি হানিকর। তত্ত্ব-থিওরি, কাঠামো-ফর্ম, শিল্পরূপ এসব প্রাতিষ্ঠানিক, একাডেমিক। কবিতাকে এসবের ভেতর জড়িয়ে না নিয়ে আপন করে পাঠ করতে হয় গভীর অবসরে। তবেই কবিতা তার প্রকৃতরূপ নিয়ে হাজির হবে। যেরূপ মোহিত হওয়ার মতো, মুগ্ধ হওয়ার মতো। যখন কোন লেখাকে একজনও কবিতা বলবে তখন সেই লেখাকে অবশ্যই হুর, পরি, অপ্সরার থেকেও সুন্দর হতেই হবে। যদি সেটি না ঘটে তবে যিনি সেই লেখাকে কবিতা বলছেন হয় তিনি শিশু নয়তো বুদ্ধিপ্রতিব›িদ্ধ। পাগোল। উন্মাদ। বুঝতে হবে তার মৌলিক মূর্খতা আছে।কিন্তু তারপরও কিছুটা তো মাপকাঠি আছে। এ্যজ এ পাঠক হিসেবে পাঠ্যদৃষ্টির স্বপক্ষে যুক্তি/মত আছে। সেটিই সেই পঠিত কবিতার মাপকাঠি। শব্দের, চিত্রের, চিত্রায়নের মাত্রা বিচারের, দৈর্ঘ্যপ্রস্ত নির্ণয়ের ফিতে। যে ফিতের নির্দিষ্ট কোন গণনা সংখ্যা।
‘রটে যাচ্ছে আঁধার’ কুমার দীপের কবিতার বই। ২০১৭’র বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে বেহুলাবাঙলা প্রকাশন সংস্থা থেকে। পরিপাটি, ঝকঝকে সুসজ্জিত এবং উজ্জ্বল্যমান। সেই উজ্জ্বলতা ধরে রেখেছে ‘রটে যাচ্ছে আঁধার’ তার প্রতিটি পৃষ্ঠায়। কোন কোন পৃষ্ঠা থেকে কবির অন্তর্নিহিত রক্তের প্রবাহ অনবরত ধাবিত হয়েছে পাঠক বরাবর কিন্তু সেই রক্তেরও উজ্জ্বলতা রয়েছে। আবার কোন কোন পৃষ্ঠা থেকে বিষাদ, হতাশা, কষ্ট, ক্লেদ তুমুল বেগে ধেয়ে এসেছে বর্ণিল বিবিধ গতিতে পাঠকের দিকে। সময়, সভ্যতা এমন একদিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে যেখানে অবিশ্বাসের অবিনীত দানা আমাদের জীবনকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করছে, আগামীকে নিয়ে। কুমার দীপও একই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন কবিতায়__ শীতলক্ষ্যার গর্ভে জড়ো হওয়া বর্জ্যরাশির ন্যায় হৃদয়ে জমছে/অবিশ্বাসের শিলা-প্রতিশীলা,/তিতাস কিংবা কপোতাক্ষের প্রকরণে/মিলিয়ে যেতেছে দ্যাখো মানুষের অনুসূয় মন/কীভাবে গড়বে তবে অনাগত সোনালি জীবন? (মায়ামৃগ)
এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই। আমাদের যাপন, অবস্থান, রীতিনীতি, হালচাল, ব্যবস্থা আমাদেরকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে কি? পারবে না। বরং আমাদের হতাশ করবে। আমাদের অগোছালো অতলে নিজ্জিত করে দেয়। আমরা যেমন শুধু প্রত্যাশা, আকাক্সক্ষা করে করে কাটিয়ে দিই জীবন। কিন্তু মনে মনে জানি এ যাপন মিথ্যা। এ যাপন সত্য নয়। শ্বাশত নয়। কবি যেহেতু আমাদের বাইরের কেউ নন। আমাদের ভেতরে থেকেই তিনি আলাদা, তাই তার বলার ঢঙটা হয়তো আলাদা, যেকারণে আমরা তাঁকে পড়ি, গভীর মনোযোগ দিয়ে। কবির প্রকাশ তাই শব্দের সম্মোহনে__ সূচাগ্র সামর্থ্য হাতে নিয়ে/যতবার গেঁথে চলি অক্ষরের মালা/ততবার জেনে যাই; সত্য হলো- এই;/তোমাকে পেলো না যে,/প্রাপ্তি বলে কিছু তার নেই। (অক্ষরের টানে)
কবির প্রকাশ আরো তীব্র হয়, তীক্ষè হয় যখন দেখেন ক্ষুধা-দারিদ্য দূরীকরণের অঙ্গিকার পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে, যখন দেখেন বৈশম্যের বিলবোর্ডে ছেঁয়ে গেছে গ্রাম, শহর, আধা-শহর। কানায় কানায়। যখন দেখেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিপক্ষ শক্তি তরতর করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এদিক সেদিক। কবির কণ্ঠস্বর তখন নির্দিধায় সেই সত্য উচ্চারণ করেন। চোখের পর্দা খুলে দেখান সেই দৃশ্য__ কুকুর প্রস্রাব করে, সেও সহ্য হয়/সংখ্যালঘুর উচিতবচন কখনই নয়! (ট্রেনে যেতে যেতে)
এইসব দৃশ্য আজকাল অহরহ। এতই সাধারণ যে কেউ গাঁ করে না। হয় এড়িয়ে যান নয়ত এটাকেই সমাজসিদ্ধ হিসেবে মেনে নেন। কবির কাছে তাই দৃশ্যের উল্টো চিত্রই হয়ে ওঠে সৌন্দর্যসন্ধানের উৎস। কবি সৌন্দর্যের উৎসকে তাই অন্যভাবে ভাবিয়ে তোলেন আমাদের কাছে। আমাদের গদবাধা চিন্তাকে পাল্টে দিয়ে কবি একটু অন্যভাবে ভাবতে শেখান। কবি সৌন্দর্যকে এমন এক ছাচে ফেলে নির্মাণ করেন যেখানে একই সাথে আছে চিন্তা ও নন্দন। কবিতার সাক্ষ্য নেওয়া যাক এক্ষেত্রে__ নদীর তীরে পথ; পথের পাশে গাছ/গাছের নিচেই তরুণ মাথার সারি।/ওরা কেবল জানে, নদীর মধ্যে মাছ,/জানে না, মাছে চড়ে নদীই দিচ্ছে পাড়ি !/(ওদের হৃদয়ে কোনো শরৎ-হেমন্ত নেই)
স্মৃতি শৈশব যৌবনের জমানো গল্পগুলো আমাদের বাঁচতে শেখায়। জীবনের গান গাইতে শেখায়। একট নষ্ট ব্যবস্থার ভেতরে যখন ঢুকে যাই তখন আমরা স্বস্তি খুঁজি আমাদের সেই সংরক্ষণ করা স্মৃতির কাছ থেকে। আমাদের গল্পগুলো তখন হয এ্যটার্কটিভ, চোখ ধাঁধানো। অপলক। আমরা বর্তমানকে তখন তুচ্ছ করে তুলি অতীতের কাছে। অতীত হয়ে ওঠে মহিমান্বিত। কবিও তার অতীতকে রূপ দিয়ে অপার প্রাণের আধারে। কবির চেতন তখন বারংবার ঘোষণা করেন__ এই ঘাসে ফড়িং ছিলো, শালিক ছিলো-/ ঢের,/ এই ঘাসে হাসি ছিলো; কথা-/জীবনের। (ঘাসের ইতিহাস)
কিংবা- ভোরের জানালা গলিয়ে সবুজের দিকে চাই : সে ডাক দ্যায়/বাড়ির ছাদে বসে আকাশের নীলে চোখ রাখি : সে ডাক দ্যায়/সূর্যধোয়া বিকেলে নদীর অপারে ডুবে থাকি : সে ডাক দ্যায়/বিস্ময়ে চেয়ে থাকি রাতে, রাতের নক্ষত্ররাজ্যে : সে ডাক দ্যায়। (শুনি তার ডাক)
স্মৃতি এমনই ভয়ংকরভাবে ডাকে। অথবা ডুবিয়ে রাখে ঘোরের জগতে। স্মৃতির তেজ এমনই। তাইতো কবি ইঙ্গিতে, ইশারায় আমাদের ভঙ্কুর ব্যবস্থাকে সাবধান করে দিয়ে মনে করিয়ে দেন অনিবার্য ধ্বংশের কথা। যে কথা লিখে গেছেন মুনি বাল্মীকি, মহাজ্ঞানী বেদব্যাস। কবি কুমার দীপ আমাদের মনোযোগ নিয়ে যান সেই ইতিহাসের পাঠে- রাষ্ট্র যদি ধৃতরাষ্ট্র হয়/দুঃশাসন পূর্ণ জ্যোতির্ময়।/কৃষ্ণ কিংবা শকুনি লাগে না/জ্ঞাতিদের কর্মে ঘটে ভারত-প্রলয়। (রাষ্ট্র যদি ধৃতরাষ্ট্র হয়)
সত্তরের কবি রুদ্র যেমন যুদ্ধের কবিতায় বলেছেন আমি ঘুমাতে পারি না। কুমার দীপ হয়তো সেভাবে বলেন নি। তবে তিনিও এমন এক ব্যথা, বিরহ, বেদনা, বিচ্ছেদ ধারণ করে আছেন যেটি অঘুমের থেকেও ক্ষতিকর, আতঙ্কের। যেটি তাঁর সত্তাকে স্তব্ধ, রুদ্ধ করে দিয়েছে। বৃষ্টি নামতেই কবিতায় কবির সেই বেদনা মূর্ত হয়েছে প্রখরভাবে- অসহায় গাছের ধরনে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি/বুকের কার্নিশ বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল/ভেতরেও শীতল জলের ধারা; বিমূঢ় সুনামি। (বৃষ্টি নামতেই)
ক্ষমতা-দাপট, অর্থ-বিত্ত মানুষের মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দিয়েছে। অর্থ-ক্ষমতার টগবগে ঘোড়া ছুটতে ছুটতে চুরমার করে দিচ্ছে মানুষের নৈতিকতা, বিনষ্ট করছে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে। কবি এইঅর্থ-ক্ষমতার তাণ্ডবকে কালবৈশাখীর ঝড়ের সাথে তুলনায় এনেছেন। ‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়’ যখন পতনের সিন্ট্রম আমাদের চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে তখন এই আসন্ন/সংঘঠিত পতন থেকে কিছুই রেহাই পাবে না। ভালো-মন্দ সমস্তকিছুকেই গ্রাস করে নেবে। কুমার দীপের ভাষ্য- বৃষ্টির মতোই; অর্থ বা ক্ষমতারও/নিজস্ব কোনো বিবেক নেই; যার হাতে/যখন উপনিত হয়, তখন সে-ই/হয়ে ওঠে বিধাতা; তার বিবেকেরই/বন্দী শিবিরে রুদ্ধ থাকে জ্ঞান, আনন্দ;/তার আলো-অন্ধকারে ব্যবহৃত হয়;/য্যামন কালবোশেখী; দুই-ই ভাঙে/উপাসনাঘর কিংবা পতিতালয়... (বৃষ্টি ও বিবেকসংক্রান্ত অধিবিদ্যা)
কিংবা, ক্ষমতার অনলে পুড়ে যাওয়া, ক্ষত হওয়া সেইসব সৌন্দর্যের প্রতি কবির গভীর আবেগ। যা কবিকে মোহিত করে রাখতো- ক্ষমতালোভির বিবেকবোধে দ্রুত খোয়া যাচ্ছে/কমলারঙের সকাল,/মাছরাঙা দুপুর,/কুসুমডোবা সন্ধ্যা,/জোনাকরাতের নূপুর। (অপসৃয়মান)
বিপন্ন বিস্ময়ের যাপন আমাদের প্রতিনিয়ত শুধু নেতিবাচক ভাবাতে অভ্যস্ত করছে। আমরা আর কোন নিষ্পাপ উপলব্ধিকে একান্ত আপনার করে নিতে পারি না। চাইলেও পারি না। আসলে পারা যায় না। মানুষের বিরুদ্ধে যেন অন্যকোন প্রাণী/জন্তুর ব্যবস্থার মধ্যে আমরা আটকা পড়ে গেছি। ভাবছি আলোর দিকে যাচ্ছি কিন্তু না, চারিদেকে শুধু আঁধার। শুধু মূর্খতা, শুধু অব্যবস্থা। শুধু হীনতা, দীনতা, নিচতা। না আমরা পারছি রেহাই পেতে না আমরা পারছি এই আলেয়ার যাদুখেলা থেকে মুক্ত হতে। আমাদের এই ব্যর্থতাকে কবি কটাক্ষ করেছেন। কবির বক্তব্যে- হে অন্ধতা!/আমরা ভাবছি আলোর দিকেই যাচ্ছি/অথচ চারদিকে রটে যাচ্ছে আঁধার;/আঁধারে তোমার মানুষবিরুদ্ধ নাম!/ (রটে যাচ্ছে আঁধার)
আঁধারের কাল চলছে। আর কুমার দীপ আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।
1 Comments
অর্বাক আদিত্যকে ধন্যবাদ ও ভালোবাসা।
ReplyDelete