বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে মনে প্রশ্ন জাগে তাঁর মৃত্যুচিন্তা কেমন ছিল। ছোটবেলা থেকেই উপনিষদের আলোয় আলোকিত রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে কখনো ভেবেছেন সখা, পরম আত্মীয়, আত্মার আত্মীয়। আবার কখনো বলেছেন নিচ, নিষ্ঠুর। আবার কখনো মৃত্যুর স্বরূপ নিয়ে ছিল দ্বন্দ্ব। সব মিলিয়ে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। বারবার নিকট জনের মৃত্যু তাঁকে বিধ্বস্ত করেছে। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে মা’কে হারান। তারপর যুবক বয়সে একমাত্র বন্ধু বৌদি কাদম্বরীকে হারান। তারপর স্ত্রী, দুই কন্যা, এক পুত্র, জামাতা, ও পিতাকে হারান। একের পর এক মৃত্যুর আঘাত সইতে হয়েছিল তাঁকে। এই মৃত্যুগুলোর মধ্যে দিয়েই অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হন তিনি। আজ চেষ্টা করব মৃত্যু চিন্তার ওপর তাঁর বিভিন্ন লেখার একটা রূপরেখা তৈরি করার।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উপনিষদের ঋষি প্রতিম। উপনিষদের শিক্ষায় শিক্ষিত তিনি মনে করতেন জীবের মৃত্যু হয় না, জন্মের মধ্যে দিয়ে পরবর্তী জন্মে জীবন শুধু প্রবাহিত হয়। যখন বিশ্বপ্রকৃতিকে ছেড়ে শুধুমাত্র নিজের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয় তখন মৃত্যু বড়ই দুঃখদায়ক, কিন্তু নিজেকে ছেড়ে বিশ্ব প্রকৃতির নিরিখে দেখলে দেখা যায় মৃত্যু বলে কিছু নেই, রয়েছে শুধুই জীবনপ্রবাহ। ভানুসিংহের পদাবলীতে মৃত্যুকে তিনি কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়া বন্ধু ভেবেছেন -
তুঁহু মম মাধব, তুঁহু মম দোসর,
তুঁহু মম তাপ ঘুচাও।
মরণ তু আও রে আও।
১৯০০ সালে কলকাতা থেকে মৃণালিনীকে লিখেছিলেন, ‘‘বেঁচে থাকতে গেলেই মৃত্যু কতবার আমাদের দ্বারে এসে কত জায়গায় আঘাত করবে মৃত্যুর চেয়ে নিশ্চিত ঘটনা তো নেই শোকের বিপদের মুখে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ বন্ধু জেনে যদি নির্ভর করতে না শিখো তাহলে তোমার শোকের অন্ত নেই।’’ ‘বেদান্তের কথা আবার দেখি নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থে ‘মৃত্যু’ কবিতায় -
মৃত্যু অজ্ঞাত মোর
আজি তার তরে
ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে
এত ভালোবাসি
বলে হয়েছে প্রত্যয়
মৃত্যুরে আমি ভালো
বাসিব নিশ্চয়।
মৃত্যুকে শাশ্বত সত্য জেনে কখনো তাকে মহান্ত পুরুষ, কখনো পরম পুরুষ , কখনো জ্যোতির্ময় বলেছেন। মৃত্যুকে ভয় পাওয়া নয়, তাকে আপন করে গ্রহণের মধ্যেই একমাত্র আছে উদ্ধারের পথ। উপনিষদের কথা আবার নৈবেদ্যতে উঠে এসেছে -
শোনো বিশ্বজন, শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী। আমি জেনেছি তাঁহারে মহান্ত পুরুষ যিনি
আঁধারের পারে জ্যোতির্ময়
তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পার, অন্য পথ নাহি।
নৈবেদ্যতে মঙ্গলময়ের সাথে সম্পূর্ণ লীন হয়ে তাঁর নিবেদন দেখি -
সর্ব কর্মে তব শক্তি এই জেনে সার
করিব সকল কর্মে তোমারে প্রচার।
বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে মৃত্যুর কোন কল্পনা নেই। জীবন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় প্রবাহ মাত্র। তাঁর মৃত্যু চিন্তা নান্দনিক ভাবে প্লাবিত হয়। তিনি বলেন-
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই--
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই ॥
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ,
তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ আপনার পানে চাই॥
মৃত্যুকে জীবনে, মরনে বন্ধু রূপে দেখছেন কবি -
জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে ॥
১৯০২ সালে স্ত্রী, মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর মৃত্যুকে অতিথি রূপে দেখেন যেখানে অতিথির জন্য রয়েছে অপেক্ষা। ‘স্মরণ’ কাব্যগ্রন্থে লেখেন -
যে জন আজিকে ছেড়ে চলে গেল খুলি দ্বার
সেই বলে গেল ডাকি,
মোছো আঁখিজল, আরেক অতিথি আসিবার
এখনো রয়েছে বাকি ৷
মৃত্যু আলাদা কিছু নয়, অসীম জীবন প্রবাহের অংশ মাত্র। অসম্ভব প্রতিভাবান কবির মৃত্যু চিন্তা নান্দনিকতায় ভরে ওঠে। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পরম পুরুষের কাছে যাবার আনন্দ দেখতে পাই। এসময় লেখেন -
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
জোড়াসাঁকোয়, রবীন্দ্রনাথের বন্ধু রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মাঝেমধ্যেই খোঁজ নিয়ে যান রেণুকার। তেমনই একদিন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লম্বা আলাপের শেষে রামেন্দ্রসুন্দর জানতে চাইলেন, রেণুকার শরীর কেমন আছে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘আজ সকালে সে মারা গিয়েছে।’’ রবীন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলেন রামেন্দ্রসুন্দর। তার পর নিঃশব্দে নেমে এলেন সিড়ি বেয়ে। ‘খেয়া’ কাব্যে দেখি একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যুর আঘাতে প্রাজ্ঞ এক কবিকে। মৃত্যু হয়ে ওঠে প্রাণের রাজা। সেই রাজাকে অত্যন্ত আন্তরিকতায়, গাঢ় হৃদ্যতায় স্বাগত জানাবার কথা বলেন -
ওরে, দুয়ার খুলে দে রে,
বাজা, শঙ্খ বাজা!
গভীর রাতে এসেছে আজ
আঁধার ঘরের রাজা।
লিখেছিলেন, ‘‘যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্ত্বার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও পিছনে না টানে।’’
অনেকবার অবসাদগ্রস্থ হয়েছেন ও অনেকবার তাঁর থেকে মুক্ত হয়েছেন। ১৯১৪ সালে রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ইউনানি ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে তাঁর শারীরিক সমস্যা দূর হলেও কিছু মানসিক উপসর্গ দেখা দিয়েছে। রথীকে লিখলেন, ‘‘দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করেছে, মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবেনা। আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ...।’’ এরপর ১৯১৫ সালে বন্ধু অ্যান্ড্রুজকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন প্রায় একই কথা: "ও ভববষ ঃযধঃ ও ধস ড়হ ঃযব নৎরহশ ড়ভ ধ নৎবধশফড়হি". গীতিমাল্যের কবিতায় প্রশ্ন তুলেছেন সৃষ্টির শুরুর কথা -
‘ওগো পথিক, দিনের শেষে
যাত্রা তোমার কোন্ সে দেশে,
এ পথ গেছে কোন খানে?’
গীতিমাল্যে বড় স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করলেন মৃত্যু চিন্তাকে। যেন স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করা এই মর্তের কাজ শেষে জ্যোতির্ময়ের ডাকে তাঁর স্নেহের কোলে -
প্রভাত হয়ে এসেছে রাতি,
নিবিয়া গেল কোণের বাতি,
পড়েছে ডাক চলেছি আমি তাই ,
সবারে আমি প্রণাম করে যাই।
রেণুকার মতোই যক্ষ্মায় শয্যাশায়ী হলেন মাধুরীলতা। রথীন্দ্রনাথ তাঁর দিনলিপিতে লিখেছিলেন, দিদিকে দেখতে যাওয়ার আগে সে দিন বাড়ির ডাক্তারকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন মৃত্যুভয় তাঁর আর নেই, তিনি তৈরি আছেন। এরপর মৃণালিনীকে স্মরণ করে ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থে কৃতজ্ঞ কবিতায় কবি ঢেলে দিলেন প্রাণের অনুভূতি -
তোমার আঁখির আলো. তোমার পরশ নাহি আর,
কিন্তু কী পরশমণি রেখে গেছ অন্তরে আমার— ...।
সঙ্গীহীন এ জীবন শূন্যঘরে হয়েছে শ্রীহীন,
সব মানি সবচেয়ে মানি, তুমি ছিলে একদিন।
একবার কঠিন রোগ থেকে মুক্তি লাভের পর একটা চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘মৃত্যুর ভিতর দিয়ে ফিরে আসা সকলের ভাগ্যে ঘটে না। যদি ঘটে, তবে অন্তত তখনকার মত অহমিকা শিথিল হয়ে আসে কতখানি স্থায়ী হয় বলতে পারিনে।’
মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে মিশে যাওয়া অনন্ত শান্তির কোলে -
অসীম নিস্তব্ধ দেশে
চিররাত্রি পেয়েছে সে
অনন্ত সান্ত্বনা।
মৃত্যুঞ্জয় কবিতায় অসম সাহসী হয়ে উঠেছেন কবি। এখানে তিনি মৃত্যুর কাছে হারতে অস্বীকার করছেন -
‘এইমাত্র? আর-কিছু নয়? ভেঙে গেলো ভয়
যখন উদ্যত ছিল তোমার অশনি
তোমারে আমার চেয়ে বড় বলে নিয়েছিনু গণি
‘আমি মৃত্যু চেয়ে বড়’ এই শেষ কথা ব’লে
যাব আমি চলে।’
‘পত্রপুট’ কাব্যের ‘পৃথিবী’ কবিতায় কবি শাশ্বত সত্যকে অন্তর থেকে মেনে নিয়েছেন এবং সম্পূর্ণ নিবেদন করছেন -
আজ আমার প্রণতি গ্রহন করো, পৃথিবী,
শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে।।
ছিয়াত্তর বছরে বড় অসুখে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। সে সময় হেমন্তবালা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘‘কিছুকালের জন্য মৃত্যুদণ্ড এসে আমার ছুটির পাওনা পাকা করে গিয়েছে।’ ‘সানাই’-এর ‘ক্ষণিক' কবিতায় লিখেছেন-
‘এ চিকন তব লাবণ্য যবে দেখি
মনে মনে ভাবি একি
ক্ষণিকের পরে অসীমের বরদান
আড়ালে আবার ফিরে নেয় তারে
দিন হলে অবসান।’
১৯৩৯-এ কুমার জয়ন্তনাথ রায়কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘শান্তিপূর্ণ মৃত্যুকে বিন্দুমাত্র ভয় করিনি। ভয় করি অপঘাত মৃত্যুকে। যদি মৃত্যুর পূর্বে হাসি মুখে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি, তবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা করবো না।’’ ‘রোগশয্যা’ কাব্যগ্রন্থে মৃত্যুকে অস্বীকার করেন জীবনের প্রতিটি পলের ভালোবাসা দিয়ে - তিনি ভালোবাসার কাছে দাঁড়িয়ে লিখেছেন-
‘এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি।
এ ভালবাসাই সত্য এ জন্মের দান।
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।’
১৯৪১ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁর লেখা কবিতায় কবি যেন আবার হারিয়ে গেলেন জটিলতার ধন্দে, দার্শনিক সংশয়ী চিন্তায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলেন -
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে--
কে তুমি,
মেলে নি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগর তীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়--
কে তুমি,
পেল না উত্তর।
১৯৪১ সালে অস্ত্রোপচারের পর সন্ধ্যার সময় তাঁর মুখে মুখে রচিত শেষ কবিতা -
যতবার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস
ততোবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।
এই হারজিত খেলা, জীবনের মিথ্যা এ কুহক
শিশুকাল হতে বিজড়িত পদে পদে এই বিভীষিকা,
দুঃখের পরিহাসে ভরা।
ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি -
মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে।
......................................................................................................................................................
শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
0 Comments