খৈয়াম কাদের এর প্রবন্ধ

 

                 


নজরুল কাব্যের আবেদন সাময়িক নাকি শাশ্বত সে বিষয়ে কবি স্বয়ং তাঁর কবিত্বের স্বাক্ষস্মারক ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন এই ভাবে- 

 

“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল

আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না 

 অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ

ভীম রণভূমে রণিবেনা

বিদ্রাহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।” 


উদ্ধৃত পংক্তি নিচয়ে অন্বিত ভাব ও সংবিত্তির গুঢ়স্তরে অবগাহন করলে অতি সহজেই অনুধাবন করা যায় নজরুল বোধিতে ধৃত জীবন পাঠের প্রকৃত অভিজ্ঞান এবং তাঁর কাব্য শিল্পের শাব্দি ও আর্থি ব্যঞ্জনা। কারণ এই চিত্রাভিধাগুলির মাঝে স্পষ্টরূপে উৎকলিত হয়েছে তাঁর জীবনসন্বিষ্ট উপলব্ধির সদর্থক উৎসারণ। যদি প্রশ্ন করা হয়_ উপমহাদেশীয় জীবন বলয়সহ সমগ্র বিশ্বসমাজের সকল মানবীয় অঙ্গন থেকে উৎপীড়ন ও অত্যাচার উৎপাটিত হয়েছে কি? বাহ্যদৃষ্টে ঔপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটলেও মনুষ্য বিশ্বের অন্তরবয়ন থেকে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য-চর্চা এবং তদসন্বিষ্ট শোষন, প্রেষণ ও জুলুম নির্যাতনের অপসৃয়ন ঘটেছে কি? দুনিয়া জোড়া ধনী নির্ধনের দুস্তর দূরত্ব প্রশমিত হয়েছে কি? নারী, শিশু ও দুর্বলের প্রতি সহিংসতা এবং নিষ্ঠুরতা নিঃশেষ হয়েছে কি? ধর্মে ধর্মে, গোত্রে গোত্রে, জাতিতে জাতিতে এবং দেশে দেশে বিরাজিত বিদ্বেষের বিলুপ্তি সম্ভব হয়েছে কি? শক্তি ও ক্ষমতার অসিধারী মানুষদের অহংকার ও পাশবিকতার পরিমপাপ্তি ঘটেছে কি? জীবনের জন্য কাম্য মানুষে মানুষে সহৃদয় সদ্ভাব এবং মানবিক চেতনার উজ্জীবন পরিদৃশ্য হয়েছে কি? এসকল প্রশ্নের নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ জবাবে বলতেই হয় না, এসবের কোনটিই হয় নি। তাহলে তো মানতেই হয় নজরুল কাব্যের আবেদন এবং প্রাসঙ্গিতাও ফুরোয়নি এবং ফুরোতে পারেনা। এইসব মূর্ত দৃশ্যাবলী চাক্ষুষ করেও যে সকল বোদ্ধা, প্রাজ্ঞ ও বিদ্যজ্জন গবেষক-সমালোচক নজরুলের কাব্য প্রয়াসকে কেবলি স্থানিক ও সাময়িক বলে অভিহিত করতে চান বা করেন তাঁরা হয়তো নজরুল কাব্যের মৌল মননস্তরে পৌছাতে ব্যর্থ হয়েছেন; নয়তো নিছক ঈর্ষাজনিত হীনমন্যতার বশবর্তী হয়ে এমন হতাশা ব্যঞ্জক এবং নেতিবাচক উক্তি করেন এবং ক'রে থাকেন। এরূপ নীচু মানসিকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সেকালের ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার প্রখ্যাত প্রবন্ধকার মুন্সী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ এবং ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার স্বনামধন্য সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। এঁদের প্রথম জন নজরুল সাহিত্যের অন্তরগুঢ় মর্মদর্শন অনুধাবনে অক্ষম ছিলেন; আর দ্বিতীয় জন দগ্ধ হয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক হীনতাজনিত প্রতিহিংসার ক্লীন্ন দহনে। নজরুলের কাব্য প্রতীভার স্ফুলিঙ্গ প্রত্যক্ষণে খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন নজরুলকে সম্বোধন ক'রে ব’লে বসলেন- “বাংলা সাহিত্য তোমাকে চায়”, তখন রবীন্দ্র ভক্ত সজনী দাস “শনিবারের চিঠির” ১৩৩৪ সালের ভাদ্র সংখ্যায় তাঁর নজরুল বিদ্বেষের চরমতম পরাকাষ্ঠারূপে ব'লে উঠলেন- “রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের জীবিতাবস্থাতেই যদি নজরুল ইসলাম সাহিত্য যুগাবতার বলিয়া ঘোষিত হন তাহা হইলে সমাপ্তি হউক সাহিত্যের।” এ প্রসঙ্গে না বললেই নয় যে, সজনী বাবুসহ অপরাপর হিন্দু-মুসলিম নজরুল বিদ্বেষীরা একটি সরল সত্যকে উপলব্ধি করতে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছিলেন; আর তা হলো বাংলা সাহিত্যের পুরো পরিসর জুড়ে রবীন্দ্র ভাবাবহের নাগপাশ ছিন্ন করার যে প্রবল প্রত্যয় সৃষ্টি হয়েছিল নজরুলের দ্রোহী কাব্যাভিঘাতই ছিল তার সফল ও সার্থক উদ্ভাষণ। নজরুল কাব্যের এই স্বকীয় স্বর সম্পর্কে বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক আবু সায়ীদ আইয়ুব বলেছেন____ "Twenty years ago Bengali poets were completely dominated by Rabindranath Tagore. They were thinking in his thoughts, writing his language, using his rhythms. About this time came Nayrul Islam, the most instinctive of the Bengali poets, and stirred up a new and virile individualism." অথচ নিজেদেরকে অতিশয় বিদগ্ধ এবং প্রাজ্ঞজন মনে করেন এমন কতিপয় তথাকথিত সাহিত্য বোদ্ধা এবং সাহিত্যিক এখনো নজরুলের প্রতি নাক সিটকানোর প্রবনতা পোষন করেন যা শুধু অকাম্যই নয় রাতিমতো অশালীন এবং নিন্দনীয়ও বটে। তাঁদের ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় বাংলা সাহিত্যে নজরুল এক অনন্য সাধারণ কিংবদন্তী দ্রষ্টা ও স্রষ্টা পুরুষ। সাহিত্যের জীবন-বাস্তবিক আখ্যান পটে তিনি অদ্বিতীয়, অতুল্য। তিনি ক্ষণজন্মা, তিনি মহান। তাঁর বোধি ও মননে দেদীপ্য যে মানবিক চেতনার ক্ষরণ, তাঁর চিত্তে জাগ্রত যে মরমী ও দরদী সংবেদন তা বহুমাত্রিক এবং বহুত্বে বিস্তৃত কিন্তু তা বহুজনে দৃষ্ট ও ধৃত নয়। সম্ভবত: একারণেই কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক জনাব কামরুল ইসলাম তাঁর “কবিতার স্বদেশ ও বিশ্ব” গ্রন্থে স্বজ্ঞাস্নাত পঠন মূল্যায়নে বলেছেন “বাংলা সাহিত্যে তাঁর (নজরুলের) স্থান একেবারেই আলাদা। তাঁর কবিতার দ্রোহ মানবিক সংবেদ অন্বিষ্ট। তাঁর ভুবনে, তাঁর সৃজনপ্রতিভার জল-হাওয়ায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষেরই অবিচল বিচরণ। সচল জীবনের দিকে চলমান সেই কাফেলা, সেই যাত্রা নতুনের দিকে। সত্য ও সৌন্দর্যের দিকে।” 

মনে রাখা দরকার নজরুল ঘষেমেজে কবি হয়ে ওঠেননি। তিনি জন্মেই কবি, তিনি রক্তে-মাংসে এবং অস্থি-মজ্জায় কবি। তাঁর কবিস্বত্বা সহজাত এবং শত:স্ফুর্ত, কিন্তু কোনো ভাবেই তা স্বভাব কবিত্ব নয়। তিনি সদর্থেই একজন মৌলিক ও মৃন্ময় কবি। জীবনের কাছে দায়বদ্ধ তাঁর কবি মানস। মজলুম মানবতার মুক্তির এষণাঋদ্ধ চিত্তজাত প্রেমবোধ তাঁর কাব্যশক্তির উৎস, তাঁর দ্রোহী চেতনার সরল অথচ অবিচল প্রণোদন ভূমি। নজরুল কেবলি ভাবের কবি নন; তিনি ভাবনারও কবি। যে কবি বিশ্বসভ্যতার অতি অনিবার্য অনুষঙ্গসমূহ যথা- রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সমরনীতি, ধর্মনীতি, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ সর্বোপরি মানবতাবাদ নিয়ে শতত: চিন্তনস্নাত হন; এবং সেসবের দুষ্টু-শিষ্ট প্রয়োগ ও ভূমিকার দর্শন-ঋদ্ধ আখ্যান-উপাখ্যান উপস্থাপনার প্রয়াস পান; এমনকি সমকালিন কাব্যভূবনের জ্যোতির্ময় বিস্ময় রবীন্দ্র প্রতিভার সর্বব্যাপ্ত ছায়ার মাঝেও সদর্পে নির্মান করেন স্বচিহ্নে সনাক্তযোগ্য আপন জগত, সে কবি নিঃসন্দেহে সুগভীর স্বজ্ঞা, প্রতীতি ও অন্তর্চেতনার এক শক্তিমান উদগাতা এবং নির্মাতা। এতদপ্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেন তাঁর “বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস” গ্রন্থে গবেষণালব্ধ অন্তর্লীন প্রত্যয় থেকে বলেছেন- “এযুগের নেতা গল্প উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপ্যাধ্যায় এবং কবিতায় নজরুল ইসলাম” (চতুর্থ খন্ড: পৃষ্ঠা-২৫২)। এভাবেই কবি হিসেবে তিনি হয়ে ওঠেন চিরঞ্জীবি আর তাঁর সৃষ্টিসম্ভার হয়ে ওঠে কালোত্তীর্ণ এবং শাশ্বত। এ যাবৎ কালের অধিত জীবনবিশ্ব থেকে সতত: উপলব্ধ__ প্রেম-বিরহ, আশা-হতাশা, লাঞ্চনা-বাৎসল্য, বঞ্চনা-বন্দনা, শাসন-শোষন আর অনাচার-অত্যাচার ও প্রীতাচার এবং তৎপ্রতিক্রিয়াজাত বিদ্রোহ, বিপ্লব, প্রতিবাদ ও সদাচার সদ্ভাব_ সবই মানব সভ্যতার অনাদী এবং অনিবার্য উপাদান ও উপকরণ। সুতরাং নজরুল এবং তাঁর কাব্যকর্ম দুই-ই সদাসর্বদা পুন: এবং সর্বকালের সাময়িক। অর্থাৎ তিনি বহমান সময়ের অনি:শেষ দ্রাঘিমা জুড়ে পুন: পুন: সাময়িক যা তিনি তাঁর ‘ধূমকেতু’ কবিতায় নিজেই বলেছেন___ 

“আমি যুগে যুগে আসি, 

আসিয়াছি পুন: বিপ্লব হেতু 

এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু।” 


এ প্রসঙ্গে ২৫-০৫-২০১৫ তারিখের ‘দৈনিক কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় প্রকাশিত “নজরুল চর্চার নব যুগ” নামীয় প্রবন্ধে ড. করুনাময় গোস্বামী বলেছেন “নজরুল সমকালের কবি মাত্র নন। তিনি চিরকালের কবি। চিরকাল সমকালের মধ্যেই নিহিত থাকে। নজরুল সমকালের স্পন্দনের মধ্যেই চিরকালের স্পন্দনটি অনুভব করতে সক্ষম হয়েছিলেন।” নজরুল কাব্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সাময়িকতার অভিযোগের জবাবে স্বয়ং বরীন্দ্রনাথ বলেছেন-” কবি কখনো সমকালকে উপেক্ষা করতে পারে না। আর বর্তমান বলে পৃথক করে নেয়া চলে এমন কোন কালপর্ব নেই (নজরুল চর্চার নব যুগ)।” আর টি, এস, এলিয়টের মতে___ "The great poet, in writing himself, writes his time." সুতরাং নজরুল স্বকালকে ধারণ করেই কালান্তরিক হয়ে উঠেছেন। 


একজন সাহিত্যিক তথা একজন কবির নানামুখী দায় ও প্রত্যয়ের মাঝে অন্যতম হলো তাঁর স্বভাষার বৈচিত্রময় উৎকর্ষ নিশ্চিত করা; সৌকর্যমন্ডিত নান্দনিক উপস্থাপনার মাধ্যমে ভাষাকে শাণিত, শীলিত ও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলা; পুরনো শব্দের নবায়ন, নতুন শব্দের সৃজন ও সংযোজন এবং ভিন ভাষার প্রাসঙ্গিক শব্দসমূহের আত্মীকরণের মাধ্যমে আপন ভাষাকে ঋদ্ধ ও সম্প্রসারিত করা। [স্মর্তব্য স্বভাষার প্রযোজ্য শব্দকে অপসারণ ক’রে তদস্থলে কোন বিভাষিক শব্দকে অযাচিতভাবে প্রতিস্থাপন করার নাম ভাষার সম্প্রসারণ নয়, বরং তা ভাষার বিকৃতি সাধন]। ভাষার এমন শ্রী ও শক্তি বৃদ্ধির ব্যপদেশে কৃত নজরুলের কাব্যকীর্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য ও স্মরণযোগ্য। তিনি তাঁর কবিতার শরীর নির্মানে বাংলার সাথে আরবী, ফারসী এবং হিন্দী, উদুর্ ও ইংরেজি শব্দের এমন প্রাঞ্জ্যল ও প্রাসঙ্গিক সমন্বয় ঘটিয়েছেন যাতে মন্ময়ী ও তন্ময়ী শিল্পের অনবদ্য কারুকার্য সৃষ্টি হয়েছে। ভাবাভিধা এবং চিত্রকল্পসমূহের এমন বোধলগ্ন এবং সুললিত নান্দনিক অন্বয় তিনি সাধন করেছেন যার মর্মাবহে পাঠক চিত্ত অনির্বচনীয় এক “উইলিং সাসপেনশন অব ডিজবিলিভে” সম্মোহিত হয়। অর্থাৎ পাঠক মন এমন কিছু ভাবতেই চায় না যে সেখানে ভিন্ন ভিন্ন ভাষাধিকৃত শব্দনিচয়ের সম্মিলন ঘটেছে। নজরুলের এই অনন্য সমন্বয়ী শিল্পশক্তি সম্পর্কে মুনীর চৌধুরীর অভিমত “নতুন হোক পুরাতন হোক দেশী হোক বিদেশী হোক শব্দের ধ্বনিগত ব্যবহারে তিনি (নজরুল) ছিলেন কুশলী কারিগর।” বৈচিত্রময় ভাষাযৌগের ছান্দিক শব্দশিল্প বিনির্মানে নজরুলের এই সাবলিল পারঙ্গমতা তাঁর অপার মৌলিক কবিত্ব শক্তিরই স্বাক্ষ বহন করে। মিশ্রভাষ্য বাচ্য উদ্ভাবনের পাশাপাশি বঙ্গীয় তথা ভারতবর্ষীয় জীবনাঙ্গনে পরিব্রাজ্য পরস্পর বিরোধী আচার সংস্কার, লোকপূরাণ, উপকথা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মাঝেও তিনি অভূতৃপূর্ব এক প্রতিবেশিতার পরিবেশ মূর্তমান করেছেন। এমনকি তিনি যে শুধুই প্রবল পারঙ্গমতার সাথে বিদেশী শব্দের যথাযথ ভাব-অন্বিত শিল্পময় প্রয়োগ নিশ্চিত করেছেন তা নয়; তিনি অবিমিশ্র হিন্দী ও উর্দু ভাষাতে বেশ কিছু গীত-গজলও রচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি হাফিজ ও ওমর খৈয়ামের কিছু কবিতার অনুবাদ পর্যন্ত করেছেন। আর এসব কেবলি তাঁর কল্প ও স্বপ্নচারী মনের ব্যসনব্যাপৃতি নয়: বরং এ হলো তাঁর স্বোপার্জিত পঠন প্রত্যক্ষণ প্রজ্ঞা আর বহমান জীবনবিশ্ব সংক্রান্ত অন্তর্লীন আত্মবোধের অধিচৈতনিক স্বাজ্ঞ প্রকাশ।


মোহররম, কোরবানী, আনোয়ার, শাত-ইল-আরব, সুবেহ্ উম্মেদ, “কামালপাশা, আমানুল্লাহ্, খেয়াপারের তরণী, নওরোজ, চিরঞ্জীব জগলুল, ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম, ঈদ মোবারক, বিজয়ীনি, পূজারীনি, অভিশাপ, অবেলার ডাক, ঈশ্বর, পাপ, আমার কৈফিয়ত, ডমিনিয়ন স্টেটাস ও বিদ্রোহীসহ” আরো অনেক কবিতায় তাঁরা পরস্পর বিরোধী সাংস্কৃতিক আদর্শের অনুপম শিল্পবৌধিক সমন্বয় প্রচেষ্টা সতত প্রভাস্বর। একটি ঐতিহাসিক অনুষঙ্গের প্রতি দৃকপাত করলে দেখা যায় বৃটিশ শাসনের শেষের দিকে কতিপয় বর্ণাশ্রয়ী বাঙ্গালি পন্ডিত বহু শতাব্দী জুড়ে জীবন প্রবাহে সম্পৃক্ত ও নি:ষিক্ত থাকা অসংখ্য আরবী-ফারসী শব্দকে বিতাড়িত করে বাংলাকে একটি সংস্কৃত নির্ভর ভাষায় পরিনত করার প্রচেষ্টায় ব্রতী হন। এ সময় এঁরা বেমালুম ভুলে যান যে পৃথিবীর অপরাপর ভাষা সমূহের মতো বিশ্ব নিয়ন্ত্রনকারী ইংরেজি ভাষাও গ্রীক, ল্যাটিন ও ফ্রেন্সসহ আরো অনেক ভাষা থেকে শব্দ-অভিধা আহরণের মাধ্যমেই পরিগ্রহ করেছে বর্তমানের সমৃদ্ধিশালীরূপ। বাংলা ভাষাও আরবী, ফারসী, হিন্দী, উর্দু, চীনা, মঙ্গলীয়, পতুর্গীজ ও ইংরেজিসহ বিভিন্ন অঙ্গন থেকে সংগৃহীত ও আত্মীকৃত শব্দসম্ভারে সমৃদ্ধ। তাছাড়া এ অঞ্চলের বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠির জীবনাচারের পাশাপাশি অসংখ্য সমন্বিত সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মাঙ্গনে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকা এই সকল শব্দ বাংলা ভাষার আর বেগানা কেউ নয়। বরং এই শব্দগুলি বাংলা ভাষাকে সম্প্রসারিত, ঋদ্ধ এবং অলংকৃত করেছে। করেছে বহুগামী ও বহুগ্রাহী। যার ফলে বাংলা ভাষার শ্রী ও শক্তি দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্ভবত: এমন উপলব্ধি থেকেই উত্তরকালে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং মোহিতলাল মজুমদারসহ আরো অনেক শক্তিমান কবিই স্বসৃষ্টিতে আরবী ফারসী শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ শুরু করে দেন। কিন্তু এর পরিপূর্ণ এবং স্বার্থক প্রয়োগ সম্পাদিত হয় নজরুলের হাতে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমূহ উপকার করেছেন। কারণ  আরবী-ফারসী এবং হিন্দী, উর্দু ও ইংরেজি থেকে চয়নতি তাঁর বিশাল শব্দরাজি উত্তর প্রজন্মের বাঙ্গালিদের জন্য বহুমাত্রিক বোধাশ্রিত শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টিতে এক অনন্য উপাদান হিসেবে নিরন্তর কাজ ক’রে যাচ্ছে এবং যেতে থাকবে। বাংলা সাহিত্যের পরিমন্ডলে আরবী-ফারসী শব্দের এই পুনরুজ্জীবনের কাজটি নজরুলের কাব্যজীবনে অদ্বিতীয় এবং প্রায় একক কৃতিত্ব। কিন্তু এতদসত্ত্বেও নানামুখী সমালোচনা আসতে থাকলে তার জবাবে তিনি বলেন__ “আমি বাংলায় চলতি অনেক আরবী-ফার্সী শব্দ ব্যবহার করেছি আমার লেখায়। আমার দিক থেকে ওর একটা জবাবদিহি আছে। আমি মনে করি, বিশ্ব-কাব্যলক্ষ্মীর একটা মুসলমানী ঢং আছে। ও-সাজে তাঁর শ্রী’র হানি হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। স্বর্গীয় অজিত চক্রবর্তীও ও ঢং-এর ভূয়সী প্রশংসা ক’রে গেছেন। বাঙলা কাব্যলক্ষ্মীকে দুটো ইরানী ‘জেওর’ পরালে তাঁর জাত যায় না, বরং তাঁকে আরও ‘খুবসুরতই দেখায়।” 


পরিশেষে বলতে হয় বাংলা, বাঙ্গালি এবং বাঙ্গালিত্বের প্রতিটি কোষ অনুকোষে মিশে আছেন কবি নজরুল। বাঙ্গালি জীবনের পুরো পরিসরে তাঁর আসন চিরস্থায়ী। বাঙ্গালির সকল পরিচয়ে তিনি অনিবার্য। তাঁর সৃষ্টি কেবল শিল্প সৌকর্যের উজ্জল্যেই প্রভাস্বর নয়; বরং তা মানবতা ও মানবিকতার ঐশ্বর্যেও উদ্ভাসিত। তাই শুধু বাঙ্গালি হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও তাঁকে অস্বীকার করা যায় না। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যে তিনি এক অনিবার্য এবং অনস্বীকার্য কবি সত্ত্বা। নজরুল তাঁর কবি সত্ত্বার এই অনশ্বরতার ঘোষণায় নিজেই বলেছেন- 

    “আমি চিরতরে দূরে চলে যাব 

     তবু আমারে দিবনা ভুলিতে। 

     তোমার সুরের নেশায় যখন 

     ঝিমাবে আকাশ, কাঁদিবে পবন 

    রোদন হইয়া আসিব তখন 

    তোমার বক্ষে দুলিতে।” 


.….............................................................................

                                                                                                                                                           








খৈয়াম কাদের

কবি, প্রবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক ও শিক্ষক

এবং

উপাধ্যক্ষ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ,বগুড়া।   


Post a Comment

0 Comments