জব্বার আল নাঈম এর সাক্ষাৎকার

বৈশ্বিক বিভ্রান্তি আমার কবিতার উপকরণ

___জব্বার আল নাঈম


 

রনি বর্মন: লেখালেখির শুরুর গল্পটা জানতে চাই। ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল? প্রথম প্রেরণা, উস্কানি বা, তাড়না কেন মাথায় চেপে বসেছিল?

জব্বার আল নাঈম: আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে আমার গ্রামে। গ্রামের ধান খেত, ফসলের মাঠ, বর্ষা ও বৃষ্টিমুখর পরিবেশ যে কাউকেই প্রাণিত করে। আমাকেও এসব উস্কানি দিত। কিছু একটা নিজের মতো করে প্রকাশ করতে চাইতাম। তখন পাঠ্য বইয়ের বিকল্প বই ঘরে ছিল না। বইয়ের ছড়া-কবিতা নকলের চেষ্টা করে মেজু বোনকে দেখাতাম। তিনি ধরে ফেলতেন। তখন চেষ্টা চলত নকল যেন ধরতে না পারে। একটা সময় বুঝতে পারি তাদের কবিতা নকল করলে নিজের ভাব তো প্রকাশ পাবে না। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় শিশুতোষ ছড়া লিখি, নাম `বুড়ির বিয়ে`। ছাপা হয় চাঁদপুরের সাপ্তাহিক একটি পত্রিকায়। স্কুলের বন্ধুরা জানে আমি টুকটাক লিখি। হাই স্কুলে গিয়ে লেখালেখি আরো বাড়ে। কলেজে গিয়ে লেখালেখি অব্যাহত থাকে। ঢাকায় এসে পুরোপুরি লেখক জীবন যাপন শুরু হয়।
আমার লেখালেখির তাড়না আসে মূলত সমাজ ও বাস্তবতা থেকে। যেখানে অন্যায্যতা বেশি। অসাম্য বেশি। বৈশ্বিক বিভ্রান্তিই আমার কবিতার বেশির ভাগ উপকরণ। 
 যদি গত শতকের পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করি অনায়াসে বিশ জন বিশ্বমানের গল্পকারের কথা বলা যাবে। এঁরা সবাই বাংলা ও বাঙালির পটভূমি নিয়েই গল্প করেছেন। সেই ধারাবাহিকতা বা পরম্পরা এই সময় বহন করছে, সেখানে আমাদের উচিত আরো ভালো মানের গল্প তৈরি করা। তৈরি হচ্ছে। এখন ভালো মানের গল্প বেশি হচ্ছে বা হবে। কারণ, সময়। কারণ, অাবাধ তথ্য-প্রযুক্তি। নিউইয়র্ক শহরে বসে আমাদের বয়সী কথাসাহিত্যিক যে চিন্তা করছে এখানে বসে একই চিন্তা করছি আমরা। ফলে, আমাদের পাঠক উৎকৃষ্ট মানের গল্প আমাদের কাছে প্রত্যাশা করছে। তাছাড়া, এখনকার পাঠকও বোদ্ধা। তারাও পুরো পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা রাখছে। তাই পাঠককে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ খুবই কম।
রনি বর্মন: কী লিখতে এসেছিলেন? কথা সাহিত্যে বা কবিতায় আপনার স্বপ্ন এবং সত্তাকে কতটা ধরতে পেরেছেন?

জব্বার আল নাঈম : যখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈতমল্ল বর্মন, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ সহ বিখ্যাতজনদের কথাসাহিত্যে পড়তাম, সেই সঙ্গে ভাবতাম ওদের মতো করে দুই চারটা যদি লিখতে পারি বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে। সেই ভাবনা থেকে মাঝে মধ্যে কথাসাহিত্যে হাত দিতে ইচ্ছে হয়।

রনি বর্মন: সম্প্রতি আপনার লেখা পান্ডুলিপি জেমকন তরুণ গল্পকার ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয়েছে। এই পুরস্কার প্রাপ্তিতে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।

জব্বার আল নাঈম: যে কোনো পুরস্কারপ্রাপ্তিটা হয় আনন্দের। যদি সঙ্গে অর্থযুক্ত থাকে তাহলে আনন্দের মাত্রাটা হয় দ্বিগুণ। তাছাড়া পুরস্কার মানে স্বীকৃতি। যদিও স্বীকৃতি সহজেই অতিক্রম করে যায় টাকাকে। জেমকন পুরস্কার সন্দেহাতীতভাবে আমাকে খুশি করেছে।

রনি বর্মন: ঠিক কবে থেকে এই পান্ডুলিপির গোছানো শুরু হয়েছিল? পান্ডুলিপির টার্গেট পরিষ্কার ছিলো কিনা।

জব্বার আল নাঈম : গল্প লিখতাম ২০১৬ সাল থেকে। কথাসাহিত্যিক শামস সাইদ বার বার তাগাদা দিয়ে বলতেন, আপনাকে দিয়ে ভালো গল্প হবে। এভাবে ৯-১০ টা গল্প লিখি। এগুলো যে ছাপানো হয় না এমনও না, যুগান্তর, ইত্তেফাক, শব্দঘর, রাইজিংবিডি, বাংলানিউজ, বিডিনিউজ২৪, বাংলা ট্রিবিউন, চিন্তাসূত্র, তীরন্দাজ সহ বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা ও পোর্টালে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। হয়তো অনেকের চোখে পড়ে না। আমিও গল্পগুলো নিয়ে অত মাতামাতি করতাম না। 
গল্প নিয়ে আমার কোনো টার্গেট ছিল না। বাস্তবে কোনো লেখা নিয়েই টার্গেট নেই। মূলত লিখি নিজেকে, নিজের চিন্তাকে প্রকাশ করতে।

রনি বর্মন: ২০১৬ সালেই আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "তাড়া খাওয়া মাছের জীবন" প্রকাশিত হয়। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

জব্বার আল নাঈম : "তাড়া খাওয়া মাছের জীবন" কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের জন্যে হন্য হয়ে প্রকাশক খুঁজছি। অনেক প্রকাশক তখন আমাকে শারীরিকভাবে চেনে না। নামে কেউ কেউ চেনে। তখন সবে `বাংলা একাডেমি তরুণ প্রকল্প` থেকে বের হয়েছি। এক পর্যায়ে কথা হয় শুভ্র প্রকাশের কর্ণদ্বার রতন`দার সঙ্গে। তিনি বইটি প্রকাশে বেশ আগ্রহ দেখান। তখন ভেতরে ভেতরে চরম উত্তেজনা কাজ করছিল। মেলা চলে আসছে বই আসছে না। প্রায় দিনই বাংলা বাজার গিয়ে বসে থাকতাম। তখন আমার সঙ্গে মাজহার সরকারও কয়েকবার গিয়েছিল। ২২ ফেব্রুআরি ২০১৬ মেলায় বই আসে। ওইদিনই বইটি সংগ্রহ করতে চলে আসে মাসুদুজ্জামান, জগলুল হায়দার, পলিয়ার ওয়াহিদ, শামস সাইদ, কাদের বাবুসহ উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকজন। আমার উত্তেজনা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। যারা বই ক্রয় করেছেন তারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, পাঠক বাড়ে। ইত্তেফাক সাহিত্য পাতায় তরুণদের বই আয়োজনে  `তাড়া খাওয়া মাছের জীবন` স্থান পায়। যায় যায় দিন সাহিত্য পাতায় আলোচনা হয়, যুগান্তরে বুক কভার নিয়ে আলোচনা হয়। কাদের বাবু সম্পাদিত `টিন@টিন বইমেলা বুলেটিন` এ নতুনদের নিয়ে কভারেজ দেয়া হয়। এতসব আয়োজন প্রথম বই নিয়ে হবে তা ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। আসলে অন্যরকম অনুভূতির পুরোটা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না।

রনি বর্মন: প্রায় লেখক সম্মানী/রয়েলটির বিষয়ে প্রকাশকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

জব্বার আল নাঈম : লেখক সম্মানীর ব্যাপারে আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলা যায়। পত্রিকায় লিখা বাবদ আমি সম্মানি পেতাম। সব পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ করে লেখক সম্মানি পেয়েছে এমন সৌভাগ্যবান কবি হাতে গোণা কয়েকজন। এই কাতারে আমি খুবই সৌভাগ্যবান।

রনি বর্মন: লেখালেখিতে পড়াশোনা, সংগঠন ও আড্ডার গুরুত্ব কতটুকু আপনি মনে করেন? লেখায় এর প্রভাব পরে কীভাবে??

জব্বার আল নাঈম : বাঙালি খুবই আড্ডা প্রিয়। আড্ডা না দিলে পেটের ভাতও হজম হতে চায় না। আমি আড্ডা দিয়ে জীবনের মূল্যবান অনেক সময় নষ্ট করেছি। যদিও সেসব সাহিত্য রচনায় কাজে লেগেছে। লেখালেখির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানে বই পড়ার বিকল্প কেবল বই পড়া। বই পড়তে হবে। সময়কালকে যেমন জানতে হয়, জানতে হয় পূর্বে কে লিখছেন, কি লিখেছেন। এসব জেনে কলম ধরাটা হয় যৌক্তিক।

রনি বর্মন: বাংলাদেশের ছোটগল্প নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ কোনো পরিকল্পনা ও তারুণ্যের দায় সমর্পকে জানতে চাই।

জব্বার আল নাঈম: আমাদের বসবাস উর্বর গল্পের প্লটে। আনাচে কানাচে অনেক গল্প লুকিয়ে আছে। দরিদ্র মানুষের গল্প থাকে অনেক। প্রয়োজন ভালো একটা গঠন। ভালোভাবে বলা, অথবা উপস্থাপনা। যদি গত শতকের পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করি অনায়াসে বিশ জন বিশ্বমানের গল্পকারের কথা বলা যাবে। এঁরা সবাই বাংলা ও বাঙালির পটভূমি নিয়েই গল্প করেছেন। সেই ধারাবাহিকতা বা পরম্পরা এই সময় বহন করছে, সেখানে আমাদের উচিত আরো ভালো মানের গল্প তৈরি করা। তৈরি হচ্ছে। এখন ভালো মানের গল্প বেশি হচ্ছে বা হবে। কারণ, সময়। কারণ, অবাধ তথ্য-প্রযুক্তি। নিউইয়র্ক শহরে বসে আমাদের বয়সী কথাসাহিত্যিক যে চিন্তা করছে এখানে বসে একই চিন্তা করছি আমরা। ফলে, আমাদের পাঠক উৎকৃষ্ট মানের গল্প আমাদের কাছে প্রত্যাশা করছে। তাছাড়া, এখনকার পাঠকও বোদ্ধা। তারাও পুরো পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা রাখছে। তাই পাঠককে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ খুবই কম।

Post a Comment

0 Comments