নির্বাচিত সাক্ষাৎকার ~

দ্বিতীয় দশকের কবির সাক্ষাৎকার নির্বাচিত সাক্ষাৎকার # হাসনাইন হীরা রনি বর্মন এর গৃহীত  নির্বাচিত সাক্ষাৎকার


রনি বর্মন: লেখালেখির শুরুর গল্পটা জানতে চাই। ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল? প্রথম প্রেরণা, উস্কানি বা তাড়না কেন মাথায় চেপে বসেছিল।

হাসনাইন হীরাছোট বেলায় গুনগুন করে গান গাইতাম। গান যে ভালো গাইতাম, ব্যাপারটা তেমন না। কেন জানি গাইতাম। অনেকেই ক্রিটিক করতোকবি-টবি হওয়ার ইচ্ছে আছে নাকিএই রকম। আমি এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু মনের মধ্যে অইকবিশব্দটা বাজতে থাকে। তো অই শব্দটাকে মূল্য দিতে গিয়ে গ্রামের হালিম স্যারকে সময় দেই। সময় অনেকের সাথে পরিচয় ঘটে। তাদের একজন নূরে মোস্তফা বাবু ভাই। তিনি খুব ভালো লিখতেন। এখন ঢাকা নটরডেম কলেজে পড়ান। তো সময় তিনিনির্ভীকনামে একটা ছোট কাগজ করতেন। কাগজে চার লাইনের একটা কবিতা ছাপালেন তিনি। সেটা স্কুল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ল। একদিন অন্য স্কুলের ছাত্র এসে জানাল, ‘আপনার কবিতা পড়েছি, দারুণ লিখেছেন সেদিন ভীষণ আন্দলিত হয়েছিলাম।
আরেকটু আগের কথা বলি, তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। স্কুলে একদিন টিওনো স্যার এলেন। ক্লাসে শুধু আমিই ডায়েরি ব্যবহার করতাম। তো ডায়েরি দেখে টিওনো স্যার বললেন, কবিতা লেখ নাকি? আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি কালী প্রসন্ন ঘোষের সেই বিখ্যাত কবিতাপারিব নাকবিতাটি গড়গড় করে শুনিয়ে দিলাম। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কি যেন বললেন, মনে নেই। অসম্ভব ভালোলাগা কাজ করতে ছিল। সেই উষ্ণতা এখনও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি রনি দা।
তারপর কলেজে ভর্তি হওয়ার পরদ্যুতিনামে একটা সাহিত্য পত্রিকায় লেখা পাঠালাম। ছাপা হয়ে গেল। পত্রিকার প্রথম কবিতাটাই আমার। পরে জেনেছি, পত্রিকার সম্পাদক আহমেদ ইলিয়াস আমার ক্লাসমেট। অথচ তখনও আমরা পরস্পরকে চিনতাম না। একদিন ক্যাম্পাসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি হীরাকে চেন? খুব ভালো কবিতা লেখে মূহুর্তেই বুকের ভেতর একগুচ্ছ বাতাস দুলে উঠলো। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারছিলাম না। মনে হলো একটা অদ্ভূত ডানা গজে গেছে আমার। আর আমি উড়তেছি... অনুভূতির ব্যাখ্যা হয় না রনি দা। মূলত এইসব টুকরো টুকরো অন্তপ্রেরণাই আমাকে কবিতায় আটকে রেখেছে এখন অব্দি



রনি বর্মন: প্রায় লেখক সম্মানী/রয়েলিটির বিষয়ে প্রকাশকদের বিরুদ্ধে অভিয়োগ করেন। আপনার অভিঙ্গতা কেমন?

হাসনাইন হীরা: সম্মানী অনেক দূরের ঘাট, যোগ্য সম্মানের রাস্তাটুকুই তো নেই। আমাদের লেখকেরা পেট চালায় পেশা দিয়ে আর দুনিয়া চালায় স্বপ্ন দিয়ে। নেশার সাথে পেশার যোগ নেই। এটা সাহিত্যের জন্য অশনি সংকেত। প্রকাশনিগুলো তরুণদের বই করে মহিরুহ হয়ে ওঠে। অথচ তাদের সম্পানী দেয় না। বরং উল্টো কাজটাই হয়। একদম মুরগির মতো জবাই করে খায়। অথচ এসব তরুণরাই কিন্তু একদিন বড় লেখক হয়ে ওঠে। বলতে পারেন, এত পতিবন্ধকতা এড়িয়ে সে কেমন করে হয়ে ওঠে? হয়, কারণ তরুণরা অনেকটাই বাইপাস রাস্তা দিয়ে হাঁটে। অন্ধকার যত অন্ধকারই হোক, তরুণদের হেড লাইট কেউ বন্ধ করতে পারে না! আমার নিজের অভিজ্ঞতাও বাজে। পাণ্ডুলিপি নিয়ে বেশ কয়েকটা প্রকাশনির মুখোমুখি হয়েছি। টাকা ছাড়া কেউ বই করতে চায়নি। আরো বাজে কথা হলো—‘লেখকের প্রথম বই আমরা করি নাএরকম কথাও শুনেছি। এখন বোঝেন ব্যাপারটা কোথায় দাঁড়িয়েছে। আমার কথা হলো, প্রতিষ্ঠান আপনার, মূলধনও আপনার হওয়া উচিত। না পারলে ছেঁড়ে দিন। দুনিয়াতে বহু কাজের জায়গা আছে। আপনাকে কেউ বাধ্য করেনি। কিন্তু কাজ করতে এসে এমন অনৈতিক কাজ করতে কেউ আপনাকে পারমিশন দেয়নি। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে লেখককে নিজেই সোচ্চার হতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু অনুতাপের বিষয় হলো, আমরা এমন এক সময়ে শিল্প চর্চা করছি, যেখানে সবাই প্রচারে কাতর। একদম বেহায়ার মতো।


রনি বর্মন: কী লিখতে এসেছিলেন? কবিতায় আপনার স্বপ্ন এবং সত্তাকে ধরতে পেরেছেন?

হাসনাইন হীরাকবিতা তো অবশ্যই। তবে অন্য লেখাও লিখতে চাই। সেটা অনেকটা কবিতার স্বার্থেই। আবার কবিতার বাইরের লেখাও লিখতে চাই। আল মাহমুদ মনে করতেন, কবিকে গদ্যে-পদ্যে সমান্তরাল হতে হয়। কলকাতার অনুপম মুখোপাধ্যায় মনে করেন, যে কবি কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতে পারে না, তিনি কবি নন। ফলে কবিকে গদ্যও লিখতে হয়। তাদের কথা মেনে কথা বলছি, এমন না। কবিতা লিখতে যে ইমাজিনেশনের প্রয়োজন, একসময় সেই স্বক্ষমতা কবির নাও থাকতে পারে! তখন গদ্য লেখা উচিত। আবার গদ্য-পদ্য একসাথেও চলতে পারে। এটা নির্ভর করে কবির স্বক্ষমতার উপর।
কবিতায় স্বপ্নকে ধরতে হলে, সত্তাকে বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু পরিপূর্ণ কী আর ধরা যায়? কেউ পেরেছে?  স্বপ্ন ব্যাপকতর পরিসর আয়োজন নিয়ে আসে। তাকে কতটুকু আর ভাষায় রুপান্তর করা যায়! ভাষার সেই শক্তি নেই। অধিকাংশ কবিতাই তাই থেকে যায় লেখার বাইরে। কবি জহর সেনমজুমদার মনে করেন, ‘তৃষিত আত্মার অতৃপ্ত বাসনাই কবিতা।ফলে তৃপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। তৃপ্ত হলে স্বপ্ন থাকে না। স্বপ্ন না থাকলে কবিসত্তা মরে যায়। কবিতাও মরে যায়। এটা অনেকটা আত্মহত্যার মতো ব্যাপার-স্যাপার।  ফলে কবির অনুসন্ধান ক্রমাগত বাড়তে থাকে। একজীবনে কয়টা ভালো কবিতা লেখা যায়? অধিকাংশই ভূষিমাল। কিন্তু স্মরণের বাইরে থাকা কবিতাগুলোকেকবিতা নয়এই বলে খারিজও করা যায় না। এটা কবিতার একটা ভোগাস আইডিয়া। এই আইডিয়া কবিতার শক্র। আমার পথচলা সবে শুরু। হাঁটতে হাঁটতে দু একটা কবিতার দেখা পেলে তার সাথে হ্যান্ডসেক করব, আলিঙ্গন করব। তারপর, তাকে কোথাও বসিয়ে রেখে কেটে পড়বো। হা হা...  


রনি বর্মন: লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে তথাকথিত প্রতিষ্ঠান বিরুধিতায় আপনার বিশ্লেষণ কী?

হাসনাইন হীরাপ্রতিষ্ঠান রিরুধিতা মানে বৃহত্তর শক্তিকে ভেঙে দেয়া। পুঁজির দাপটকে ভেঙে দেয়া। অথ্যা ক্ষমতাকে খন্ডাংশে রুপান্তরিত করা। যাতে ক্ষমতা অপক্ষমতায় জড়াতে না পারে। ভাবটা এমন যে, ‘আপনি যত বড়ই হোন না কেন, আপনাকে মানি না।অথ্যা বৃহত্তর জনগোষ্টিকে সুবিধার আওয়াতায় আনা বা সমান করে দেখা। যা মার্কসীয় মডিউল। এটা নিয়ে বহুমুখি আলোচনা করা যায়। কেউ কেউ মনে করে, আমাদের দেশে পুঁজির বিকাশ হয়নি। তাদের ধারনা, বৈশ্বিক পুঁজির তুলনায় আমাদের দেশ অত্যান্ত গরীব। সেই হিসাবে প্রতিষ্ঠান নেই। আপনি ভাঙবেন কাকে?  
আরেকটা আলোচনা করা যায়, প্রতিষ্ঠান ভেঙে যা দাঁড়াবে , সেও তো একটা প্রতিষ্ঠান। তাহলে আপনি করছেনটা কি? এর বাইরে আরেকটা আলোচনা হলো, প্রতিষ্ঠানকে কোনোক্রমেই ভাঙা যায় না। ধরুণ, রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে একটা প্রতিষ্ঠান। আমরা কি রবীন্দ্রনাথকে ভাঙতে পারব? ভাঙা যায় কি? সুতরাং প্রতিষ্ঠান নয়, ভাঙতে হবে ক্ষমতাকে। সেটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বেশি সুবিধাজনক। সেখানে লিটলম্যাগ আন্দোলন উসকে দেওয়ার মতো অনেকটা ভূমিকা রাখতে পারে।


রনি বর্মন : ওয়েবম্যাগ কি লিটলম্যাগের পুরিপূরক হতে পারে?
 
হাসনাইন হীরাজগতের কোনো কিছুই একে অপরের পরিপূরক হতে পারে না। ভাতের স্বাদ কি রুটি দিয়ে হয়? সব কিছুই কোনো না কোনো ভাবে স্বকীয়। ওয়েবের দাপটে লিটল ম্যাগের উপযোগ কিছুটা কমেছে বটে, তবে প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। যাবেও না। আপনি খেয়াল করেছেন নিশ্চয়, ওযেব ম্যাগগুলো সারা বছর লেখা প্রকাশ করে। কিন্তু বছর শেষে তারা আবার প্রিন্ট সংখ্যাও করছে। তার মানে এর প্রয়োজন আছে। ডকুমেন্ট হিসাবে হলেও লিটলম্যাগ থাকবে।  


রনি বর্মন : আপনার মতে লিটলম্যাগের ভবিষ্য কি?

হাসনাইন হীরা যে বললাম, ডকুমেন্ট হিসাবে হলেও লিটলম্যাগ থাকবে। এই ধারণাই বলে দেয়, লিটলম্যাগের বিকল্প কিছু হতে পারে না। বইয়ের বিকল্প যেমন -বুক তার গতি হারিয়ে ফেলেছে, ওয়েবজিনের দশাও তাও হবে। সেক্ষেত্রে লিটলম্যাগ থাকবে। গতিশীলভাবেই থাকবে। আরো একটা উদাহরণ দেই, ইলোকট্রনিক মিডিয়া আসার পর মানুষ ভেবে ছিল, প্রিন্ট মিডিয়ার অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। তা কি হয়েছে? হয় নাই। ফেসবুক আসার পর ধারণা করা হয়েছিল, মানুষ সংবাদ দেখবে না, পড়বে না। কিন্তু ফেসবুক সেই প্রত্যাশার যোগান দিতে পারে নাই। এগুলো হলো সময়ের একেকটা টুলস। যাদের পরিসর নির্দিষ্ট। সুতরাং লিটলম্যাগ থাকবে।


রনি বর্মন: সম্প্রতি আপনার লেখা পান্ডুলিপি জেমকন তরুণ কবিতা ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয়েছে। এই পুরস্কার প্রাপ্তিতে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।

হাসনাইন হীরাএই পুরস্কার যে উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়, তাতে খুশি হওয়ার চেয়ে কাজে মনোযোগ বাড়ানোর ভারই বেশি। ঘোষণাটা যখন এলো, তখন আমি অফিসে। একটা ছেলের চাকরীর ব্যাপারে ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম। সংবাদটা শোনার পর আমি চমকে উঠি। কারন, পুরস্কার নিয়ে বিভ্রান্তির নানা গল্প শুনতে শুনতে সংশয়ে মনটা ভারি হয়ে উঠেছিল। সেটা মূহুর্তেই ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। এবং আমি এতটাই অভিভূত হয়েছিলাম যে, সাথে সাথে অফিস থেকে বেরিয়ে বাসার দিকে হাঁটছিলাম। আর আমার আনন্দের জল গড়িয়ে পড়ছিল আমারই বুকে।


রনি বর্মন: ঠিক কবে থেকে এই  পাণ্ডুলিপি গোছানো শুরু হয়েছিল। পাণ্ডুলিপির টার্গেট ঠিক ছিল কিনা?

হাসনাইন হীরালিখছি দ্বিতীয় দশকের শুরু থেকেই। লিখি আর ছিঁড়ে ফেলি। কখনও টেবিলে আর্বজনার মতো জমতে থাকে।  দু-একটা প্রকাশও হয়। প্রায় তিনেক কবিতা বাতিল হওয়ার পর ২০১৬ তে এসে একটা পাণ্ডুলিপি গোছাই। নাম দেইঅন্ধসারসের তীরন্দাজি’। তখন অর্বাকে আড্ডা দেই।  পাণ্ডুলিপি নাম নিয়ে আড্ডায় একদিন আলোচনাও হয়। কবি দ্রাবিড় সৈকত ভাই বললেন, ‘অন্ধদর্শন অনেক পুরনো বিষয়, অন্য কিছু ভাবতে পার’কবি সঞ্জয় ঘোষও তাতে সায় দিলেন। ফলে আমি নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। আমার কবিতাগুলো অনেকটা দর্শনাক্রান্ত ছিল। ফলে দর্শনকে ধরা যায় এমন নাম খুঁজতে থাকি। সেই জায়গা থেকেপরিব্রাজক সাবানের ফেনানামে নামকরণ করি। একদিন পাণ্ডুলিপি প্রিন্ট করে খিলখেতে বাঁধাই করতে গেছি। হঠা একজন পাণ্ডুলিপির  নাম দেখে আগ্রহ ভরে কিছুটা পড়ে হেসে উঠলো। তিনি মনে করেছিলেন পদার্থ বা রসায়নের কোনো বিষয়-আশয় হবে। কিন্তু কবিতা দেখে তিনি হেসে উঠেছিলেন। তার উদ্বীপক হাসি দেখে কিছুটা ধন্ধে পড়ে যাই। (তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে কি একটা বিষয়ে অনার্সসহ মাষ্টার্স করেছেন) ফলে আবারও নতুন নামের দিকে ঝুঁকতে থাকি। বুঝতে থাকি আমার সময়টা অনেকটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে ভরপুর। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। এখান থেকে মুক্তির উপায় কী! ‘উন্মুক্ততাকিছুটা উপশম হতে পারে। সেখান থেকেই   পাণ্ডুলিপির নতুন নাম রাখিউন্মুক্ত আত্মার উনান কিন্তু কবি কুমার চক্রবর্তী অনূদিত নবেল বিজয়ী কবি টমাস ট্রাইমারের একটা নির্বাচিত কবিতার বইয়ের নাম ছিল, ‘আমি শুন্য নয়, আমি উন্মুক্ত তো এই বইটা হাতে পাওয়ার পরউন্মুক্ত আত্মার উনানথেকেও বের হয়ে আসি। এবং চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দেই কবিতার উপরে। খুঁজতে থাকি কবিতার নতুন পথ। ফলে নতুন ফর্মে লেখা কিছু নতুন কবিতা সংযোজিত হয়। কবিতা যেন নতুন পথে ল্যাম্পপোষ্টের মতো দাঁড়িয়ে যায়। ফলে বইটার নতুন নাম সংযোজিত হয়বাঁক বাচনের বৈঠা বলা যায় অনেকটা বাঁকাচোরা পথ পেরিয়ে কবিতা নতুনের দিকে যাত্রা করা পথের নামবাঁক বাচনের বৈঠা ফলে অনেকটা পরিকল্পনা যে ছিল, সেটা দাবি করা যায়। এটাকে আপনি টার্গেট বললে, বলতে পারেন।  


রনি বর্মন  তো জেমকনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কাগজ প্রকাশন থেকে আপনার প্রথম বইবাঁক বাচনের বৈঠাপ্রকাশিত হয়েছে। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল।

হাসনাইন হীরা: বলা যায় বিষাদ থেকে উঠে দাঁড়ানো কোনো মানসিক রোগির যে রকম আনন্দ লাগে। ঠিক ঐরকম একটা ভালোলাগা কাজ করছিল। বইটা যেদিন বের হলো, সেদিন রাতে কবি অরবিন্দ চক্রবর্তী ফোনে আমাকে জানালেন। কিছুক্ষণ পর জাহিদ সোহাগ ভাই ইনবক্সে একটা ছবি দিলেন। মোড়ক উন্মোচনের ছবি। ছবিতে কবি বীরেন মুখার্জী, জাহিদ ভাই অরবিন্দর হাতে আমারবাঁক বাচনের বৈঠা রাত ছিল শবে বরাতের রাত। মনে হচ্ছিল যেন ভাগ্য বদলের রাতে আমার ভাগ্যটাও বদলে গেছে। তখন আমি নরসিংদী। ভেতরে ভেতরে একটা তোলপার করা ভালোলাগা কাজ করছিল। বইটা স্বশরীরে দেখার উত্তেজনা প্রবল হতে থাকে। তার দুদিন পরেই করোনা মহামারী উপেক্ষা করে ছুটে যাই বইমেলায়। তখনকার অনুভূতি আরো বিচিত্র। মনে হচ্ছিল যেন কোথাও একটা সবুজ পাতা বাতাসে অবিরাম দুলছে। কোথাও যেন একটা ফুল ফোটার আওয়াজ কান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। যা কেবল আমিই দেখছি আর শুনছি।
তো বইমেলায় ঢুকলাম বেলা বারোটার কাছাকাছি। ভাবলাম, নিজের বই একা দেখতে চাই না। অনেককেই তাই খুঁজছিলাম। পেলাম না। লিটলম্যাগ কর্ণারে ঢুকে পেয়ে গেলাম কবি অনিন্দ্য দ্বীপ মাহমুদ নোমানকে। দুজনকে নিয়েই হাঁটছিলাম কাগজ প্রকাশনের দিকে। কল্পনায় তখন ভেসে বেড়াচ্ছিলাম শামসুর রাহমানের প্রথম বই প্রকাশের কথায়। মনে পড়ছিল আল-মাহমুদের প্রথম বই উদযাপনের কথাও। আমার সাথে হয়তো আল মাহমুদ নেই, কিন্তু মাহমুদ নোমান আছে। নির্মলেন্দু গুণ নেই, কিন্তু অনিন্দ্য দ্বীপ আছে। সেটাই আমার কাছে অনেক পাওয়া, অনেক ভালোলাগার। সেই উষ্ণতা নিয়েই স্টল থেকে বইটা নিয়ে তিন জনই নেড়ে-চেড়ে দেখছিলাম। তিনজনের মুখেই তখন পুলকিত হাসি আছড়ে পড়ছিল বইটির পাতায় পাতায়। অদ্ভুত এক উষ্ণতায় ঝলসে ওঠেছিল মন। মনে হচ্ছিল সেদিনের সূর্যটা যেন আমার জন্যই উঠেছিল।


রনি বর্মন : লেখালেখিতে পড়াশোনা, সংগঠন আড্ডার গুরুত্ব কতটুকু বলে আপনি মনে করেন? লেখায় এর প্রভাব পড়ে কিভাবে?

হাসনাইন হীরাকে যেন বলেছিল , কেউ যদি লেখক হতে চায়, তাকে তিনটি জিনিস করতে হবে। সেই তিনটি জিনিস হলো, পড়াশোন, পড়াশোনা এবং পড়াশোনা। তো পড়াশোনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি সংগঠন আড্ডার ভূমিকাও কম নয়। পড়াশোনা আপনার জ্ঞানকাÐ নতুন একটা ফল পাদ করতে সহায়তা করে। তবে ফল পাকাতে এবং সু-সাধু করে তুলতে হলে আড্ডা অনেকাংশেই অনিবার্য। আড্ডাতেই বোঝা যায়, আপনার ৎপাদিত ফল টক না মিষ্টি। বদ্ধুদেব বসু মনে করতেন, ‘আড্ডা জ্ঞানকে পাকায় তাই আড্ডা করতে হলে সংগঠন একটা সহায়ক হিসাবে কাজ করে। সাহিত্যের বড় বড় মুভমেন্টগুলো সংগঠন আর আড্ডার মাধ্যমেই জন্মলাভ করেছিল। সুতরাং এগুলোর দরকার আছে। তবে না হলে চলে না, বিষয়টা এমন নয়। একটা সময় গিয়ে আড্ডার প্রযোজ্যতা ফুরিয়ে যায়।

রনি বর্মন: কবিতা নিয়ে আপনার ভবিষ্য কোনো পরিকল্পনা তারুণ্যের দায় সম্পর্কে জানতে চাই।

হাসনাইন হীরাভবিষ্য বলা মুশকিল রনি দা। মানুষের অনেক অক্ষমতার মধ্যে একটা অক্ষমতা হলো, সে ভবিষ্য বলতে পারে না। যেটা বলে, সেটা তার অনুমান। সুতরাং অনুমানমূলক কিছু না বলাই ভালো। তবে যেহেতু নিরীক্ষাপ্রবণ কবিতা চর্চা করি, ফলে কবিতা নিয়ে অনেক পরিকল্পনাই আছে। সেটা অনুভবও করি। হয়তো তারুণ্যই এই অনুভবের নিয়ামক। দেশ সমাজের যে কোনো সংকটের সময় তরুণরাই রুখে দাঁড়িয়েছে। দেশে বুদ্ধিজীবীর কলমের চাইতে তারুণ্য শক্তি অনেক এগিয়ে। অনেক তার ইতিহাস আছে। সুতরাং সেই শক্তিকে ব্যবহার করা আমাদের শুধু দায় নয়, দায়িত্বও বটে।  





সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

হাসনাইন হীরা
জন্ম সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানাধীন বাঙ্গালা গ্রামে। পড়াশোনা সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক্তর। বাঁক বাচনের বৈঠা তার প্রথম কবিতার বই। এই বইয়ের পাণ্ডুলিপির জন্য অর্জন করেছেন, জেমকন তরুণ কবিতা পুরস্কার-২০২০। উড়োযোগ-০১৯১৩-৭০৮৬৮৩

 

Post a Comment

0 Comments