অনু ইসলাম এর গদ্য


  

রঙ। রঙ এক মনস্তাত্ত্বিক প্রতীতি। রঙের কোন বস্তুবাচক অস্তিত্ব নেই। তবু বিচিত্র বিশেষণে রঙকে অভিহিত ও অলঙ্কৃত করা হয়। রঙের ঐতিহ্যে প্রতিটি রঙের বিশেষ ভাবার্থ ও প্রতীকী মূল্য আছে। রঙ মানুষের অন্তরের এক নিজস্ব অনুভূতি; যা মানুষের ভাব ও বিশ্বাসকে ভাষা দিয়েছে, মূর্ত করেছে, এমনকি অতিরিক্ত প্রতীকী অর্থ দিয়েছে। চোখ খুলে তাকালেই প্রকৃতির মাঝে নানান রঙের উদ্ভাস দেখি। শুধু প্রকৃতি নয়। প্রকৃতি বাইরেও সচেতন বা অবচেতনে রঙকে নানান ভাবে অনুভব করা হয়ে 

রঙের প্রতি মানুষের টান বহুপুরনো। রঙ মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও কৌতুহলী সৃষ্টিকারী বিষয়। রঙকে মানুষের সভ্যতার এক অপরিহার্য অংশ হিসেবেও দেখা হয়। রঙের সঙ্গে সভ্যতার সংযোগ ও সম্পর্ক দূর প্রসারী, রঙ মানুষের রক্তের গভীরে প্রোথিত। রঙ বা বর্ণানুভূতির জন্যে অবশ্য আলোই প্রধান। আলো হলো মনোপদার্থবিদ্যক প্রতীতি। আলোর মধ্যেই রঙের যতো খেলা। আলোর রশ্মি প্রতিবিম্বিত হলেই বস্তুতে রঙ পরিস্ফুট হয়।

থাকে। রঙের প্রতি মানুষের টান বহুপুরনো। রঙ মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও কৌতুহলী সৃষ্টিকারী বিষয়। রঙকে মানুষের সভ্যতার এক অপরিহার্য অংশ হিসেবেও দেখা হয়। রঙের সঙ্গে সভ্যতার সংযোগ ও সম্পর্ক দূর প্রসারী, রঙ মানুষের রক্তের গভীরে প্রোথিত। রঙ বা বর্ণানুভূতির জন্যে অবশ্য আলোই প্রধান। আলো হলো মনোপদার্থবিদ্যক প্রতীতি। আলোর মধ্যেই রঙের যতো খেলা। আলোর রশ্মি প্রতিবিম্বিত হলেই বস্তুতে রঙ পরিস্ফুট হয়। আমরা রঙ তখনি দেখি যখন বস্তুতে এক বা একাধিক আলোকরশ্মি প্রতিবিম্বিত হয় এবং অবশিষ্ট রশ্মিগুলো শোষিত হয়। সকল বস্তুতেই আলোর কিছুটা শোষণ ও কিছুটা প্রতিবিম্ব ঘটে। আলোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রঙ এর পরিবর্তন ঘটে। তাছাড়া একটি বস্তুকে এদিক-ওদিক নাড়লেও রঙও নড়াচড়া করে। এভাবে রঙ এর পরিবর্তনের সঙ্গে বস্তুর আকৃতিরও পরিবর্তন ঘটে। তাছাড়া, রঙকে একই সাথে চোখের, বুদ্ধির, মনের ও আত্মার সঙ্গে এক অদ্ভূত সংযোজন বলে মনে করা হয়। রঙ বিচ্ছিন্ন ও পৃথক কিছু নয়, তা জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। মনোবিজ্ঞান অনুসারে রঙ হলো এক ধরনের চাক্ষুস সংবেদন যার অস্তিত্ব শুধুমাত্র মনের অস্থায়ী সচেতনতা রূপে। কোথায় নেই রঙ। রঙ আমাদের প্রাগৈতিহাসিক ঐতিহ্যে, ইতিহাসে, নৃতত্ত্বে, প্রত্নতত্ত্বে, ধর্মে, অতিকথায়, প্রতীকতায়, রহস্যময়তায়, চিত্রশিল্পে, শিল্প-সাহিত্যে, স্থাপত্যে, আলোকচিত্রে, সংস্কৃতিতে, সংস্কারে, গৃহসজ্জায়, বিজ্ঞাপনে, বিজ্ঞানে-অপবিজ্ঞানে এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজকর্ম, চিন্তা-ভাবনা, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান সব কিছুতেই রঙের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। রঙের অনুভব আমাদের এক সম্পন্ন অনুভূতি, রঙের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ ও নিয়মিত। রঙ হলো শিল্পের রৌদ্রালোক, যা দারিদ্র্যকে হাস্যোদ্ভাসিত করে ও সুন্দর করে তোলে দ্বিগুণ সুষমায়। সমস্ত প্রকৃতি ও জগৎ জুড়ে রঙের যে ঐক্যতান, তার সঙ্গে নিজেকে সমানুভূতিতে ও একই সুরে বেধে রাখাটা মূখ্য। রঙ হলো অনেকটা ভাষার মতো। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তার দৃষ্টির বৈভব। ভাষার মতো মানুষেকে তার দৃষ্টির বৈভবও অর্জন করতে হয়। মানুষের পারসেভশন দৃষ্টি বা অনুভবের দৃষ্টি থাকতে হবে। অপটিক্যাল দৃষ্টি আর অনুভবের দৃষ্টি এক জিনিস নয়। অনুভবের দৃষ্টি থাকলেই তা এক্সপেশন বা প্রকাশ করতে পারা যায়। এই অনুভবের দৃষ্টি দিয়েই আমরা আমাদের বিভিন্ন অনুভূতিকে কবিতার উপমায় , উৎপেক্ষায় রূপকে, প্রতীকে ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকি। তেমনি প্রশান্তি, ত্যাগ, আনন্দ, উষ্ণতা, শীতলতা, ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ ও ভালোবাসা সবকিছুই রঙের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকি। প্রত্যেক শিল্পীই তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন রঙকে বিভিন্নভাবে চিত্রিত করে থাকেন। শিল্পীর অনুভূতি অথবা ধারণাকে রূপগত আকৃতিতে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে রঙ একটি প্রচণ্ড তীক্ষ্ম ও শক্তিশালী মাধ্যম। আবেগগত অভিব্যঞ্জনা তৈরী হয় রঙের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া থেকে যা এতো প্রবল যার মাধ্যমে আমরা আমাদের আবেগকে বিভিন্ন রঙের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে সমন্বিত করি। একজন শিল্পীর রঙ ব্যবহার করার প্রচুর সুযোগ থাকে এবং চিত্তের সকল প্রকার ইঙ্গিত ও আশ্বাসকে রঙ দিয়ে তিনি প্রকাশ করেন। রঙ একটি অসাধারণ প্রকাশক্ষম শিল্প-উপাদান। এই প্রকাশ-ক্ষমতার প্রাচুর্যের কারণেই প্রয়োগবিধি জটিল ও পরিবর্তনশীল। একজন শিল্পী যেমন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অন্তঃসার থেকে রঙের স্বভাবকে আবিস্কার করেন এবং নিজস্ব প্রয়োগপদ্ধতি সুস্পষ্ট করেন। তেমনি একজন কবিও অনুরূপ কাজটি করেন তার কবিতা ক্যানভাসে। কবিতায় রঙের ব্যবহার যদিও নতুন কোন বিষয় নয়; অনেক পূর্ব থেকেই কবিরা তাদের কবিতায় রঙের ব্যবহার করে আসছেন। তাই, একজন শিল্পীর মতো একজন কবি তিনি কিভাবে তার কবিতায় রঙের স্বভাবকে আবিস্কার করেন এবং নিজস্ব প্রয়োগপদ্ধতিতে কিভাবে কবিতায় রঙের ব্যবহার করেন মার্জিত ব্যঞ্জনায় তার কিছুটা আলোচ্যবিষয়ের স্বার্থে দেখানোর চেষ্টা করবো বাংলা কবিতার খুবই গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন কবির কবিতার মধে দিয়ে-

 

১. কবি জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির কবি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতি যেনো এক অনিবার্য বিষয়। প্রকৃতির প্রতিটি শাখায় রয়েছে বিচিত্র রঙ। প্রকৃতির এমন কোন শাখা-উপশাখা বাদ নেই যেখানে চোখ মেলে তাকালেই রঙের অনুভূতি না হয়। এই বিচিত্র শাখা-উপশাখা থেকেই জীবনানন্দ তার কবিতায় রঙের এক অদ্ভুত খেলায় মেতে ওঠেছিলেন বলা যায়। প্রতিটি রঙকে নিয়ে তিনি তার কবিতায় খেলেছেন জীবনবোধের গভীরতর স্থানে পৌঁছানোর জন্যে। জীবনানন্দের কবিতায় ধূসর, শাদা, কালো, নীল, লাল, হলুদ, সবুজ, বাদামি, খয়েরি, গোলাপি অসংখ্য রঙ ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। প্রতিটি রঙের নিজস্ব রূপভেদ আছে, চিন্তা আছে। সেই রূপভেদ বা চিন্তার প্রতিফলন প্রতিটি রঙের ভিতর দিয়ে জীবনানন্দ তার নিজস্ব বোধকে তুলে ধরেছেন ব্যবহারিক বৈচিত্রতায়। যা তিনি কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষায় প্রতীকতায় ব্যবরহার করেছেন। জীবনানন্দের অসংখ্য ব্যবহৃত রঙের কবিতার মধ্য থেকে তার কিছু রঙের ব্যবহারের কবিতা তুলে ধরা হলো- 

১। নীল জানালার পাশে-ভাঙা হাটে- চাঁদের বেসাতি!/ চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে!/ কোন ভীরু কপোতীর উড়ু উড়ু ডানা!/-কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ- আলোর মোহনা- (অস্তচাঁদ) 

২। ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল,-/ ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার,- রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল,-/ চুল যার শাঙনের মেঘ,- আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপি রঙিন,/ আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে,- স্বপ্নে-কত দিন।– (ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল)

 ৩। রয়েছি সুবজ মাঠে-ঘাসে-/ আকাশ ছড়ায় আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে;/ জীবনের রং তবু ফলানো কি হয়/ এই সব ছুঁয়ে ছেনে!- সে এক বিষ্ময় (নির্জন স্বাক্ষর)

৪। চারিদিকে এখন সকাল,-/ রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল!/ মাঠের ঘাসের ‘পরে শৈশবের ঘ্রাণ,- পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান! (অবসরের গান)।

৫। দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,/হিজলের জাালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,/ ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,/ চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরছে দু’বেলা- (মৃত্যুর আগে)। 

৬। দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে/ ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে- (তোমরা যেখানে সাধ)।

৭। এইখানে আকাশ নীল- নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল/ ফুটে আছে হিম শাদা- রং তার আশি^নের আলোর মতন;/ আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ-( এখানে আকাশ নীল)।

৮। অশ^ত্থে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে নীল বাংলার বনে/ মাঠে মাঠে ফিরি একা: মনে হয় বাংলার জীবন সংঙ্কট- (অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া)।

৯। যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে উঠানের খয়েরি পাতায়,/ যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়,/ শামুক গুগলিগুলো প’ড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে-( যদি আমি ঝ’রে যাই)।

১০। সবুজ ঘাসের দেশে যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,/ তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘ এতদিন কোথায় ছিলেন ?’/ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। ( বনলতা সেন)। 


২. কবি আহসান হাবীব। আহসান হাবীবের কবিতায় মূলত আমরা সমকালীন বাসস্তবতা, মানবমনের স্থিরতা-অস্থিরতা, সংকট-উত্তরণের প্রত্যাশার চিত্র ফুটে ওঠতে দেখি কবিতার ক্যানভাসে। তিনি ছিলেন অস্তিত্বসচেতন। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আশাবাদ, প্রশান্তি আর আবেগ এর মধ্য দিয়ে আহসান হাবীবের কবিতায় রঙের ব্যবহার কল্পনা আর বাস্তবের এক বিশুদ্ধ মেলবন্ধন। তিনি জাগতিক চেনা জগতের রঙকে তুলে ধরেছেন সহজ ভাষায় অবলীলাক্রমে। আহসান হাবীব তার কবিতায় রঙের বিচিত্র সহজসরল রূপকে কীভাবে তুলে ধরেছেন তা কিছুটা তুলে ধরা হলো-

১। নীল অরণ্যে এল অপঘাত অকস্মাৎ/ যুগের চিতায় জ¦লে জীবনের প্রিয় প্রভাত।(দিনগুলি মোর)।

২। ঝরা পালকের ভষ্মস্তূপে তবু বাঁধলাম নীড়,/ তবু বারবার সবুজ পাতার স্বপ্নেরা করে ভীড়।/ তবু প্রত্যহ পীত অরণ্যে শেষ সূর্যের কণা,/ মনের গহনে আনে বারবার রঙের প্রবঞ্চনা।- (এই মন- এ মৃত্তিকা)।

৩। এ-দিন সে-দিন নয়- সুরভিত, হালকা কোমল;/ এ-দিন সে-দিন নয়-শাদা রোদ, রঙিন পলাশ!/ আজকের দিনগুলি ডানাভাঙা পাখি একদল,/ এ-দিন মমতাহীন, দুর্বিষহ রূঢ় পরিহাস! -(দ্বীপান্তর)।

৪। লাল মাটি কালা পিচ্ আর এই হাওয়াই আগুন/ বুকে তার ঝকঝকে উড়ন্ত শেভ্রোলে কার/ রেখে যায় ধুলো আর কয়লা/ তারি মাঝে আমাদের কাটা মাথা ঘুরপাক খায়।-(কনফেশান)।

৫। কোন এক নতুন নিখিল,/ অসংখ্য স্বপ্নের কুচি মুঠিমুঠি নীল।/ সেই সব স্বপ্ন/ যারা আকাশের নীলের মতন।/ মুঠোয় জড়াতে চায় সেই নীল আমাদের মন।-(প্রদক্ষিণ)।

৬। সারা পথে; মাকে আর প্রেয়সীকে আর এই দেশকে / আমি ভালোবাসি এই ছোট কথাটি প্রত্যহ/ নানা রঙে/ এঁকেছি তোমার বিচিত্র রঙের তুলি হাতে নিয়ে।-(তোমাতে অমর আমি)। 

৭। পলাশে বকুলে বিকশিত/ সোঁদাল মাটির গন্ধে মর্মরিত/ হলুদ ফুলের স্বচ্ছন্দ সহজ সমর্পণে/ সজ্জিত চিত্রিত এক অকৃত্রিম প্রতিমার কামনায়/এ জীবন সমর্পিত ছিলো।-(যৌবনে জীবনে তুমি)।

৮। জানালায় নীল রেশমী পর্দা থাকলে/ দেয়ালে টাঙানো থাকলে/ জ¦লজ¦লে প্রৌঢ় মুখ/ মাল্যময় বুক/ সুখ বলে মনে হয় তাকে।- (সুখ)।

৯। তখনো বিকেল নয়।/ শুভ্র রূপালি রোদের সমুদ্রে/ আকাশের নীল/ ভেঙে ভেঙে পড়ছে।/ তখনো দুপুর/ আরো অনেক পরে/ বিকেলের সোনা রঙ লাগবে পৃথিবীর গায়ে।-( নীল খাম)।

১০। তোমার অধর কেঁপে কেঁপে গেল, বলে গেল, ‘ভালোবেসেছি’!/ তোমার মন জানতো, আমি যাবো।/ তাই মনের রঙ লেগেছে তোমার শাড়িতে,/ রক্ত পলাশের রঙ।-( নীল খাম)।

১১। আমি আমার সমস্ত যৌবন তার হাতে নিঃশেষ করে/ মিনতি করেছি, আমার টিকিট দিন/ আমার যাবার টিকিট দিন/ শাদা নীল অথবা সবুজ/ এমনকি ফ্যাকাশে হলুদ হোক তার রং/ তুব একটা টিকিট আমার চাই।/ নেই! বলে তিনি আমার মুখের ওপর / বারম্বার এই খুপরি বন্ধ করেছেন।- (অপেক্ষা)।


৩. কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তার অসংখ্য ছোট ছোট কবিতার পঙক্তির মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গত কারণে বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে দিয়ে রঙের বিচিত্র রূপকে তুলে ধরেছেন। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র কবিতায় রঙের ব্যবহার করেছেন তার এমন কিছু কবিতা তুলে ধরা হলো- 

১। চাঁপার বনে রঙ লেগেছে/ তোমায় দেখে কী ?/ কেইবা চাঁপা কেইবা তুমি/ চিনতে পারিনি;- (সাতনরী হার)।

২। কন্যে তোমার গায়ে হলুদ/ তত্ত্ব এনেছি/ পোড়া চোখের কালি দিয়ে/ কাজল এঁকেছি।- (কন্যে তোমার)।

৩। কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে/ আগুন লেগেছে/ পলাশ বনে লাল পরীরা/ নাইতে নেমেছে- (রূপকথা)।

৪। কালো দেশের অন্ধকার/ গভীর গানে অনুভবে/ চিতাবাঘের ছায়ায় জ¦লে/ জোনাক পোকা আপন মনে- (প্রেম-অপ্রেম)।

৫। তখন হলুদ হাওয়া / শিরীষে ফুলের ডানা/ শস্যের আলপথে/ বেগুনি জারুল/ সবুজ সাজিনা ডাঁটা/ কিশোরীর পায়ে নচে/ ঢেকি ভাঙা ঘাসের শিশির-আলপথে- (অরূপ রতন)।

৬। মা কি শালিখ পাখি?/ খয়েরি শাড়িতে তার/ হলুদের ছোপ/ তারপর একদিন তিনি শুভ্র কাফন পরে/ শেফালির ফুল।- (মা তুমি)।

রঙ এমন এক অভিজ্ঞাত যা দূরপ্রসারী, যার প্রভাব ব্যক্তিগত, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক। রঙ বা বর্ণচেতনা আমাদের সমগ্র জীবন ও ভাবনাকে সমৃদ্ধ করে আসছে যুগে যুগে। রঙ এমনই বিচিত্র শক্তি যার অস্তিত্ব মনের অস্থায়ী সচেতনতা রূপে অগ্রসরমান। সেখানে নানান রঙের খেলা চলে অবিরাম।

৪. কবি আল মাহমুদ। জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী সময়ের কবিদের মধ্যে প্রকৃতি ও গ্রাম বাংলার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন নিভৃতভাবে আল মাহমুদ। আল মাহমুদের কবিতায় আমরা খুব সহজেই তাই গ্রাম বাংলার সবুজ শ্যামল রূপ খুঁজে দেখলে সেখানে রঙের ব্যবহার পরিলক্ষিত হতে দেখি। আল মাহমুদের কয়েকটি কবিতায় রঙের ব্যবহর তুলে ধরছি।- 

১। আমার চেতনায় যেন সাদা এক সত্যিকার পাখি/ বসে আছে সবুজ অরণ্যে এক চন্দনের ডালে; -(লোক লোকান্তর)।

২। গোঁসাইপুরের ঘাটে হয়তোবা ভোর হবে কাল,/কারুকর্মী মহাকাল আঁকবেন সবুজ সকাল। -(নৌকায়)।

৩। ঝরুক পাতা পুরনো পাতা হলুদপাতা ঝরুক/ বীজের মুখ সবুজ কুঁড়ি অবুঝ মাথা গড়ুক। -(মন্ত্র)।

৪। হাওয়ায় হলুদ পাতা বৃষ্টিহীন মাটিতে প্রান্তরে/ শব্দ করে ঝরে যায়। ভিনদেশী হাঁসেরাও যায়/ তাদের শরীর যেন অবুদ্ধ বুদ্বুদ/ আকাশের নীল কটোরায়।- (বাতাসের ফেনা)।

৫। কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।/ শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে। চোখের পাতায় / শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ/ লাল সূর্য উঠে আসবে।- (প্রত্যাবর্তনের লজ্জা)।

৬। জানি না দেশের খবর কিছু পান কিনা / কী ঘটবে এশিয়ায় এ নিয়ে তর্ক করে আপনার যাওয়ার পর/ পৃথিবীর সবকটি শাদা কবুতর/ ইহুদি মেয়েরা রেঁধে পাঠিয়েছে মার্কিন জাহাজে।- (আত্মীয়ের মুখ)।

৭। সবুজ আমার চোখে আঘাতের মত বাজতে থাকে/ আমার চোখে তখন সবুজকে লাল বলে মনে হয়/ সে লাল আবার নীল হয়ে যায়। তারপর কালো।/ এইভাবে শতবর্ণে রঞ্জিত হতে হতে/ শাদা এসে সবকিছুকে ঢেকে ফেলে।/ চোখ তুপ্ত হতে থাকে। অথবা- আমি কেন প্রতিটি রংয়ের ভিতর / অন্য রং কে দেখতে পাই।(চোখ)।


৫. কবি শহীদ কাদরী। শহীদ কাদরী একজন রাজনৈতিক সচেতন কবি। তার কবিতায় রাজনীতি, রাষ্ট্রযন্ত্র, দেশপ্রেম, সময়জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। শহীদ কাদরী তার কবিতায় বেশ সুন্দর ও পরিচ্ছন্নভাবে রঙের ব্যবহার করেছেন মার্জিতরূপে। শহীদ কাদরীর কবিতায় রঙের ব্যবহারর চিত্র কিছুটা তুলে ধরছি- 

১। আমার নির্বেদ কোন বালকের ব্যগ্র আঙুলের মতো/ আদর জানাবে শাদা উষ্ণ রঙ রাজ হাঁসের পালকে/ অবিশ^াস মখমলের কালো-নক্ষত্র-খচিত টুপি পরে/ সশব্দে দরোজা খুলে এক হাল হাওয়া খেয়ে বেড়াবো বাগানে- (নশ^র জ্যোৎস্নায়)।

২। রয়ে যাই ঐ গুল্মলতায়,/ পরিত্যক্ত হাওয়ায়-ওড়ানো কোন হলুদ পাতায় /পুকুরপাড়ের গুগগুলে/ একফোঁটা হন্তরক বিষে, যদি কেউ তাকে পান করে ভুলে।- ( মৃত্যুর আগে)।

৩। রঙে জোড়ায় জোড়ায় আলিঙ্গনে/ নীল, হলুদ ফুর্তিবাজ পাখিদের আনন্দগুলো/ তরুণ তরুণীদের চোখে উৎসবে; বর্ণালী বাল্বে/ ত্রিলোকের অন্ধকারে সকল আঙুর ক্ষেতে/ একটি উজ্জ্বল বড় মুদ্রা জ্যোতিচক্রের মতো ঘিরেছে জীনকে।( দুই প্রেক্ষিত)। 

৪। ভুল স্টেশনের দিকে শিস দিতে দিতে চলেছো যেখানে/ শাদা উরু আর শিশ্নের সঙ্কেত ছাড়া/ লাল সিগন্যাল জে¦লে/ কোন ট্রেন কখনো দাঁড়াবে না।- ( অন্য কিছু না)। 


৬. কবি নির্মলেন্দু গুণ। তিনি প্রধানত বিপ্লববাদী। তার কবিতায় প্রেম-দ্রোহ, সংঘাত, বিদ্রোহ, সমাজচিন্তা, রাষ্ট্রচিন্তা পরিলক্ষিত হয়। এসব চিন্তার মধ্যে দিয়ে তিনি তার কবিতায় রঙকে কখনো প্রেমের, কখনো সংঘাতের, কখনো সংগ্রামের, কখনো মুক্তির, কখনো স্বাধীনতাকামী মানুষের আশাজাগানিয়া কণ্ঠ শুনিয়েছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ সংগ্রামি কবিতার ভাষ্যকার। তার কবিতাগুলোতে কিভাবে রঙের ব্যবহার এসেছে কিছুটা দেখা যেতে পারে - 


১। বাসন্তী হলুদে হাঁটো, তাই বাস থেকে নেমে পড়ি/ নীল মেডিকেলে; টিকিটগুলো শ্যামলী, শ্যামলী/ তুমি বোললে খোলাচুলে কালোব্যাচ, শোকচিহ্ন হয়/ বুকে কালো ফিতে বাঁধা পুরুষে মানায় তুমি বোললে তাই/ পাঞ্জাবিতে কালো ফিতে গাঁথলো আলপিন।- (জনাকীর্ণ মাঠে জিন্দবাদ)।

২। আমিও তো তোমাদেরই মতো প্রতিবাদে বলেছি তখন/ প্রেমাংশুর বুকের রক্ত চাই, হন্তার সাথে আপোস কখনো নাই।/ বুকের বোতাম খুলে প্রেমাংশুকে বলিনি কি দেখো,/ আমার সাহসগুলি কেমন সতেজ বৃক্ষ-/ বাড়ির পাশের রোগা নদীটির নীল জল থেকে / প্রতিদিন তুলে আনে লাল বিস্ফোরণ।-(প্রেমাংশুর রক্ত চাই)।

৩। স্বপ্ন-জড়ানো অবাক কণ্ঠে/ আঁধার পালালো/ সাদা পালকের শারদ সকালে/ নবজাতকের পদ্মচোখের সহসা আড়াল/ লাল উদয়ন নয়ন মেললো/ গন্ধ ছড়ানো/ পুবের আকাশে রক্তের ছোপ/ লাল প্রচ্ছদ; নিপুন তুলির হলুদ ফড়িং- ( স্বদেশের মুখ শেফালীর পাতায়)।

৪। তোমাকে নিশ্চয়ই একদিন কিনে দেবো সবুজ রঙের/ হাঙ্গোরিয়ান ব্রা এবং একটি আশ্চর্য লাল সূর্যের মতো স্কার্ফ।/ তোমার নরম কোমল কোল জুড়ে নিশ্চয়ই একদিন / সবুজ পাতার মতো ফুটফুটে শিশু ফুটবে, বৃষ্টিধারার মতো/ পর্বতের ঢালু বেয়ে নেসে আসবে তার খিলখিল হাসির শব্দ।/ কিন্তু তার আগে চাই সমাজতন্ত্র।- (তার আগে চাই সমাজতন্ত্র)। 


৭. কবি আবুল হাসান। আবুল হাসান ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন এবং বাস্তবতাবাদী। তার কবিতায় দুঃখবোধ, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিঃসঙ্গচেতনা এবং আত্মমগ্নতা ছিলো প্রধান উপজীব্য বিষয়। এইসব দুঃখবোধ ও আত্মমগ্নতার ভিতর দিয়ে তিনি মানুষের জীবনবোধ ও বাস্তবতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কখনো নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে সমাজের কিংবা রাষ্ট্রের সর্বজনীন মানুষের অধিকারকে তুলে ধরার প্রয়াস করেছেন কবিতায়। স্বতন্ত্র নিমার্ণশৈলী দিয়ে তিনি তার নিজের কাব্যাস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলা যেতে পারে। আবুল হাসান তার কবিতার ভিতর, কবিতার প্রয়োজনে কিংবা সময়ের প্রয়োজনে কবিতায় রঙের ব্যবহার করেছেন। তার কবিতায়ও নীল, কালো, হলুদ, সবুজ রঙ ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। আবুল হাসানের কবিতায় রঙ যেখাবে ওঠে এসেছে তার কিছু পঙক্তি তুলে ধরা হলো - 

১। হয়তো যুদ্ধের নাম, জ্যোৎস্নায় দুরন্ত চাঁদে ছুঁয়ে যাওয়া,/ নীল দীর্ঘশ্বাস কোন মানুষের!/ সত্যিই কি মানুষের?- (আবুল হাসান)।

২। অন্ধকারের স্বীকৃতি চাই/ স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে।-(স্বীকৃতি চাই)।

৩। কেউ বলে যাচ্ছে যেনো,/ বাবলু তোমার নীল চোখের ভিতর এক সামুদ্রিক ঝর কেন ?- (পাখি হয়ে যায় প্রাণ)।

৪। বাবা তখন উপার্জিত সবুজ ছিপের সুতো পেঁচিয়ে মাকে বোরছেন, এই দ্যাখোতো/ জলের রং-এর সাথে এবার এই সুতোটা খাপ খাবে না?- (চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ)।

৫। এই কবিতা তোমার মতো সহজ থাকুক সুশিক্ষিতা,/এর গায়ে থাক রাত্রি জাগার একটু না হয় ক্লান্তি হলুদ,-( শিল্পসহবাস)।

৬। হলুদ পাখিটা বুঝি সোনার পিণ্ড- (নিঃসন্দেহ গন্তব্য)।

৭। সবুজ দীঘির ঘন শিহরণ? হলুদ শটির বন? রমণীর রোদে/ দেয়া শাড়ি? তুমি কি দ্যাখোনি আমাদের/ আত্মাহুতি দানের যোগ্য কাল! তুমি কি পাওনি টের- অথবা আজও দুঃখ পেয়ে বলে, ভালো আছো হে দুরাশা, হে নীল আশা?-(উদিত দুঃখের দেশ)।

৮। আমি ভুলে গিয়েছিলাম রাজনীতি একটি কালো হরিণের নাম!- (ভ্রমণ যাত্র)।


পরিশেষে বলা যেতে পারে- বাংলা কবিতায় এভাবেই জীবনানন্দ দাশ, আহসান হাবীব, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ ও আবুল হাসান সহ অসংখ্য কবি তাদের কবিতায় রঙের ব্যবহার করেছেন অবলীলাক্রমে। যেখানে তাদের প্রেম-ভালোবাসা, আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন, হতাশা, দায়বোধ, সামাজিক, রাষ্ট্রিক, দেশপ্রেম ও প্রকৃতি বন্দনা ও জীবনের নানান অভিজ্ঞতাকে একইসূত্রে গেঁথে একাকার করেছেন কবিতায় রঙের মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমে। সেজন্য দেখা যায় যে, রঙ এমন এক অভিজ্ঞাত যা দূরপ্রসারী, যার প্রভাব ব্যক্তিগত, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক। রঙ বা বর্ণচেতনা আমাদের সমগ্র জীবন ও ভাবনাকে সমৃদ্ধ করে আসছে যুগে যুগে। রঙ এমনই বিচিত্র শক্তি যার অস্তিত্ব মনের অস্থায়ী সচেতনতা রূপে অগ্রসরমান। সেখানে নানান রঙের খেলা চলে অবিরাম। কখনো হলুদ, লাল ও নীল। এইসব রঙ ছাড়াও মানুষের মনের মধ্যে আরো বহুরূপী রঙের খেলা চলে। সেসব রঙের প্রকাশ বহুমাত্রিক। তাই দেখা যায় যে, রঙ কখনো কবিতায় অলঙ্করণ হয়ে ওঠছে, কখনো অস্তিত্বের প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। রঙের মাধ্যমে একজন কবি তার দৃষ্টির বৈভবকে জাগ্রত রেখে সচেতন ভাবেই তার দৃষ্টির প্রকাশময়তাকে সঞ্জীবিত করতে পারছেন বর্ণে, শব্দে, গন্ধে, রূপে, ঢংয়ে যতোটা সম্ভব। মানুষের মানসিকতার সাথে রঙের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। সেই সম্পর্ককে একজন কবি মূলত একজন চিত্রশিল্পীর ন্যায় তুলে ধরছেন তার নিজস্ব ক্যানভাসে। কবির সেই নিজস্ব ক্যানভাস হচ্ছে তার কবিতা। এভাবেই একজন কবি তার কবিতা ক্যানভাসকে ব্যক্তিগত দৃষ্টির প্রখরতা দিয়ে, যাপিত জীবনের সঞ্চিত রঙের অভিজ্ঞতা দিয়ে কবিতায় রঙ ব্যবহারের মার্জিত এবং পরিচ্ছন্ন রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন বা নতুন করে বারবার ফুটিয়ে তুলবেন এই আশা ব্যক্ত করা যায়। 


##


Post a Comment

0 Comments