অদিতি শিমুল
আমাদের দোষলাগা বাড়ি এবং পোর্সিলিনের চাঁদ
আমাদের বাড়িটায় প্রতিবছরই কোনও না-কোনও গাছ মরে যায় বলে বাবার হয়ে উঠেছিল গাছ রোপণের নেশা ও জেদ। আরেকদিকে বাস্তুসাপের সংসার বেড়ে-বেড়ে পুরো বাড়িটা হয় উঠেছিল শঙ্খচূড় বাড়ি। ছানাপোনায়ও বাড়াবাড়ি একইরকম। বাবার এককথা-"ভাঙ্গা বীজে যেমন গাছ হয়না- তেমনি তোমার বিশ্ব তুমিই ধরে রাখো"। দাদীমা বলতেন, "দোষলাগা বাড়ি"। তো, সে যাইহোক- বাড়ির শেষ মাথার দেয়াল ঘেষেই ডালপাতার ফাঁকে প্রতি শুক্লপক্ষে চাঁদ উঠতো। আর আমাকে টানতো গা-ছমছমে ঐ আলোর বল এতো রাতে!
কতো-রাতে আমি চুপিচুপি এসে দেখে গেছি দেয়ালের ঐপাশের পুকুরের পানিতে একটি চকচকে ভাঙ্গা চাঁদ পড়ে আছে! কতো যে ইচ্ছে হয়েছে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি জলের তলার বিষন্ন ঐ পোর্সিলিনের চাঁদ...!
ভাইয়াকে বললে বড়জোর চাঁদটাকে তুলে এনে ছুরি দিয়ে চেঁছে-কেটে আবার দেয়ালে বসিয়ে দেবে!
কাউকে বলতে পারিনি ওসবের কিছুমাত্র। কালপ্রেরিত বিজলী চমকালে কিংবা বৃষ্টিহীন বাজ পড়লেও আমরা কেউ চমকাতাম না এ বাড়িতে। মূলত;ধারাক্রমে আমাদের বিস্ময়বোধও তেমনই ছিল, যেন নৌকাভর্তি একঝাঁক বেড়ালছানা।
আমার অঙ্কের খাতা ভর্তি হয়ে যেত জমানো পালকে-জানালায় পাখিদের দেখেদেখে কেমন লোভী হয়ে উঠতাম!
ষড়ঋতু খানিকটা বুঝতে শিখেছিলাম ; তাই বোধহয় একটি ব্যক্তিগত ক্যালেন্ডার এর খুব শখ হলো একসময় -আর শখ ছিল জোনাকি সংগ্রহের! তো, সেইসময়ে একদিন আবিষ্কার করলাম, জোনাকিপোকারাও খুবই সন্ত্রস্ত ; এবং আলোর এই শরীর লুকাতে না-পারার অপরাধবোধ বয়ে বেড়ানোর এক অদ্ভুত ব্যামো ঘিরে থাকে তাদেরও...!
তুমি,আমি কোন ছার!
মনে পড়ে -জঙধরা আকন্দফুলে ভরে উঠেছিল দাদীমার ট্রাংকের কোণা-কুয়াশা কিংবা মেঘের কাছে আজও যে কাল'গুলো আমি ফেরত চেয়ে বসি! আমার পুরোনো পেতলের থালা।
হাসি পায়...! আমি কবে থেকে যেন আমার একেকটা দীর্ঘশ্বাস জমা করতে শুরু করেছি অই অন্ধ গ্যালারীতে।
বকুল আহমেদ
রক্তের জলে ন্যায্য অর্থ মেলে না।
জীবন আর জীবিকার জন্য অন্ধ আমরা;
অর্থের পায়ে চুমু খেয়ে
শিশুর শরীর ঝলশে দিই।
নজর রাখিনা মুখের দিকে,
মায়াময় হাসির দিকে।
নিরুপায় পরিবার; আর আমাদের উপায়গুলো বিলাসবহুল হোটেলে,
যেখানে নৃত্যোৎসব হয়-
টাকা উড়ে বাতাসে।
নীল জলে সুইমিংপুলে জল পরীদের খেলা দেখে- জলের দামে ভাসিয়ে দেয় টিকিটের মূল্য।
শ্রমের মূল্যহীনতায় ভুগি আর মুখ চুুলকাতে চুলকাতে চড়া দামে চাল কিনে বাড়ী ফিরি।
নারী চিন্তা করে চাল সিদ্ধ করার।
নারী চিন্তা করে নৃত্যোৎসবের,
টাকার উৎসবের।
নারী মাঠে, রাস্তাঘাটে-
রক্তের জলে ন্যায্য অর্থ মেলে না।
আত্নহুতিদের কন্ঠস্বর বিশ্বের শ্রমবাজারে ধ্বনিত হয়।
রাষ্ট্রনেতৃবৃন্দ আকাশের তাঁরা দেখে অভ্যস্ত -শিকাগো শহরের হে মার্কেটের আন্দোলন ভুলে গিয়ে হঠাৎ দিবসের বয়ান মেরে চলে যায় শরীরে মালিশ লাগাতে;
আর বলে যায়- মহান মে দিবস সফল হোক!
মুনিরা মেহেক
১.
একটা লাল ফড়িঙের পিছে তুমি যেন উড়ো
সন্ধ্যায় আমারও বাড়ি ফেরা হলো
কানে কানে চুড়ুই পাখি বলে যায় রুপকথা
তোমার আমার সময় যেন এলোমেলো
ছাদের রেলিঙ ধরে নেমে আসে কিছু মেঘ
শীতের ভাঁজ খুলে গায় এক রংধনু
মোমের আলোয় পড়া গেল পুরনো অসুখ
পাতায় পাতায় লেগে আছে ফুলের রেণু
আমার কথা তোমার মনে পড়ে খুব
আহত পিঁপড়ার কাছে এমন খবর পাই
ঝড়ের রাতে একজোড়া উদ্বাস্তু চোখ
প্রিয় ভোর আমার কোন তাড়া নাই
২.
অন্ধকারে হেটে হেটে পৌছে যাই দেয়ালের কাছে
মৃত সন্ধ্যায় আমার নিঃসঙ্গ বাহু উৎপেতে রয়
সবজি খেতগুলো তোমার চেনা
উদ্বাস্তু নিঃশ্বাস নিয়ে কোথায় পৌছাবো বলো
ফুলের গৃহ নাই কোন
তৎপর হাওয়ার পরশে উলটে পড়ছে কুড়া-মেঘগুলো
দরজায় সেই নিদান দাড়ায় হেসে
আমার অসুস্থ্য চোখে তুমি ডুবে মরছো কেন
.
দালান জাহান
সোনালি ভাত
আমি আমার কষ্টগুলো পড়ি
রৌদ্র ছায়ার ভেতরে
পুড়ে কালো হওয়া নিষ্পাপ শিশুর মতো
অতঃপর ভেঙে দেই ভিত্তি
লোহার শক্ত খুঁটিগুলি
যেভাবে ভেঙে দেওয়া যায়
সমুদ্র তীরে আঁকা বালিঘর।
আমি আমার দুঃখগুলো শিখি
পড়ন্ত বৃষ্টি ধরে মাটিতে গড়াগড়ি দেওয়া
অবাধ্য কিশোরের মতো এবং সেই গান গাই
যে গান না গাওয়ার জন্য
আমার সামনে থেকে কেড়ে নেওয়া হয়
সোনালি ভাতের থালা।।
ভালোবাসাও একটি পলিথিনের বাজার
যে ফোন নাম্বারটি বিবেক নামে সেভ করে রেখেছিলাম বছরের পর বছর
তাকে একদিন কথা দিয়েছিলাম
সুযোগ হলে একদিন ভুলে যাব তোমায়।
যার একটি কলের অপেক্ষায়
গাড়ির পথ রিকশায় যেতাম
অপেক্ষার তেঁতুল নিয়ে
চেয়ে থাকতাম ফোনের স্ক্রিনে
সেই নাম্বারটি আজ ডিলিট করে দিলাম
হয় তো এরপর আর কথা হবে না
মাঝরাতে ফোন করে
আর কেউ শোনাবে না নিঃশব্দ নিঃশ্বাস
বেঈমান মানুষগুলোর নীরবতা নিয়ে
কেউ জানাবে না অসহ্য অতীত
কেউ বলবে না আর তোমার কাছে
ভালোবাসাও একটি পলিথিনের বাজার।
ভাঙন
তিন প্রহরের যন্ত্রণা নিয়ে
একদিন নদী কেঁদে ছিলো
আজ নদীর কান্না বৈধ হয়েছে
গায়ে কথার গন্ধ লাগায়
যে মানুষটি একদা স্নান করে পবিত্র হয়েছিলো
আজ তার মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়
গন্ধে ভরা নর্দমার ড্রেন।
পবিত্র ও সুন্দরের বুক চিড়ে
এখন আকাশে ওঠে যাচ্ছে
কালো-কালো মহিষের মেরুদণ্ড।
হেরে গিয়ে কেবলই চিৎকার করে
চারটি সাদা খরগোশ
আদত ভাঙন শুরু হয়েছে নিয়ম ভাঙতেই।
মিসির হাছনাইন
লতা ফুল
আমার উঠানের মিষ্টি কুমড়ো লতা
মাটি বেয়ে বেয়ে ঘরে উঠতে চায়।
আমি দেখি- শক্ত করে আগলে ধরা
শিকড়, কেমন_মাটি বেয়ে বেয়ে উঠে আসে ঘরে
চেয়েছিলাম মেয়েটাকে খুব আদরে
বুকের উপর শক্ত করে ধরে রাখি,
ভালোবেসে__হৃদয়ে বেড়ে ওঠা লতায় ফুটেছে ফুল
যেন, শাড়ি পড়া বউ মিষ্টি গন্ধে হাসি হাসি চোখ
রাতদিন দাঁড়িয়ে থাকা গাছ দেখি দেখি_
রাতদুপুরে পাখি ডাকা শরীর বেড়ে ওঠে
বাংলার কালো ভ্রমর ফাল্গুনে গুনগুন ডাকি
মন চায়__ঘরের লতা ফুলটা কাঁচা খেয়ে ফেলি।
.
ভূতের মাংস
বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে বহুকালের পুরনো তালগাছে সাদা কাফনে একটা বাংলা ভূত, কত অদ্ভুত বলছে_ 'বাড়িত যা, গিয়া- সিং, জাগুর, টাকি, সইল, বোয়াল, ইচা_বৈচা, গুলা_ মূলা দিয়া ভাত খা!'
_আমাকে এক কেজি ভূতের মাংস দিন, একদিনের তিন বেলায় স_কালের পান্তায়_খাবো।
হাবিবুল ইসলাম তোতা
নিজেকে চিনুন
আলোর জোনাকিদের বলছি !
আগে নিজেকে চিনুন ।
জ্ঞানেন্দ্রিয় চোখ, নাক, জিহ্ব,ত্বক,
কমেন্দ্রিয় হাত, পা জিহ্বা, মূত্রাশয়, মলদ্বার ,
প্রাণচাঞ্চাল্য প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান, উদান ,
অন্তঃকরণ মর, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার,
সুন্দর চিবুক, হাত ও পায়ের পাতা-আঙুল ,
মস্তিস্করে উপরভাগে হাড় ও চামড়ার আবরণ-
তার ওপরে সিল্কি চুলের বণঢ্য বুনোট ,
কন্ঠসর ও নাসিকাপথ, মুখমন্ডল,
চামড়ার আচ্ছাদনের নিছে মাংসপেশি দিয়ে গড়া
বহুল সুঠম দেহ,
দুইশত ছয়টি হাড়ের খুঁটিদ্বরা নিমান এ দেহটি !
আপনার নিমাণে সবক্ষণ নিমাতা বিদ্যমান ।
3 Comments
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি
ReplyDeleteপড়তে পড়তে প্রতিটি কবিতায় ডুবে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কবিতার কথাগুলো একান্তই নিজের ভেতরে আলাদা সুর তুলেছে। যা কি না যে কোন পাঠককেই মুগ্ধতা দিবে।
ReplyDeleteপড়তে পড়তে প্রতিটি কবিতায় ডুবে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কবিতার কথাগুলো একান্তই নিজের ভেতরে আলাদা সুর তুলেছে। যা কি না যে কোন পাঠককেই মুগ্ধতা দিবে।
ReplyDelete