জীবনের পথে পথে পা পিছলে ঘাটে ঘাটে হোঁচট খেয়ে টেনে-হিঁচড়ে যাদের জীবন চলে কবে কখন জানি আমি ভীড়ে গেছি তাদেরই দলে। তবে পলায়নপরতা নয়- জীবনের কুরুক্ষেত্রে অস্ত্র ছাড়াই দশভূজা আমি টালমাটাল পায়ে হলেও সম্মুখগামী। জীবনকে আমি এখন দেখি সমৃদ্ধ নগরীর রাজপথে বিচরিত লাওয়ারিশ কুকুরটার মতো যার জীবনের প্রতিটা ক্ষণ কাটে কেবলই বর্তমানের চাহিদায়_ এঁটো, ঝুটা ও মনুষ্যপুরিষই যার মোক্ষ।
ব্যক্তিত্বের মরণ, স্বাধীনতা দলন, প্রেমীষা দমন, দেহ-মনের অন্তর্গত রসলীলা প্রশমন_ আমার কাছে বিবাহের অর্থ এমন। তবু আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি কারণ এই ভণ্ড সমাজব্যবস্থায় ভণ্ডামীর আচ্ছাদন ছাড়া ‘আব্রু’ নিয়ে বেঁচে থাকা যে কতটা অসম্ভব গত দুই বছরে আমি তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।
দু’বছর আগে যেদিন স্বামীর ঘর থেকে জীবনটাকে হাতে নিয়ে কোনমতে এক কাপড়ে পালিয়ে আসি সেদিন আমি ঘুনাক্ষরেও ভাবিনি যে এই সমাজে টিকে থাকার প্রয়োজনে আমাকে একদিন ঐ একই লিঙ্গধারী আরেকটা প্রাণীর লাঙ্গুলে বাঁধা পড়ার উদগ্র আকাক্সক্ষায় নয় কোটির ভীড়ে খড়ের গাঁদায় সুই খুঁজবার দুরূহ সাধনাটা করতে হবে।
সেই সাধনার পথ ধরেই আমি হাজির হলাম এক প্রাসোদোপম বাড়ির গেটে। উর্দিপরা দৌবারিকের পাশে চেনে বাঁধা একটা অ্যালসেশিয়ান বিরক্তিভরা চোখে আমার দিকে একনজর চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
এই বাড়ির মালিকের সাথে আমার এপয়েন্টমেন্ট আছে। আমি দৌবারিককে বললাম।
কয়টায়?
চারটায়। এখন চারটে বাজতে মাত্র এক মিনিট বাকি।
ঠিকাছে। আপনে এহানে খাড়ান।
দারোয়ান ভেতরে চলে গেলো। তবে যাবার আগে গেট বন্ধ করে যেতে ভুললো না। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম গেটের বাইরে। অভাজন এক বৌগিরির উমেদার।
ড্রইংরুমটা দেখতে খুব ফিটফাট এবং বেশি রকম পরিচ্ছন্ন। ওনাদের অতি পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস আছে সেটা জেনেই আমি এসেছি। আমিও পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করি। সেটা এমন পর্যায়ে যে আমার বিভিন্ন নিকটজনেরা এটাকে শুঁচিবায়ু বলে উপহাসও করে থাকে। কিন্তু আজ এই বাড়ির সাংঘাতিকরকম পরিচ্ছন্নতার আবহাওয়া আমার মনেও কেমন হীনম্মন্যতাবোধ ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি ড্রয়িংরুমের এক সোফায় বসে আছি বড়ই জড়সড়ভাবেÑ যেন একটু আয়েশ করে ছড়িয়ে বসলে, একটুখানি হেলান দিলে ভয়াবহ বেয়াদবি হয়ে যাবে।
এ কী! তুমি পা ধুয়ে না এসেই কার্পেটে পা রেখে বসে আছো? আমি চমকে তাকালাম। মধ্যবয়সী, মধ্যমদর্শন, পরচুলা পরিহিত এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে আমার আপাদমস্তক নীরিক্ষণ করতে করতে বললেন।
আর একি ড্রেস পরে এসেছো? এরকম পোশাকে কেউ কারো বাড়ি যায়?
ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর বড়ই মসৃণ ও শীতল। আমার পরিধানের লিলেন থ্রিপিসটি বাইরের ৩৮ ডিগ্রী উষ্ণতায় কিছুটা আরামদায়ক হবে ভেবে পরিহিত হয়েছিলো। কিন্তু এখন এটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেও আমার দেহে দাহ সঞ্চার করতে লাগলো।
তুমি এখনো আমাকে সালাম জানাওনি কিন্তু। ভদ্রলোক বিপরীতদিকের সোফায় বসতে বসতে বললেন।
প্রায় অবশ দেহটাকে বহুচেষ্টায় টেনে তুলে রোবটের মতো করে একটা সেলাম ঠুকলাম।
তোমার কথা শুনে ভেবেছিলাম যে তুমি বেশ সুন্দর হবে দেখতে।
শুধু কথা শুনে মানুষের সৌন্দর্য সম্পর্কে ধারণা করা যায়? এতক্ষণে আমি মুখ খুললাম।
আমি করতে পারি বলে ভাবতাম। সাধারণতঃ যাদের কণ্ঠস্বর মধুর তারা দেখতেও মিষ্টি হয়।
ভুল ধারণা। কন্ঠশিল্পীদের মধ্যে ক’জন রূপবান মানুষ আছেন?
রূপবান কম থাকলেও রূপবতী অনেক আছে। তুমি ম্যাডোনা-সারিকাদের দ্যাখোনি?
মৌনতাকে হিরন্ময় জ্ঞান করলাম।
একজন বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। কাকে যেন চাপা গলায় ধমকাচ্ছেন। খানিক পরে বোধহয় তিনিই এসে এ ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রলোক তার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমার মা।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার কণ্ঠে তাকে সালাম জানালাম। তার দিকে একটা সুদৃশ্য কাপড়ের থলে বাড়িয়ে ধরলাম।
এতে আবার কী আছে?
জি¦ তেমন কিছু না। কিছু চকলেট, চিপস আর ফলমূ_ বাবুর জন্য।
বাবু কিছু খাইলে তো! হারাদিন তো খেলা লইয়াই ব্যস্ত।
মা, আপনি এর সাথে একটু কথা বলেন। আমি আসছি। ল্যাপটপটা চালু রয়েছে।
ভদ্রলোক ভেতরে গেলেন।
তুমার নাম কী?
শিরিন আকতার।
বাপের নাম কী?
মোঃ ফোরকান হোসেন।
কী বংশ? নাম শুন্যা তো বংশ বোঝা যাইতাছে না।
জি¦, মণ্ডল। আমার দাদার নাম মোঃ লোকমান হোসেন মণ্ডল।
অঃ, মণ্ডল। তা নামের থিকা বংশ-গোত্তরের নিশানা মুছে ফেলা কোন কামে? বংশ ছাড়া মানুষ চিনা যায়?
‘বরং মানুষ দিয়েই বংশ চেনা যায়’, বললাম মনে মনে।
আমরা তালুকদার। আমার বাপেরা চৌধুরী।
মৌনী রইলাম।
আমার বৌমার বাপেরা হলো সৈয়দ।
ওনার কী হয়েছিলো?
তেমুন কিছু না। বিয়ার সুম থিকাই তার শইলডা ভালা আছিল না। অসুখ-বিসুখ লাইগ্যাই থাকতো। মরার পর ডাকতার সাট্টিফিকিট দিছে, হাট এটাক।
ওহ্।
কথা খুঁজে না পেয়ে আমি বিষণ্ন মনে চুপচাপ বসে থাকি। জানি আমার মনের বিষণ্নতা মুখেও উঁকি দেয় এবং সেটা মোটেই সুদৃশ্য কিছু নয়। এ বাড়িতে আমার আগমনের যে উদ্দেশ্য তা হাসিল হতে হলে মুখটাকে কালবোশেখের ঈষাণ গগন করে রাখা চলে না। কিন্তু সাক্ষাৎকারের সূচনাতেই যখন অযোগ্যতা পষ্ট হয়ে গেছে তখন আর কষ্ট করে মেকি ভদ্রতার হাসিমাখা সাইনবোর্ড মুখে ঝুলিয়ে রাখা কেন!
লোকটি ফিরে এসেছে।
মা, বলেন তো একে কেন আমার চেনা মনে হচ্ছে? আমাদের পরিচিত কার সাথে এর চেহারার মিল আছে?
কই, আমার তো তেমুন মনে অইতেছে না। আমার বাপের, তোমার বাপের বংশের সগলেই সোন্দর। এ মাইয়ার রং তো ময়লা।
দাঁড়ান, মনে পড়েছে। আমাদের গলাচিপার বাড়িতে যে এক বারোমেসে মুনিষ ছিল, কী যেন নাম...... লেদু, হ্যা, লেদুর বৌটা ছিলো ঠিক এমন। লেদু একবার আমাদের বাড়িতে বেশ বড়রকম একটা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে......
আমি এখন আসি। আমি উঠে দাঁড়াই।
খাড়াও, এক কাপ চা খাইয়া যাও। আমাগো বাড়ির থিকা কেউ খালিমুহে ফেরে না।
না, না... আমার দেরি হয়ে যাবে। আমাকে এখনই ফিরতে হবে।
চা করতে দেরি অইবে না। আমগো বাসায় চায়ের পানি চুলায় চাপানেই থাহে। তিনজন কামের মাতারি হারাদিন খালি চা খায়। তুমি বহ, আমি দেহি।
মহিলা উঠে যায়। আমি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াই। অমনি লোকটা বলে, তুমি ফিরবে কিসে?
যা পাই। বাস, ট্যাক্সি, সিএনজি...
মানে বাসই ফার্স্ট প্রায়োরিটি?
জি¦, সন্ধ্যের পর এ শহরে বাসই বরং কিছু নিরাপদ।
তাই নাকি? বাসে পুরুষেরা তোমার শরীর... অবশ্য তোমাকে দেখে বোঝা যায় যে তাতে তোমার কিছু যায় আসে না, কী বলো?
আপনি এসব কী বলছেন? আমি কিছুটা চিৎকার করে উঠি। খুব জোরে পারি না। শ^াপদের গুহায় ঢুকে থেকে প্রতিবাদের স্বর শক্তিশালী হতে ভরসা পায় না।
কেন, ভুল কিছু বলেছি? লোয়ার মিডল ক্লাস ফ্যামিলি, ডিভোর্সী, একা থাকা, সেলসে চাকরি, ক্লায়েন্টের কমিশন খাওয়া, বাসে চড়ে বেড়ানো মেয়ে; কোন সাহসে এসে এ বাড়ি চড়াও হলে বলো তো?
আপনি আমাকে আসতে বলেছিলেন।
তা বলেছিলাম। কে জানতো তোমার এই চেহারা আর এই সৌজন্যবোধ! কারো বাড়ি যেতে হলে যে সেই পরিবারের জন্য তাদের সম্মানের মাপে উপঢৌকন নিয়ে যেতে হয় তাও তুমি জানো না। আমরা কোথাও যেতে হলে গাড়ি ভরে উপহার ও খাবার নিয়ে যাই।
আমার মুখে কথা সরে না। এ বাড়ি আসার আগে আমি মীনাবাজার থেকে এক ঘন্টা সময় নিয়ে বহু ভেবে-চিন্তে ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চ করে যে টাকার বাজার করেছি তার বিল মেটাতে আগামী মাসে আমার বেশ কিছু দরকারি ব্যয়ের বাজেটে কাঁচি চালাতে হবে।
তুমি এখন যেতে পারো। হয়তো এই রাতে তোমার আবার কোন ক্লায়েন্টের সাথে দেখা করতে হবে। তবে এই চেহারা নিয়ে আমার মতো ধনী লোকের বৌ হওয়ার স্বপ্ন পুষো না। কে জানে, আর কোন ধনী মানুষ হয়তো আমার চেয়েও বেশি বিরক্ত হবে।
মাথা বনবন। হাত-পা ঝিমঝিম। গলা শুকিয়ে কাঠ। টলতে টলতে কোনমতে বেরিয়ে পড়ি। কিভাবে কোন বাহনে চেপে যে ঘরে ফিরি তা নিজেও জানি না।
পরদিন।
মিহিম, আমার সাথে তোকে এখন একটা জায়গায় যেতে হবে।
কোথায়?
গুলশান দুইয়ের একটা বাড়িতে।
কেন?
সে আমি তোকে পরে বলবো। প্লিজ, না করিস না। খুব জরুরী।
মুশকিলে ফেললি। এখন তোর সাথে গুলশান গেলে ফিরতে ফিরতে কটা বাজে তার তো ঠিক নেই। ফার্মগেট পেরুতেই তো বেজে যাবে বেলা তেরোটা। নাহ্, ফিরে আর অফিস পাওয়া যাবে না।
না হয় নাই পেলি। আজ ছুটি নে।
ইস্! বস যেনো আমার বয়ফ্রেন্ড লাগে! ঐ তো হাঁড়িপানা মুখ! কে যাবে ওর কাছে এই হঠাৎ ছুটির বায়না নিয়ে?
প্লিজ মিহিম... আমি খুব সমস্যায় পড়ে তোকে...
আচ্ছা, দাঁড়া। বিশ^াস স্যার মনে হয় চেম্বারেই আছে। দেখি হাফ ডে ম্যানেজ করে দিতে পারে কিনা। এই লোক আবার সারে জাহান অবিশ^াস করলেও আমাকে খুব বিশ^াস করে। একটু ইয়েও করে মনে হয়, বুঝলি?
আড়াই ঘন্টা পর আমি আর মিহিম গুলশান দুইয়ের আগাপাশতলা চষে ফিরি। কিন্তু কালকের সেই বাড়িটা চিনতে পারি না।
তুই কেন মরতে একা একা বর খুঁজতে আসছিলি বল তো? আমাকে সাথে করে আনলে আমি কি তোর বর ভাগিয়ে নিতাম? কাল তো দিব্যি একা গটগটিয়ে ঘুরে গেছো, আর আজ চিনতে পারছো না?
সত্যি বলছি মিহিম, লোকটা যে ঠিকানা দিয়েছিল তা খুব সোজা। সে ঠিকানা খুঁজে পেতে আমার কাল একটুও বেগ পেতে হয়নি।
আমার কথায় মিহিম বিরক্ত হয়ে বলে, আজ কি তবে চেরাগের দৈত্য এসে সে বাড়ি তুলে নিয়ে গেলো?
আমি বিহ্বল বোধ করি। সত্যিই তো। অতবড় একটা বাড়ি তো গায়েব হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু ঠিকানা যা আমার মনে আছে, নোটবুকেও টোকা ছিল, তাতে যে জায়গাতে বাড়িটা থাকার কথা সেখানে একটা অখ্যাত কোম্পানীর গেটবন্ধ ডিপো দেখতে পাচ্ছি। আশেপাশে নানা দোকানপাট। কোথায় সেই প্রাসাদতুল্য বাড়ি, উর্দিপরা দৌবারিক আর চেনে বাঁধা অ্যালসেশিয়ান? নিজের স্মরণশক্তির উপর আমার প্রবল আস্থা। আমি জানি আমি ঠিকানা ভুল করছি না। তবু মিহিমকে একটু দেখাবার ইচ্ছেয় ভ্যানিটি ব্যাগে নোটবুকটা খুঁজি। আশ্চর্য! ব্যাগের ঢাউস সাইজের পেট, ছোটবড় মিলিয়ে গোটা সাতেক পকেট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নোটবুকটা পাই না। আয়না, চিরুনি, লিপিস্টিক, ছোট্ট মেকাপ বক্স, দশদিন আগের বাজারের লিস্ট, অফিসিয়াল নানা দরকারি-বেদরকারি কাগজ সব আছে কিন্তু নোটবুকটা নেই!
চল, ফিরে যাই। মিহিম গম্ভীর স্বরে বলে।
বিশ্বাস কর...
অবিশ্বাস তো করছি নে। আমার মনে হয় তুই একা এলে আজো বাড়িটা খুঁজে পেতি।
মানে?
মানে সোজা, তোর মন আমাকে ঐ বাড়িতে নেয়ার ব্যাপারে দ্বিধায় ভুগছে।
কেন?
সে তুই জানিস। আমার কাছে যদি জানতে চাস তো বলবো তুই আমাকে ঠিক বিশ্বাস করিস না। যতই তোর বুজুম ফ্রেন্ড হই তুই মনে মনে আমাকে ভাবিস পুরুষধরা।
কী আবোলতাবোল বকছিস? কোন দুঃখে আমি আজ তোকে এখানে ধরে এনেছি তা জানিস? আমি যা পারিনি, যা পারি না, তুই অন্ততঃ তাই করবি। অহঙ্কারী, ছোটলোক ধনীটাকে তার অবস্থান বুঝিয়ে দিবি। বদমায়েশটা কাল আমাকে যাচ্ছেতাই বলে অপদস্থ করেছে।
সে কী! বর দেখতে এসে ঝগড়া হয়ে গেলো? বিয়ে না হতেই দাম্পত্যে উত্তীর্ণ?
তামাসা করিস না।
তামাসা যা করার তাতো তোরা করে বসে আছিস। এ যুগেও এমন বোকা কেউ আছে যারা ভিডিও কলে নিজেদের না দেখে সরাসরি দেখা করার জন্য নিজের বাড়ির ঠিকানা দেয় আর সেই ঠিকানায় সত্যিই কেউ চলে আসে!
আসলে খবরের কাগজে শুধু একটা মোবাইল নম্বর ছিল আর আমি তাতে ফোন দিতেই সে কয়েকদিন এটাসেটা কথা বলে একদিন দুম করে প্রস্তাব করলো সরাসরি দেখা করার জন্য।
আর অমনি তুমি একা লেজ তুলে ছুটে এলে! একবারো ভাবলে না যে তুমি কোন বড় বিপদেও পড়তে পারো! তোর ভাগ্যি যে লোকটা তোকে শুধু কয়টা অপমানজনক কথা বলেছে। আরো কত কী তো ঘটতে পারতো।
মিহিমের কথার পৃষ্টে বলার মতো কোন কথা আমার মুখে যোগায় না। সত্যিই তো, অনেক কিছু হতে পারতো। কিন্তু সেই অনেক কিছু না হয়ে যা হয়েছে তা আমার কাছে অদ্ভূত ঠেকেছে বলেই আজ মিহিমকে নিয়ে আসা। যে লোকটা ফোনে কদিন ধরে মধুর স্বরে কথা বলে তার দ্বিতীয় বিবাহের আগ্রহ, পছন্দ-অপছন্দ এমনকি সন্তানের ভালো-মন্দ নিয়েও কথা বলেছে সে কী করে পারে আমাকে দেখা মাত্রই অতটা তাচ্ছিল্য করতে? আমি কি ভিখিরি যে আমাকে অমন.......
শুনে মিহিম বলে, ভিখারি তো বটেই। তুই হলি গিয়ে বিবাহভিখারি। একা থাকতে থাকতে, জীবনে সব কষ্টের সাথে যুদ্ধ করতে করতে তুই মরীয়া হয়ে উঠেছিস। মধ্যবিত্ত পরিবারের আদুরে মেয়ে, কষ্ট করার অভ্যাস তো আগে ছিল না। এদিকে আবার উচ্চাভিলাষী। ভালো ঘর চাই, ভালো বর চাই। আর এপার্টমেন্ট বেচার চাকরি করতে যেয়ে দেশে ভালো ঘর-বরের ছড়াছড়ি দেখতে পেয়েছিস। আর অমনি তোর মনে হয়েছে যে ভালো ঘর-বর চাইলেই মেলে, না?
তুই তো ঐ লোকটার চেয়েও কঠিন কথা বলছিস রে।
বলছি কারণ আমিও তোর মতো একজন। রোজ সকালে মুখে কনসিলার লাগানোর সময় আয়নায় নিজেকে দেখে মনে হয়, সেদিন আর দূরে নয়, এক ডালিমকুমার পক্সক্ষীরাজে চড়ে এসে ঠিক আমাকে তুলে নেবে। তারপর তার বুকের কাছে চেপে ধরে উড়াল দিয়ে নিয়ে যাবে রাজপুরীতে। সেখানে আমাকে বরণের জন্য কত বাদ্য-বাজনা...। আমরা মেয়েরা বড্ড বিড়ালস্বভাবী প্রাণী, বুঝলি?
তা আমাকে কী করতে বলিস? জীবনভর এই ফ্ল্যাট বিক্রির চেষ্টায় বড়চাকুরে আর মাঝারি ব্যবসায়ীদের অফিসে অফিসে ঘুরে মরবো?
তা না পারলে কারো গলায় ঝুলে তো পড়তেই হবে। কিন্তু উচ্চাভিলাষ কমাতে হবে।
মানে ফের সেই নুন আনতে পান্তা ফুরোয় জীবন? ওসব চাল নিয়ে চুলোচুলি, ডাল কিনতে ডলাডলির জীবন আমি সাত বছর ধরে ভোগ করেছি, আর পারবো না। তার চেয়ে বরং এভাবেই থাকবো।
তাই থাক। খামোখা এই সব বড়লোকদের দুয়ারে ধর্না দিচ্ছিস কেন?
খামোখা?
নয়? প্রেমের ফাঁদে না আটকালে কোন ধনী পুরুষ শুধু মুখ দেখে কোন গরীব মেয়েকে বৌ করে ঘরে তোলে? বিয়ের বাজারে চিরকালই একটা আর্থসামাজিক হিসাব-নিকাশ কাজ করে, তা জানিস না?
আমার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। মিহিমের কথার পৃষ্ঠে কথা খুঁজে না পেয়ে আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে শেষে ওকে তাড়া দেই, বাড়িটা তো আমরা খুঁজে পেলাম না। তাহলে আর এখানে সময় নষ্ট করে কী হবে? চল ফিরে যাই।
হ্যা, তাই চল। আমার কী মনে হয় জানিস, বাড়িটা তুই আসলে খুঁজে পেতে চাইছিস না।
কী বলিস! কেন চাইবো না?
কারণ ওরকম কিছু আসলে ঘটেনি।
কী ঘটেনি?
কাল সন্ধ্যায় তুই কারো বউগিরির উমেদার হয়ে এখানে আসিসনি। কেউ তোকে অপমানও করেনি।
মানে?
মানে তুই এটা কল্পনা করেছিস। এমন কল্পনা তুই প্রায়ই করিস। এই তো কয়েকমাস আগের কথা_ তুই একদিন বললি যে তোর বাসার উল্টো দিকের বাড়ির ফ্ল্যাটের এক লোক তোকে লুঙ্গি তুলে ইয়াবড় একটা......দেখাইছে। তারপর আমি খোঁজখবর করতে যেয়ে কী শুনলাম? _ ঐ বাসায় কোন পুরুষমানুষই নেই। এক ইটালিপ্রবাসীর স্ত্রী তিন মেয়ে আর শাশুড়ি নিয়ে বাস করে।
আমি ভুল দেখিনি। ওরা মিথ্যা বলেছে। ওদের বাসায় কোন পুরুষ না থাকলেও কেউ হয়তো আসে_ আত্মীয়-বন্ধু যেকোন পুরুষ। এমন হতে পারে না?
পারে। কিন্তু আরো তো আছে। একদিন যে তুই বললি এপার্টমেন্টের দরদামের সিটিং দিতে যেয়ে কোন অফিসের কোন বস নাকি তোকে... পরে কী হলো দেখ, তোকে মামলা করতে জোর করে থানায় নিয়ে গেলাম, তুই সে অফিসের নামটাই দিতে পারলি না। খামোখা আমাকে ইন্সপেক্টরের ধমক খেতে হলো।
অফিসের নামটা আমি ভুলে গেছিলাম। কী করে মনে থাকবেÑ আমি তো আর তার অফিসে সিটিং দেইনি। তার এক বন্ধুর রেস্টুরেন্টে... বলেছিল, ওখানে সে আর তার বন্ধু দুজন মিলে প্ল্যানটা দেখবে...
তা সেই রেস্টুরেন্টের নামটাই বলতিস।
রেস্টুরেন্টের নাম তো ভুয়া। আমাকে বলা হয়েছিল ওটা বাটা সিগন্যালের ওখানে। বাস থেকে বাটা সিগন্যালে নেমে খোঁজাখুঁজি করছি, এমন সময় লোকটা আমাকে ডেকে নিয়ে গেল এ গলি সে গলির ভেতর দিয়ে এক দালানের মাথায়। আমি ভাবলাম, রুফটপ রেস্টুরেন্ট। পরে দেখি একটা অফিসঘর মতন, তাতে কয়টা চেয়ার-টেবিল-সোফা। তারপর সেখানে......
হুম, তুমি পরে সে জায়গাটা আর চিনতেই পারলে না! তোর এই গল্প আমি বিশ্বাস করলেও পুলিশ যে করে না তাতো দেখলিই।
পুলিশ বিশ্বাস না করলেই তো আর ঘটনা নাই হয়ে গেল না। কত ঘটনাই তো পুলিশ বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করলেও মামলা নিতে চায় না। আবার কত গল্প পুলিশ নিজেরাই তৈরি করে। উপরের নির্দেশে গল্প বানায়। আবার নিজেদের দরকারেও গল্প সাজায়। আমার যে চাচাতো ভাইটা কাস্টোডিতেই মারা গেল, সে নাকি জুতোর ফিতে গলায় বেঁধে আত্মহত্যা করেছিল। কী হাসিখুশি উচ্ছ্বল স্বভাবের টগবগে যুবক! বিয়ে ঠিক হয়েছিল পছন্দের মেয়ের সাথে। আর একমাস পরই বিয়ে। সে নাকি আত্মহত্যা করলো অস্ত্রমামলার তোপে! আবার ধর আমাদের গ্রামের জবেদ আলী ডাকুর কথা। পূর্ববাংলা কম্যুনিস্ট পার্টির কুখ্যাত নেতা। সে মরলো ক্রসফায়ারে। পুলিশ তারে সাঙ্গপাঙ্গসহ জীবিত ধরলো। দিন পনেরো জিইয়ে রাখলো। রিমান্ডে নিলো। তারপর কী হলো ওরা তারে নিয়ে বেরুলো অস্ত্র উদ্ধার করতে। ব্যাস, সেখানে আগের থেকে ওঁৎ পেথে থাকা তার বাহিনীর লোকেরা নাকি গুলি ছুঁড়লো। আর সেই গুলিতে পুলিশের কারোর গায়ে আঁচড় না পড়লেও গুলি খেয়ে মরলো জবেদ আলী ডাকু।
জানি। এসব গল্প সারা দেশবাসী জানে। দেশবাসী মনে হয় ব্যাপারটা সাপোর্টও করে। আসলে যারা এভাবে মরে তারা তো আর কেউ দুধে ধোয়া তুলশীপাতা নয়।
দুধে ধোয়া তুলশীপাতা জগতে কে? যারা মারে, যারা মারার আদেশ দেয়, তারা নিষ্পাপ?
তা না। কিন্তু ওসব আলোচনা করে আমাদের কী ফায়দা? দেশে কিছু গুণ্ডা-বদমাশ মরলে বরং আমাদের স্বস্তিবোধ হয়। যদিও তাতে আমাদের উপকারটা কী হয় তা আমরা নিজেরাই জানি না। গুণ্ডা তৈরির মেশিন বন্ধ না হলে অমন দুই-চারটে ঝরিয়ে যে লাভ নেই তা তো সবাই জানিই।
তাহলে?
ওসব আলোচনা বাদ দে, শিরিন। তোর সমস্যাটা বল। কেন তুই এমন সব ঘটনায় পড়িস যা আমরা কেউ খুঁজে পাই না?
আমি তা জানি না, মিহিম। আসলে কোথায় যেন একটা গ্যাপ থাকে। যা কিছু ঘটে তা যেন কেবল আমার সাথেই ঘটে।
মিহিম একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে কেমন সন্দেহের চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, চল, ফেরা যাক।
দুঃসহ জ্যামে আটকে, গরুর গাড়ির চেয়েও ধীর গতিতে চলা বাসে করে ফিরতে ফিরতে রাত নামে। মনে পড়ে দুদিন হলো ঘরে কাঁচা বাজার নেই। আজ কিছু না কিনলে কাল শুধু নুনভাত খেতে হবে। কৃষি মার্কেট থেকে বাজার করে পলিথিনের ব্যাগগুলো হাতে ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকি। মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। অথচ আজ টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় এ পথ যেন আর ফুরোবে না। যেন কত যুগ পর আমি আমার উদ্দিষ্ট ছয়তলা বাড়িটাকে খুঁজে পাই। তারও কত পরে তার চিলেকোঠায় একরুম, এক বাথ, এক চিলতে কিচেনময় ঠাঁইটার দরজায় দাঁড়িয়ে জোরে কয়েকটা শ^াস ছাড়ি ও গ্রহন করি। একটু ধাতস্থ হয়ে ব্যাগ হাতড়ে চাবি খুঁজতে যেয়ে প্রথমেই হাতে ঠেকে নোটবুকটা। আশ্চর্য! তখন এটাকে অত আঁতিপাতি করে খুঁজেও পেলাম না!
ঘরে ঢুকে বাজারের ব্যাগগুলোকে কোনমতে এক কোনায় ফেলে রেখে বিছানায় এলিয়ে পড়ি। সারাদিনের ঘাম জবজবে পোষাক, ধুলোবালি মলিন শরীর, অভুক্ত পেট- কিছুই আর আমাকে দিয়ে তাদের চাহিদা মেটাতে পারে না। শুধু চরম অবসন্নতার অনুগামী নিদ্রা আমাকে টেনে নেয় তার জঠরে_ যে জঠর হতে আমি নতুন জন্ম লাভ করি, প্রতিটি সকালে।
1 Comments
অসাধারণ একটা গল্প পড়লাম। বর্ণনার ধরণ চমৎকার। সবকিছু যেন চোখে দেখছিলাম। সমাপ্তিটা কালজয়ী ছোটগল্পগুলোর মত- "ঘরে ঢুকে বাজারের ব্যাগগুলোকে কোনমতে এক কোনায় ফেলে রেখে বিছানায় এলিয়ে পড়ি। সারাদিনের ঘাম জবজবে পোষাক, ধুলোবালি মলিন শরীর, অভুক্ত পেট- কিছুই আর আমাকে দিয়ে তাদের চাহিদা মেটাতে পারে না। শুধু চরম অবসন্নতার অনুগামী নিদ্রা আমাকে টেনে নেয় তার জঠরে_ যে জঠর হতে আমি নতুন জন্ম লাভ করি, প্রতিটি সকালে। "
ReplyDelete