চুপ! চুপ চলে আসে আমাদের সবার নিকটে। আবিষ্কৃত সকল আগুন-চুপ! আবিষ্কৃত সকল আকাশ-চুপ! আবিষ্কৃত সকল উড়াল-চুপ! কারা কথা বলে, যদি তারা নদী; নদী হত্যা হয়ে যায়। কারা কথা বলে, যদি তারা পাহাড়; পাহাড় হত্যা হয়ে যায়। কারা কথা বলে, যদি তারা বাঁশি; বাঁশি হত্যা হয়ে যায়। চুপ তো বেরিয়ে এসেছে রাজনীতি থেকে। বেরিয়ে এসে সে দাঁড়িয়েছে আমাদের বের হবার সকল পথে। যখন আমরা বই হাতে বিদ্যালয়ের পথে, দাঁড়িয়েছে সে, সে পথে; যখন আমরা গোলাপ নিয়ে সংসারের পথে, দাঁড়িয়েছে সে, সে পথে।
২.
রাজনীতি মাঝে মাঝে আমাদের ডাক দেয়। আমাদের জানালার পাশে রাজনীতি। রাজনীতি বলে হাত তোলো। আমাদের হাত কোথায়। আমরা হাত খুঁজি। আমাদের হাত কোথায় যে জমা আছে জানি না। রাজনীতি বলে ঠিক আছে। নগরের বাক্সে জমা আছে আমাদের হাত। আমাদের হাত কিভাবে রাজনীতির বাক্সের ভেতর যায় বুঝতে না পারলে আমরা ভাবি আমাদের হাতের কাজ তবে আমাদের আর করা লাগবে না। আমাদের সকল কাজ করে দিবে রাজনীতি। আমরা আমাদের হাত খুঁজে না পেলে পা খুঁজি। আমরা আমাদের পা বিষয়ে অর্ধেক বুঝি, বাকি অর্ধেক বুঝি না। পাও তবে যাক যেদিকে রাজনীতির বাক্স আছে।
রাজনীতির ভেতর নগর পিতা নির্বাচনের বিষয় থাকলে কয়েকজন রাজনীতিক আমাদের কাছে আসে। তারা বলে তারা এসেছে গ্রীস থেকে, তারা এসেছে মিশর থেকে প্রশ্নবিদ্যা নিয়ে গণনা বিদ্যা নিয়ে। আমাদের নাম জিজ্ঞাসা করা হয়, আমাদের বাবা-মা’র নাম জিজ্ঞাসা করা হয়। তারা আমাদের ওয়ার্ডের নাম, মহল্লার নামও লিপিবদ্ধ করে। ওরা আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দেবার পর, সকল উত্তর লিপিবদ্ধ করার পর একটা করে কার্ড দেয় আমাদেরকে। তারা বলে এটা আমাদের পরিচয়পত্র। তারা বলে এ কার্ড হারালে আমরা আমাদের পরিচয় হারাবো, গৃহ হারাবো, শহর হারাবো। তখন মনে হয় এটা তবে আমাদের পরিচয়পত্র। আমরা তাদেরকে বলি আমরা আমাদের হাত খুঁজে পাচ্ছি না এবং মাঝে মাঝে আমরা আমাদের পাও খুঁজে পাই না। তারা বলে আমাদের সকল হাত তাদের বাক্সে জমা আছে। তারা এবার গম্ভীরভাবে এবং আমাদের বুকের যেখানে ভয় বাস করে সেদিকে তাকিয়ে বলে এ কার্ড হারালে আমরা আমাদের পরিচয় হারাবো, হাত হারাবো, পা হারাবো, গৃহ হারাবো, শহর হারাবো, জীবন হারাবো এবং এমনকি মৃত্যুও হারাবো, হারাবো মৃত্যুর পর সমাধি পাবার অধিকার। তখন কার্ডটিকে আমাদের জীবনপত্র মনে হয়, মৃত্যুপত্র মনে হয়। আমাদের জীবন রক্ষার জন্য, মৃত্যু পর সমাধি পাবার অধিকার রক্ষার জন্য তাদের দেয়া কার্ডটির যত্ন নিই। আমরা চিন্তা করি কোথায় রাখা যায় এ কার্ডটি। আমাদের তরুণেরা ইন্টারনেট জগতে ঘোরাফেরা করে জানায় সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ইন্টারনেট। তাদেরকে আমাদের জীবনপত্র ও মৃত্যুও পর সমাধি পাবার অধিকারপত্র ইন্টারনেটে জমা রাখতে বলি। ইন্টারনেটে আমাদের সকল কিছু জমা রাখার পর আমাদের তরুণেরা জানায় ইন্টারনেটে আমাদের হাতগুলো, পাগুলো খুঁজে পাওয়া গেছে। আমাদের খুব আনন্দ হয় এ খবর শোনার পর। তারা আরো বলে ইন্টারনেট আমাদেরকে অমর করেছে। তাদের এ কথা বুঝতে না পারলেও শুনতে ভালো লাগে।
৩.
এরপর আমরা জানতে পারি আমাদের নগরের উন্নয়নের জন্য আমাদের নগরে নগরপিতা নির্বাচিত হয়ে গেছে। যে নির্বাচনে আমাদের হাত ছিলো। হাতের আঙ্গুলের টিপসই ছিলো। নগরপিতা একলা আমাদের দায়িত্ব না নিতে পারলে নির্বাচিত হয় নয়জন নগরপুত্র। নগর পুত্রকে কমিশনার বললে পুত্রের পরিবর্তে বলি নগর কমিশনার।
৪.
আমরা যে ওয়ার্ডে বাস করি সে ওয়ার্ডের কমিশনারের নাম মানিক কমিশনার। মানিক কমিশনার যে কতো বড় কমিশনার তা প্রথম জানতে পারি আমাদের ওয়ার্ডের সবচেয়ে দক্ষ রাজমিস্ত্রী মন্টুমিয়া’র নিকট থেকে। মন্টুমিয়া জানায় সে মানিক কমিশনারের সাত ছেলের জন্য সাতটা দশ তলা বিল্ডিং তৈরি করে দিয়েছে। আমরা যতোটুকু গণনা করার অধিকার রাখি তা দিয়ে জানি এ শহরে দশ তলা বিল্ডিংয়ের সংখ্যা মোট সাতটা। রাজমিস্ত্রি মন্টু মিয়া জানায় রোজ রাত দশটায় নানা জায়গা থেকে টাকার বান্ডিল আসে মানিক কমিশনারের বাড়িতে। টাকা গণনা করার অতো সময় না থাকলে মানিক কমিশনারের লোকজন ওজন মাপার ডিজিটাল যন্ত্র দিয়ে টাকা মেপে নেয়। টাকা গণনা করার পরিবর্তে মেপে নেয়ার বিষয়টা আমাদের ভেতর রূপকথা তৈরিতে উসকানি দেয়। আমরা মানিক কমিশনারের টাকা মাপার বিষয়টাকে গল্পে রূপ দিই। আরো পরে রূপকথায় রূপ দিই। আমাদের কেউ একজন স্মরণ করিয়ে দেয়Ñ পৃথিবীর সকল রূপকথা গরীব মানুষদের বানানো। আমরা মানিক কমিশনারের টাকা মাপা’র বিষয়ে রূপকথা বানাতে গিয়ে সবকিছুর উপর প্রলেপ দিই। রূপকথার উপরে প্রলেপ না দিলে, ছদ্মবেশ না দিলে সে সব গল্পতো আহবান করে মৃত্যুকে। আমরা মৃত্যুকে না চাইলে আমাদের গল্পের গায়ে ছদ্মবেশ চড়ায়। রূপকথার গায়ে ছদ্মবেশ দিলে আমরা তাকে বলি চুপকথা। চুপকথা শব্দটি শুনতে বেশ ভালো লাগলে আমরা আমাদের সকল কথাকে চুপকথামালা বলি বা বলতে থাকি মাঝে মাঝে। মানিক কমিশনার ও মানিক কমিশনারের বাড়ির গল্প বলতে ও শুনতে আমাদের ভালো লাগে। এ সব গল্প বলা ও শোনা আমাদের কাছে নেশার মতো মনে হয়। আমরা ভাবি যদি আমাদের কাছে রাত দশটায় নানা জায়গা থেকে টাকা আসতো আর সে টাকা আমরা ডিজিটাল ওজন মাপার যন্ত্র দিয়ে মেপে নিতে পারতাম তাহলে কি যে আনন্দ আমাদের মন বেয়ে বেয়ে পড়তো। এই চিন্তা আমাদের ঘুমের ভেতর যখন প্রবেশ করে তখন তা স্বপ্ন হয়ে যায়। আর তা দিনের ভেতর প্রবেশ করলে নেশা হয়ে যায়। আমরা স্বপ্নগ্রস্থ হবার জন্য ঘুমাই আর নেশাগ্রস্থ হবার জন্য নেশা ধরি। আমাদের তরুণেরা এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা দিনে নেশা করে রাতে স্বপ্ন দেখার জন্য, আর রাতে স্বপ্ন দেখে দিনে নেশা করার জন্য। তারা স্বপ্ন ভালোভাবে দেখার জন্য মানিক কমিশনারের ছবি সম্বলিত টি শাটর্ পরে ঘুমায়। তারা বলে মানিক কমিশনারের ছবি সম্বলিত টি শার্ট পরে ঘুমালে এ স্বপ্ন অনেকক্ষণ দেখা যায়। তারা দিন পার হবার জন্য ইয়াবা সেবন শুরু করে। ইয়াবা সেবন করতে করতে আমাদের তরুণেরা জানতে পারে ইয়াবা যে স্বপ্ন সৃষ্টি করে সেসব ইয়াবাতে মানিক কমিশনারের ছবি থাকে। আরো কদিন পর জানা যায় মানিক কমিশনার ইয়াবা তৈরির কারখানা দিয়েছে। এ কারখানায় কোনো ভেজাল ইয়াবা তৈরি হয় না।
আমাদের নগরের সকল কিছুকে মানিক কমিশনার গণনার ভেতর আনতে চাইলে দেখি সে রাস্তা গণনা করছে। নগরীর সকল রাস্তা গণনা করে সে নতুন নামকরণ করে এ সকল রাস্তার। সে বলে এ সব পুরাতন নাম মানুষকে পঙ্গু করে দেয়। রাস্তাগুলোর পুরাতন নামের ফলে আমাদের চলার গতি কমে গেছে। হাঁটার, দৌড়াবার গতি বাড়াবার জন্য এ সকল রাস্তার নতুন নাম চায়। মানিক কমিশনার নিজের নামে ও তার পরিবারের সবার নামে রাস্তার নামকরণ করে। এ সকল রাস্তার নতুন নামকরণ হলে আমরা মনে করি অথবা মানিক কমিশনার আমাদেরকে জানায় আমাদের নগরের উন্নতি হচ্ছে। আমরা আমাদের নগরীর উন্নয়ন বোঝার জন্য রাস্তায়, রাস্তায় হাঁটি, রাস্তায় রাস্তায় রিকশায় চড়ে ঘুরি। রিকশায় চড়ে জানতে পারি আমাদের নগরের রিকশা গণনাও সম্পন্ন। প্রতিটি রিকশার পিছনে মানিক কমিশনারের ছবি, স্বাক্ষর ও রিক্সা নাম্বার। রিক্সাওয়ালারা জানায় প্রতিদিন তারা রিক্সা চালিয়ে যা আয় করে তার অর্ধেক রাত দশটায় চলে যায় মানিক কমিশনারের বাড়িতে। রাত দশটাকে তবে আমাদের ক্ষুধার্ত চুল্লি মনে হয়।
নগরীর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমাদের স্যান্ডেল ও জুতা ক্ষয় হলে আমরা আমাদের নগরীর মুচিরা যে রাস্তার পাশে বসে সেখানে যাই স্যান্ডেল ও জুতা মেরামত করার জন্য। তাদের মুখেও শোনা যায় মানিক কমিশনারের বিপুল উন্নয়ন কাজের কথা। তারা জানায় মানিক কমিমনার মুচি গণনা কার্যক্রমও শেষ করে ফেলেছে। তাদের নাম ছেঁটে ফেলে প্রত্যেককে একটা করে সংখ্যা দিয়েছে নামের পরিবর্তে। আর নতুন নিয়ম অনুযায়ী তাদের উপার্জনের অর্ধেক রাত দশটায় মানিক কমিশনারের বাড়িতে দিয়ে আসতে হয়।
একদিন মানিক কমিশনারের লোকজন এসে জানায় এ শহরের রাস্তার সবকিছু গণনা শেষ করে এখন তারা বাড়ির ও বাড়ির সকল কিছু গণনা করতে চায়। তারা জানায় নগর পিতা প্রদত্ত পূর্বের পরিচয়পত্র বাতিল বলে গণ্য হবে এরপর থেকে। তারা আরো জানায় আমাদের সবাইকে আমাদের বাড়ির সবকিছুর নতুন নাম- ঠিকানা দেয়া হবে।
৫.
আমাদের নতুন পরিচয়পত্র আমাদেরকে এলোমেলো করে দেয়। আমরা পরিচয়পত্র থেকে দেখি আমাদের সবার নাম বদলে গেছে। বাড়ির ঠিকানা বদলে গেছে, বাবা’র নাম বদলে গেছে, মা’র নাম বদলে গেছে। পরিচয়পত্র দেবার সময় মানিক কমিশনারের লোকজন বলে যায় আমাদের বাড়ির সকল কিছুর অর্ধেক যেনো রাত দশটায় মানিক কমিশনারের বাড়িতে যায়। যেখানে ডিজিটাল ওজন মাপার যন্ত্রে সবকিছু সঠিক ভাবে মেপে নেওয়া হবে।
আমরা এইবার বিপদে এরকম যে আসলে আমাদের বাড়িতে আমাদের কি কি আছে যে সেগুলোর অর্ধেক রাত দশটায় মানিক কমিশনারকে দিয়ে আসতে হবে। আমাদের তো স্বামী, তবে তার অর্ধেক; আমাদের তো স্ত্রী, তবে তার অর্ধেক; আমাদের তো সন্তান, তবে তার অর্ধেক; আমাদের তো ঘুম, তবে তার অর্ধেক। কিভাবে এ সব কিছুকে অর্ধেক করা যায় তা বুঝতে না পারলে ভাবি সবটুকু যাক রাত দশটার কাছে।
৬.
আমরা আমাদের বাড়ির সব কিছুর অর্ধেক দিতে অপারগ হলে কিংবা দিতে না চাইলে নগরীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে থাকা সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তার কাছে যাই। সে জানায় এ নগরীর উন্নয়নের যদি আমরা অংশীদার হতে চাই তবে আমাদের সকল কিছুর অর্ধেক দেওয়া খুব জরুরি। সে নিজেও সকল কিছুর অর্ধেক দেয় ও দেবার পক্ষে। পুলিশ প্রধান জানায় তার স্ত্রী’র অর্ধেক, তার মেয়ের অর্ধেক, তার নিজের অর্ধেক রাত দশটার কাছে জমা দিয়ে এসেছে। আমরা তার দিকে ভালো করে তাকাই। তার পকেটে মানিক কমিশনারের ছবি আছে বলে আমাদের মনে হয়। তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দশটা বাজে। সে জানায় তার ঘড়িতে সব সময় রাত দশটা বাজে।
প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার কোনো সহায়তা না পেলে আমাদের কেউ কেউ না বলা শেখে। না বলার সঙ্গে সঙ্গে দেখি আমাদের যারা যারা না বলেছিলো তারা পরিবার থেকে, মহল্লা থেকে নাই হয়ে গেছে। তাদেরকে খুঁজে না পেলে আমরা আমাদের সকল না হারিয়ে ফেলি কিংবা সকল না নষ্ট করে ফেলি। আমাদের নগরীর একজন অভিধান প্রণেতা ছিলো যে আমাদের নগরীতে ব্যবহৃত সকল শব্দ সংকলিত করেছিলো তার সংকলিত অভিধানে। সে জানায় আমাদের নগরীর বেশির ভাগ না বোধক শব্দ নষ্ট হয়ে গেছে কিংবা তা হ্যাঁ বোধক শব্দে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আরো কথা এই যে না শব্দটির ব্যবহার না থাকলে আমরা খুব মজা পাই এই ভেবে যে আমাদের নগরীর জীবন সত্যিই খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে আমাদের কেউ একজন সূযর্ ডোবার মুহূর্তে বলে মৃত্যুর চেয়ে বড় না কিবা আছে। আর মৃত্যু তো রয়েছে আমাদের জীবনে, আমাদের রাত দশটায়।
৭.
আমাদের নগরে রাজহাঁস ছিলো না। হঠাৎ একদিন আমরা আমাদের নগরীর পথে পথে রাজহাঁস দেখতে পাই। নগরীর পথে পথে রাজহাঁস দেখতে পেলে আমাদের নগরীর পথগুলোকে প্রথমবারের মতো রাজপথ মনে হয়। কিংবা এ নগরীকে রাজধানী মনে হয়। কিসের যে রাজধানী তা ভাবতে না পারলে রাজধানী ভাবনা ডুবে যাক। সাদা রাজহাঁসগুলো নগরীর পথে পথে সামন্তরাজাদের মতো হেলেদুলে ঘুরে বেড়ালে আমরা সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আবারো প্রশ্ন আনি কিভাবে এলো এ সকল রাজহাঁস আমাদের পথে। এই উত্তর কেউ দিতে পারে না। আমাদের কারো কারো রাজহাঁসের মাংশ খেতে ইচ্ছে হয়। কারো কারো রাজহাঁসের ডিম খেতে ইচ্ছে হয়। রাজহাঁসের মাংশ আর রাজহাঁসের ডিম খেতে ইচ্ছে হওয়া কেউ কেউ রাজহাঁসের পিছুপিছ ুযেতে যেতে শোনা যায় হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে তারা রাজহাঁসের ডিমের ভেতর, মাংসের ভেতর। এই সময় রাজহাঁসের ডিম ও মাংশকে নিষিদ্ধ ডিম ও নিষিদ্ধ মাংশ বলে ভাবা যায়।
আমাদের নগরে একজন কবি ছিলো। সে জানায় অনেক আগে এ নগরের মেয়েদেরকে রাজহাঁস বলা হতো। তারা নগরীর পথে সৌন্দযর্ বিকিরণ করলে তাদেরকে রাজহাঁস মনে হতো। আমরা আমাদের মেয়েদেরকে এ কথা শোনাই। তারা খুব খুশি হয় এ ভেবে যে তাদের একটা রাজহাঁস অতীত আছে। কবিতার ইতিহাসে তাদের সঙ্গে রাজহাঁসের তুলনা এসেছে। বেশ কিছুকাল তারা কবিতার ভেতর নিজেদের ও রাজহাঁসদের আনন্দ আবিষ্কার করতে চেয়েছে।
৮.
রাজহাঁসের সংখ্যা নগরীর পথে পথে বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে কতো যে হয় তার গণনা দরকার। আমাদের একজন পরিসংখ্যানবিদ জানায় আমাদের গৃহে যতোজন মেয়ে ঠিক ততোটা রাজহাঁস। আমরা ভয় পাই এ গণনায়। কেনো আমাদের মেয়েদের সমান সংখ্যক হতে হবে নগরীর রাজহাঁসের সংখ্যা।
রাজহাঁসগুলো ক্রমে ক্রমে আরো বড় হয়ে উঠতে থাকলে আমাদের ভয় আরো বড় হয়। আমাদের ভয় বড় হয় রাজহাঁসের মতো। এক একটা ভয়কে মনে হয় এক একটা রাজহাঁস কিংবা এক একটা রাজহাঁসকে মনে হয় এক একটা ভয়। তারপর দেখি এ সকল রাজহাঁস ওড়া জানে। তারা মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি ডিঙিয়ে যায় উড়ে উড়ে। আমাদের ভয় আমাদের মেয়েদের সঙ্গে ভাগ করে নিলে তারা রাজহাঁসগুলোকে আমাদের অধিক ভয় পায়। রাজহাঁসগুলো বাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে গেলে তাদের বেনী খুলে যায়, তাদের মোমবাতি নিভে যায়।
৯.
রাজহাঁসগুলোর মালিক খোঁজা জরুরী হয়। আমরা রাজহাঁসের মালিকের সন্ধানে নগরীর হাঁস-মুরগীর খামারে যাই। তারা জানায় তাদের খামারে রাজহাঁস পোষা হয় না। আর তাছাড়া রাজহাঁস পোষার অধিকার সবার নাই। খামারের একজন বৃদ্ধ শ্রমিক জানায় রাজহাঁস পোষার জন্য রাজবংশের লোক হতে হয়। আমরা ঠিক জানি না আসলে এ নগরীতে রাজবংশের লোক কারা। কার আছে রাজপদবী। আমাদের অনুসন্ধান মরে যায়। অনুসন্ধান মরে গেলে ভয় রাজহাঁস হয়ে আমাদের মেয়েদের মাথার ওপর উড়ে বেড়ায় সকল সময়।
একরাত। আকাশে চাঁদ। আকাশে রাজহাঁস। আমাদের সবার বাড়ির ওপর চাঁদ, আমাদের সবার বাড়ির ওপরে রাজহাঁস। আমরা রাত দেখতে দেখতে, চাঁদ দেখতে দেখতে, রাজহাঁস দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি। আমাদের মেয়েদের সমবেত কান্নায় আমাদের ঘুম ভাঙে, ভয় জাগে। আমরা বুঝতে পারি না কতো রাত ঘুমিয়েছি। কতো চাঁদ ঘুমিয়েছি। মেয়েরা জানায় সমবেতভাবে। এ নগরীর রাজহাঁসগুলো তাদেরকে ধর্ষণ করেছে।
তখন মনে পড়ে মানিক কমিশনার বলেছিলো রাজহাঁস তার প্রিয় শখ। আমরা বলি হা ঈশ্বর। রাত আসে। চাঁদ আসে। রাজহাঁস ওড়ে। চুপ! চলে গেছে এ নগর রাত দশটার কাছে।
0 Comments