কুশল ভৌমিক এর প্রবন্ধ




কবিতাকে বলা হয়ে থাকে 'inexplicable art' ব্যাখাতীত শিল্প।একারণেই কবিতার সর্বজনস্বীকৃত কোনো সংজ্ঞা নেই,থাকা উচিতও নয়।তবুও বিভিন্ন কবি তাদের অভিজ্ঞতা,বোধ ও পর্যবেক্ষণের আলোকে কবিতার বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। ইংরেজ কবি ওয়াডর্সওয়ার্থ যেমন বলেছেন নির্জন মুহুর্তের স্বতস্ফুর্ত আবেগই কবিতা। আবার অডেনের মতে স্মরণীয় বাণীর মহিমাই কবিতা। অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ কবি টমাস গ্রে একটি চমৎকার কথা বলেছেন -" কবিতা কখনো তার সমকালীন ভাষায় রচিত হয় না" অর্থাৎ কবিকে হতে হয় তার সময়ের চেয়েও অগ্রগামী।যদিও W.H.Auden বলেছেন "A poet is a man who is passionately in love with language " 
কিন্তু শুধু আবেগপূর্ণ ভাষার ব্যবহার দিয়েই কি কবিতা লেখা যায়? কবিতা লেখার মাধ্যম অবশ্যই শব্দ তাই বলে শব্দসমষ্টিই তো আর কবিতা নয়। 

কবিতা লেখার জন্য প্রয়োজন একটি সংবেদনশীল হৃদয়। প্রয়োজন প্রখর কল্পনাশক্তি আর কল্পনার ভেতর চিন্তা ও অভিজ্ঞতার পরিমিত মিশ্রণ। কেবল শব্দের পিঠে শব্দ বসালেই তা কবিতা বলে স্বীকৃতি পায় না এবং কবিতার উদ্দ্যেশ্যও এটি নয়। একটি মহৎ কবিতার আজন্ম সাধ শব্দের ভেতর দিয়ে হেঁটে   একটি শব্দাতীত জগত নির্মাণ করা।

একটি শব্দের আহবানে কিভাবে অন্য আরেকটি শব্দ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। অবচেতনে কোনো বিশেষ ঘটনা, কোনো বিশেষ মুহূর্ত কিভাবে কবির মনোজগতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন। একজন কবি যখন কবিতা লেখা শুরু করেন  তখন কবিতা লেখাটা নিছক আনন্দের অনেকটা বিছানার ওপর ছোট বাচ্চার লাফানোর মতো,কোনো বিশেষ মানে নেই,গভীর কোনো উপলব্ধি নেই কিন্তু লেখার আনন্দটা আছে।বোধ ও অভিজ্ঞতার পরিপক্কতার মাধ্যমে ক্রমশ তিনি বুঝতে পারেন  কবিতা লেখাটা আসলে অর্থহীন কোনো আনন্দের বিষয় নয়, নিঃশ্বাস নেবার মতোই অনিবার্য। অনেকটা ছোট বাচ্চাকে হাত ধরে  স্কুলে নিয়ে যাবার মতো, হাত ধরে হাঁটার আনন্দ আছে আবার  রাস্তা পার করানোর সতর্কতা বা সাবধানতাটাও ভীষণ জরুরি। 

একটা ভালো কবিতায় আবেগ ও বুদ্ধিমত্তা হাত ধরে ধরে হাঁটে।কবিতা লিখতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি শিল্পের জন্য অতৃপ্তি বা আফসোস শব্দটি খুব জরুরি। আত্মতৃপ্তি নিয়ে শিল্পসাধন হয় না। সেই সাথে অমান্যতা, অবাধ্যতা এ শব্দ দুটোও গুরুত্বপূর্ণ। অনেকটা মোহের ভেতর থেকেও নির্মোহ থাকা,বৃত্তের ভেতর থেকেও বৃত্তচ্যুত হতে পারে। সবকিছুর মধ্যে থেকেও কোনো কিছুর মধ্যে না থাকাটা। ম্যাকলিশ এর একটি কথা আমার ভীষণ ভালো লাগে।তিনি বলেছেন-- " কবিতা কিছুই বোঝায় না,কবিতা শুধুই হয়ে ওঠে "।

কখনো কখনো কোনো স্মৃতি, কোনো ঘটনার পটভূমি, কখনো কোনো ঘনঘটা ছাড়াই কবিতা হয়ে ওঠে। এই হয়ে ওঠার মুহুর্তকে আমি বলি ঐশ্বরিক মুহুর্ত। এ জন্য অনেকেই কবিতাকে বলে থাকে ঐশ্বরিক উপহার (Divine gift) আবার এটাও সত্যি এই ঐশ্বরিক মুহুর্তটির জন্য প্রয়োজন নিমগ্ন ধ্যান বা সাধনা,নিবিড় অনুশীলন। 

কবিতা কিভাবে হয়ে ওঠে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দুটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমার মায়ের মৃত্যুর মাস দুয়েক পর, আমার স্ত্রী আলমারি খুলে মায়ের কয়েকটা শাড়ি বের করেছেন।হঠাৎ মায়ের প্রিয় বেগুনি শাড়িটিতে আমার চোখ আটকে গেল। আমি শাড়িটির দিকে তাকাতেই মনে হল, শাড়িটি খুব বিমর্ষ হয়ে আছে। মনে হলো মায়ের স্পর্শের অভাবে তার প্রিয় শাড়িটি কাঁদছে।আমি অবচেতনেই লিখে ফেললাম--

'প্রিয়জন মরে গেলে মানুষেরা ভুলে যায়
তখন গোপনে কাঁদে পুরনো পোশাক।'

আরেকবার গ্রামের বাড়ি গিয়েছি। অগ্রহায়ণ মাস।মাঠে মাঠে ফসল তোলার ধূম পড়েছে। দুপুর বেলা,ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটছি। হঠাৎ কানে এলো একজন কৃষক রাম প্রসাদের গান গাইছে--

"মনরে কৃষিকাজ জানো না
এমন মানব জনম রইলো পতিত 
আবাদ করলে ফলতো সোনা" 

মনে পড়ে গেল আমার বাবা প্রায়ই বলতেন আমার ঠাকুরদা একজন কৃষক ছিলেন।তিনি নিজের হাতে ফসল ফলাতেন আর ফসল কাটার পর ঠাকুমাসহ বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের কর্মব্যস্ততা বেড়ে যেত। আমাদের পুরো বাড়িটা তখন ধানের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে থাকতো। ভাবতে ভাবতে আমি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। ক্ষেতের আইলে বসে মোবাইলের নোট প্যাডে লিখে ফেললাম--

" আমার ঠাকুরদা একজন কৃষক ছিলেন 
  মাটিগন্ধা হাতে তিনি শস্য ফলাতেন 
  ধানের কাছে হৃৎপিণ্ড সমর্পণ করে
  তিনি শিশুর সারল্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন
  প্রতিটি ধান তখন কবিতা হয়ে উঠতো 
  আদিগন্ত মাঠ তখন কবিতার খাতা " 

এই কবিতাটি লেখার সময় আমি চোখের সামনে ঠাকুরদা,ঠাকুমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। ইংরেজিতে যাকে বলে escapism পলায়নবাদিতা।কল্পনার অদৃশ্য ডানায় ভর করে আমি চলে গিয়েছিলাম আমাদের গৌরবময় অতীতে। এই obsession বা ঘোরের মধ্যেই আমি লিখলাম--

"অগ্রহায়ণে তিনি তার সোনালি কবিতাগুলো 
কাঁধে বয়ে এনে ঠাকুরমার হাতে তুলে দিতেন
ঠাকুরমা পরমযত্নে কবিতার গন্ধ শুঁকতেন
স্পর্শ করতেন,রোদ্র মাখিয়ে রেখে দিতেন
গোলাঘরের নান্দনিক মলাটে
আমাদের গোটা বাড়িটাই তখন হয়ে উঠতো 
অনিন্দ্যসুন্দর এক কবিতার বই"।

সুতরাং আমি নিজেকে দিয়েই অনুভব করেছি, কবিতা লেখা যায় না, হয়ে যায়। তবে হয়ে ওঠার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয়, পড়তে হয়,জানতে হয়, সাধনা করতে হয়। একবার কথা প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কবি সৌমিত বসু আমাকে বলেছিলেন, কলেজ স্ট্রিটে কফি হাউজের এক আড্ডায় সদ্য প্রয়াত শ্রদ্ধেয় কবি পার্থ প্রতিম কাঞ্জিলাল সৌমিত বসুকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন, তা হলো " একজন প্রকৃত কবিকে অপেক্ষা জানতে হয়"। এই একটি কথা আমার মনোজগতকে ভীষণভাবে বদলে দেয়। সত্যিই তো কবিদের অপেক্ষা জানতে হয়,ধৈর্য্য ধারণ করতে হয়।কবিতা তো এক পরম সাধনার নাম।নিমগ্ন ধ্যান ছাড়া কি আর ঈশ্বরলাভ হয়? 


Post a Comment

0 Comments