ইসলাম রফিক এর মুক্তগদ্য ~ অপেক্ষা

 



জীবন থেমে থাকে না। চলতেই থাকে। কারো ভালো লাগুক, আর নাই লাগুক। নিরালা যখন আমাকে ফেলে রিকশায় চেপে বাড়ির দিকে চলে যায়, তখন কিছুটা সময়ের জন্য হলেও মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই মন খারাপ প্রতিনিয়ত হয়। বিদায় বেলা আমার কাছে সবসময় কষ্টের। আমি সহ্য করতে পারিনা। নিরালার ব্যাপারটা তো আরও আলাদা। সব সময় মনে হয় কাছাকাছি থাকি- এরকম মনে হয়। কিন্তু থাকা কী যায়? তাইতো কোনো কারণে সকালে বের হলেই দেখা হওয়া, কথা হওয়া, একসাথে বাজারহট করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসদ্রব্যাদী ক্রয় করা ইত্যাদি। এরই ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু কথা বলা যায়।

কেমন আছো নিরালা?
যেমন রেখেছেন। উত্তরটা আমার কাঁধে ফেলে দেয়। এই প্রশ্নের উত্তর বারবার একই। অর্থাৎ বিয়ে না করার সব অপরাধ আমার।

আমি রাখার কে?
নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন? পাল্টা প্রশ্ন চলে আসে। নিরালা কী সারাজীবন আমাকে অপরাধী রেখে যাবে। এত সময় একসাথে বেড়াই, একসাথে খাই, এক সাথে কথা হয়, তবুও তুমি কেমন আছো প্রশ্ন করলেই নিরালা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে। এ দোষ সারাজীবনের, এ দোষ। থেকেই যাবে।

আমার কোন অপরাধ ছিল না, নিরালা সেটা ভালো করেই জানে। তবুও আমাকে অপরাধী করে সে। আমাকে অপরাধী বানিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে। তবে ওর ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করে, আমাকে জাগিয়ে রাখে, আমাকে নতুন করে প্রেরণা দেয়, কবিতা লেখার শক্তি জোগায়। সেটা হয়তো সে জানে না।

আমি ওর প্রতি কৃতজ্ঞ অন্তত যখন শহরে বের হয়, আমাকে ফোন দেয়। আমরা একসাথে হাটি আর রাজ্যের গল্প জুড়ে দেই। বেশিরভাগই অনর্থক। কারণ কথা বলার উসিলা খোঁজা। এরই ফাঁকে ফাঁকে ও কাজ সারে। গালাপট্টি, নিউ মার্কেট, ফতেহআলী বাজার, রাজাবাজার কিংবা ব্যাংকের কাজ। সময়ের সাথে জায়গাগুলো আপন হয়ে ওঠে, আমরা আরো কাছাকাছি আসি। নিজেকে জানার এবং জানানোর চেষ্টা করি। ফলে আমার প্রতি  ওর আরও অভিমান বাড়ে। হয়তো এরকম ভাবেই সে জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার কল্পনা করত, হয়তো নতুন স্বপ্ন নিয়েই ভাবতো পরবর্তী জীবনের কথা।

পাশাপাশি বাসা। একদিন হঠাৎই সে বাসা ভরে গেল। প্রতিবেশী নতুন হলে, তরুণ ছেলে মেয়েদের প্রতিবেশীর প্রতি আকর্ষণ একটু বেশিই থাকে। আমারও তাই হল এবং একসময় আমি তারে গৃহশিক্ষক হয়ে গেলাম। এভাবেই শিক্ষক হতে হতে মনের শিক্ষক হয়ে ওঠা। সেটা ২০ বছর আগের কথা। এতদিনে কত জল গড়িয়েছে, পৃথিবী এগিয়ে গেছে কতদূর, তবু আমাদের যাত্রা থেমে থাকেনি। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে জীবন, চলাফেরা, কিন্তু বদলাইনি মনের আয়না। সেদিন ফেসবুকে দেখলাম কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ লিখেছেন, বাইরের আয়না ভাঙা যায়। মনের আয়না ভাঙা যায় না। যায় কী? তাহলে এত বছর পরেও কি করে টিকে থাকে ভালোবাসা, কি করে টিকে থাকে সম্পর্ক? আসলে মানুষ এক অদ্ভুত প্রাণী। তা না হলে এত কিছুর পরও বেঁচে থাকে কী করে?

জীবনকে নতুন করে ভাবার চেষ্টা করি, নতুন নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করি নিরালাকে নিয়ে। কেমন জীবন হতো আমাদের? পুরো শহরে দাপিয়ে বেড়াতাম, বাংলাদেশকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরতাম এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি। কী চমৎকার করে চলতো জীবন, দিনের সূর্যের তাপের বেদনাকে সঙ্গী করতাম যেমন, তেমনি চাঁদনী রাত উপভোগ করতাম। কবিতা পড়ে পড়ে, প্রেমের উপন্যাস পড়ে পড়ে কেটে যেত সারারাত। কিংবা সিনেমার গান শুনে শুনে কেটে যেত মধ্যদুপুর কিংবা মন খারাপের সন্ধ্যা।

এসবের মাঝেই একদিন জিজ্ঞেস করি__ তোমার সাথে একটা রাত থাকার আমার খুব সখ। কোন কথা বলে না, চুপচাপ শুনে যায়। হয়তো কল্পনায় দেখে, হয়তো উপভোগ্য বিষয়গুলো ভাবে, হয়তো ভাবনাতে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে চায়। উত্তর না পেয়ে আবার বলি- সারারাত তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতাম। নিরালা এবার সরব হয়ে ওঠে।
ঘুমাতে দিলে তো!
মনটা ভরে ওঠে, আনন্দে নেচে ওঠে। এই একটি বাক্য শোনার জন্য কতদিন অপেক্ষা করেছি, কত প্রহর চলে গেছে নীরবতায়। হয়তো এমন রাত আসবে। বাড়ির সামনে উঠানটা ফটফটা জোসনায় আলোকিত হবে। সেদিন সমস্ত আকাশ জুড়ে থাকবে বড় চাঁদ। রাতের আলোয় ঝকঝক করবে পুরো পৃথিবী। আমাদের কৈশোরে করা প্রেমের অনুভূতি উপভোগের জন্য আমরা সারারাত জেগে থাকবো, পাশে বাঁশ বাগানের ঝাড় থেকে কিছু অচেনা পাখি কারণ ছাড়াই ডেকে যাবে সারারাত।

Post a Comment

5 Comments

  1. ধন্যবাদ রনি বর্মন।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ রনি বর্মন।

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ রনি বর্মন।

    ReplyDelete
  4. ভালো লাগলো

    ReplyDelete