একটু একটু করে সম্পর্কটা মরে গেছে তুই টের পাসনি। বহুদিন ধরেই একটা মৃত সম্পর্ক আগলে আছি। না,তোর বাবাকে মহৎ করার জন্য সব নীরবে হজম করিনি। স্বামী ছাড়া চলতে পারতাম না তাও না। তবু কেন এত দিন ধরে এত অপমান সহ্য করে সম্পর্কটা আগলে রাখলাম আজ তোকে সেই কথা বলবো। আমি তখন ডিগ্রিতে পড়তাম। তখন আমার বিয়ে হলো। আমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েই তোর বাবা বিয়ে করলেন। কেন আমাকে দেখে মুগ্ধ হলো? আমার কী কী গুণ ছিলো? আমাকে দেখে তোর বাবার মনে হয়েছিলো আমি এমন একটা মেয়ে যে কিনা সাত চড়ে রা করবো না। যা বলবে তাই করবো টাইপ মেয়ে। আসলে আমি বড়ও হয়েছিলাম ওরকম একটা বিশ্বাস থেকে। আমাকে শেখানো হয়েছিলো উচ্চ স্বরে হাসা যাবে না। শব্দ করে চলা যাবে না। ডানে বায়ে কোন পুরুষের দিকে তাকানো যাবে না। বিয়ের পর অক্ষরে অক্ষরে স্বামীর আদেশ পালন করতে হবে। স্বামী হচ্ছে মাথার মণি।
বিয়ের পর তোর বাবা আমাকে শেখালো আমার ইচ্ছে আর অনিচ্ছে বলে কিছু নেই। তার চাওয়াটাই সব। গোসল করে লুঙ্গি রেখে দেবে সেটা পরিস্কার করতে হবে। কাপড়ে যেন ভাজ না থাকে সেভাবে শুকাতে দিতে হবে। খাওয়ার সময় এক মুহূর্ত এদিক-সেদিক যাওয়া যাবে না। তার কী লাগে না লাগে সেসব দেখতে হবে। শিক্ষিত মেয়ে বলে অতি শুদ্ধ কথা বলা যাবে না। তাতে তার অশিক্ষিত ভাবিদের খাটো করা হবে। আমাকে তাদের মত হয়েই তাদের সাথে মিশতে হবে।
স্বামী হচ্ছে মাথার মণি, সুতরাং তার কথা তো পালন করতেই হবে। তাই অক্ষরে অক্ষরে সেসব পালন করতে থাকলাম। তার প্রতিটি আদেশ পালন করাই ছিলো তার প্রতি আমার ভালোবাসা। আমি যে একটু একটু করে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম সেটা টেরই পাইনি। একদিন তোর বড় মামা বললো, আপা এ কী অবস্থা তোমার? তোমাকে দেখে চেনাই যায় না। তুমি যে গ্র্যাজুয়েট একটা মেয়ে তোমাকে দেখে তো বোঝাই যায় না। করো কী? সন্ধ্যা হলে একটু গল্পের বই পড়তে পারো। পত্রিকা পড়তে পারো। আর তুমি রাত আটটার সময় ঘুমিয়ে পড়ো? তোর বড় মামাকে তো জানিস। সে কেমন মানুষ।
কিন্তু আমি যে রাত জাগতে পারি না। সকাল বেলা তোর বাবা অফিসে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার সামনে সামনে থাকতে হয়। সকালের রান্না থেকে তার পোশাক পরা পর্যন্ত সব যে আমাকেই করতে হয়। তারপর সে চলে গেলে পরের দিন কী পরবে সেসব কাপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা, ঘর গোছানো, ভাবিদের সাথে সব কাজে সমান অংশ গ্রহণ সব করতে হয়। তখনো বুঝিনি আমি সুখী না অসুখী। যা করছি সব তো নিজের সংসারের জন্যই করছি। এ নিয়ে কোন খেদ ছিলো না। বিয়ের দেড় বছর পর আমার কোলজুড়ে তুই এলি। স্বামী পুত্র পছন্দ করে সেজন্য কিনা জানি না। তবে চাইতাম ফুটফুটে একটা পুত্র সন্তান হোক। সে যেন ওর বাবার মত হয়।
বিয়ের দু বছর পর টের পেলাম আমাদের সম্পর্কটা ঠিক ভালোবাসার নয়। আমি তার স্ত্রী নই। আমি তার সেবাদাসী। তোর চাচারা বৌ পেটাতো। তোর বাবাও তাই শুরু করলো। কীভাবে শুরু করলো এবার সেই কথাতে আসছি। এক রমজানে তোর বাবা আমাকে সেজে তৈরি থাকতে বললো। তারাবি পড়ে এসে সে যেন দেখে আমি পরীর মত সেজে বসে আছি। সেদিন খুব ক্লান্ত ছিলাম। সারাদিনের রোযা আর সংসারের কাজ করে শরীর আর টানছিলো না। বিছানায় একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তোর বাবা এসে আমাকে সাধারণ বেশে দেখে খুব রেগে গেলো। বললাম,আজ শরীর খারাপ। আজ পারবো না। তোর বাবা আমাকে লাথি মেরে বিছানা থেকে ফেলে দিলো। সারা রাত আর বিছানায় নেয়নি। ফোন করে আমাদের বাড়িতে নালিশ করলো। আমি আর মা বাবাকে কী বলবো, তারাই উল্টো আমাকে বললো,কাজটি আমি ভালো করিনি। কেন স্বামী সাজতে বললো আর আমি না সেজে অবাধ্য হলাম। মেয়েদের সব সৌন্দর্য তো স্বামীর জন্যই। দোষ নাকি আমিই করেছি। তোর বড় মামা প্রতিবাদ করলো। বরং সেটার ফল হলো উল্টো। কেন পারিবারিক বিষয় আমার ভাই জানলো সেজন্য আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করলো। প্রথম প্রতিবাদ করলাম। বললাম,বাপ-ভাইয়ে তো শিক্ষিত চাকুরিজীবী দেখেই বিয়ে দিয়েছে, ভেবেছে এতেই আমি সুখী হবো। তারা তো জানে না কোন সুখে আছি আমি। কতজন বিয়ে করতে চেয়েছে।
আমার প্রতিবাদ আমার জন্য আরো কাল হলো। ইচ্ছে মত আমাকে মেরে সে শান্ত হলো। এর পর শুরু হলো কথায় কথায় অপমান। ডাক্তার,পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার কতজনই না তোরে নিবার চাইছে। নচ্ছার মাগি।
তখন তুই খুব ছোট। মাত্র তিনটি শব্দ শিখেছিস। মা,বাবা আর মাগি।
আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করতো তখন। তোর বাবাকে ছেড়ে মা-বাবার ওখানে ওঠবো সেটাও ভাবতে পারছিলাম না। লোকে কী বলবে? কেন আমি স্বামীর ঘর করতে পারছি না, নিশ্চয় আমারো কিছু দোষ আছে।
একটা চাকরি জোগার করে আলাদা থাকবো সে সাহসও পাচ্ছিলাম না। তার চেয়েও বড় কথা দূরত্ব উঠছিলো ঠিকই তবু কোথাও যেন একটু ভালোবাসা ছিলো। মায়া কাটাতে পারিনি। সে নিয়ে তোর বড় মামা আমাকে খুব বলতো, স্বামী ধন কি আর ছাড়তে পারবি... পারিসও!
খুব ভাবতাম তোকে। আমি তো তোকে নিয়ে যেতে পারবো না। তোকে রেখে দিবে। মরে গেলেও মা হারা হবি। ভাগ্য বলেই মেনে নিয়ে ছিলাম। আমার মাও বলতো এভাবেই ওর দিন যাবে। এখন আর ছাড়িয়ে আনার সময় নেই।
তোর বয়স তখন চার। বেশ কিছু বিশ্রী শব্দ আয়ত্ব করেছিস। আত্মীয় স্বজনদের সামনে খুব ছোট হয়ে থাকতাম কখন কি বলে ফেলিস। তোর বাবা এসব গায়ে মাখতো না। আমিই মিথ্যে করে বলতাম যার তার সাথে বাবুকে খেলতে দেয়া যাবে না। দেখছো কীসব ভাষা শিখছে।
এসবের ভেতর দিয়েই আমার দিন কাটতে থাকলো। খেলার মাঠে তোর দস্যিপনার জন্য আমাকে কথা শোনতে হতো।তোর এ প্লাস মিস হলে আমাকে কথা শোনতে হতো। এভাবেই সময়টা কেটে গেছে। এলোমেলোভাবে অনেক কথাই বলছি। ভাবছি ধারাবাহিকভাবে খুব গুছিয়ে তোকে লিখবো। পারছি না। দেখ, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা ভুলেই গেছি। তুই একটু বড় হলে সবার সামনে আমাকে আর গায়ে হাত তুলেনি। ছেলে বড় হচ্ছে তখন কি আর সবার সামনে বৌয়ের গায়ে হাত তোলা যায়! ঘরে নিয়ে দরজা দিয়ে গলা চেপে ধরতো। আশ্চর্য সময় জ্ঞান ছিলো।দম একেবারে বন্ধ হওয়ার আগ মুহূর্তে ছেড়ে দিতো। মার খেয়ে খেয়ে আমারও আশ্চর্য এক স্বভাব হয়েছিলো, তার প্রতিটি বাজে কথারই জবাব দিতে শুরু করেছিলাম। আর সেও ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে মারতো। মনে মনে একটা সুপ্ত বাসনা ছিলো তার হাতে যেন আমার মরণ হয়। কিন্তু কী কপাল দেখ। তাও হলো না।
এক সময় ভাবতাম ছেলে বড় হবে, নিশ্চয় আমাকে বুঝবে। কই, তাও তো আর হলো না।
আজ তোর বাবা আমাকে খুব মেরেছে।
তাতে যতোটা কষ্ট পেয়েছি তার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছি তোর ব্যবহারে।
তোর সম্পর্ক ব্রেকাপ হয়েছে বলে তুই আজ ইরার গায়ে হাত তুলেছিস। একবারও কি ভেবেছিস কেন ইরা তোকে এখন আর ভালোবাসে না? তুই তোর বাবার মত শিখে গেছিস নারীর আবার কী ইচ্ছা। ভালোবেসেছিলো ভালোবাসতেই হবে। না বাসলে সে মাগি। তার গায়ে হাত তোলা পৌরুষত্ব।
আর তাই ফেসবুকে ইরাকে মাগি সম্বোধন করে স্ট্যাটাস দিয়েছিস। বিশেষ মুহূর্তের কথা পাবলিক করে দিয়েছিস!
একবারও কী ভেবে দেখেছিস কতটা অসম্মানে তোর মা তোকে বড় করেছে। যে মাকে তোর বাবা হর হামেশা মাগি বলে। তার ইচ্ছে মত কোন কিছু না হলেই গায়ে হাত তুলে। কখনো ভেবেছিস?
সারা জীবন ব্যর্থ স্ত্রীর দায় বয়ে বেড়িয়েছি। সে ক্ষমতা ছিলো। কিন্তু ব্যর্থ মায়ের দায় আমি আর বইতে পারছি না।
তোর বাবা সব সময় বলতো আমার পরিবার তাকে জাদু করে আমাকে গছিয়ে দিয়েছে। আমাকে নিয়ে সে সুখী না। আমি সেসব সহ্য করেছি। কিন্তু আমি চাই না তুইও কাউকে একই কথা বলবি। আমার সকল স্নেহ দিয়েও তোকে তৈরি করতে পারিনি। শাসন করার ক্ষমতা তো জন্মগতভাবেই পাইনি। আজ তাই সকল ব্যর্থতা নিয়ে চলে গেলাম। যদি তোর এই হতভাগা মার জন্য এতটুকু মায়া হয় তবে পুরুষ না হয়ে মানুষ হোস।
তোর জন্মের আগে চেয়ছিলাম তুই তোর বাবার মত হ। সেজন্যই বোধ হয় আমার কোন ভালোবাসা দিয়েই তোকে বাঁধতে পারিনি। মেয়ে হলে হয়তো মায়ের কষ্টটা বুঝতি। কিন্তু তাতেই বা কী লাভ হতো! হয়তো আমার মত মেয়ে মানুষই হতি, মামুষ হতি না।
0 Comments