শুভ্রনীল সাগর এর সাক্ষাৎকার

 



বামিহাল: লেখালেখির শুরুর গল্পটা জানতে চাই।

শুভ্রনীল সাগর: মজার একটি ঘটনা দিয়ে আমার কবিতা লেখার শুরু! তখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। ছোটবেলার এক সহপাঠিনী ও খেলার সাথীকে দীর্ঘ যোগাযোগহীনতার পর নতুনভাবে পেলাম। তখন দুজনেরই উড়ু উড়ু বয়স। প্রেমের উত্তাল হাওয়া আমাদের ওপর দিয়েও বয়ে গেলো। আমার ওই প্রেমিকা কবিতা লিখত। রোজ আমাকে একটি করে প্রেমের কবিতা দিত আর কঠিন নির্দেশ, উত্তরও দিতে হবে কবিতা দিয়েই! প্রেমের জন্য মানুষ কত কী করেছে কিন্তু আমার মাথায় হাত! ছোটবেলা থেকেই বইয়ের পোকা ছিলাম। কমিকস-গল্প-উপন্যাস পড়ার অভ্যাস থাকলেও পাঠ্যবইয়ের বাইরে তেমন কবিতা পড়ার চর্চা তখন ছিল না। কাজেই ‘কবিতা লেখা’ বড্ড কঠিন হয়ে দাঁড়ালো.. 

যাইহোক, প্রেম বলে কথা! সম্ভব তো করতেই হবে। নেমে পড়লাম কবিতা লেখার মিশনে। তখনও শক্তি-সুনীল-জয়-জীবনানন্দের খোঁজ পাইনি। রোমান্টিক ম্যাগাজিন জোগাড় করলাম কিছু। সেসবে ছাপা হওয়া কবিতাগুলো পড়ে বোঝার চেষ্টা করি, কীভাবে লেখে। অনেক বুদ্ধি খাটিয়েও যখন বাগে এলো না, তখন এক উপায় মাথায় এলো। একটি পছন্দসই কবিতার কাঠামো (স্ট্রাকচার) কপি করে কবিতার মূল বক্তব্য আমার মতো করে রিফ্রেজ (অন্য কথায় ব্যক্ত করা) করে ফেলি। আমার কবিতাজুড়ে নির্মল কাঁচা আবেগের ছড়াছড়ি। অস্বীকার করবো না, ম্যাগাজিনের কবিতাটির কিছু উপমা-উৎপ্রেক্ষা মনে ধরায় সেসবও কায়দা করে ঢুকিয়ে দিই। মানে, প্রভাবিত কিন্তু শব্দে-বাক্যে শতভাগ অনুকরণ নয়। মনের ভাব যতোটা পারি ব্যক্ত করে কিছু একটা দাঁড় করানো গেলো। এভাবেই চললো প্রথম আট-দশটি ‘কবিতা’ চালাচালি.. 

একটি বিষয় তো অবশ্যই ঠিক, সীমাহীন একাগ্রতা ও প্রেম দিয়ে করলে যেকোনো শিল্পকলাই ধীরে ধীরে আয়ত্বে আসতে শুরু করে। প্রথম দিকে ব্যাপারটা কারিগরি পর্যায়ে থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প ও নন্দনের আলিঙ্গন মেলে। সমান্তরালে কবিতা পড়াও বেড়ে গেলো। সব মিলিয়ে, ভেতরে ভেতরে একটা কাব্যিক ঘোর অনুভব করতে লাগলাম। যা দেখি, কাব্যিক লাগে। যা ভাবি, কবিতার লাইন হয়ে যায়। সেই যে কবিতা আসা শুরু হলো, আর যায়নি…

বামিহাল: প্রায় লেখক সম্মানী/রয়েলটির বিষয়ে প্রকাশকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

শুভ্রনীল সাগর: ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নেই কারণ এখনও বই করিনি। তবে লেখক বন্ধুদের কাছ থেকে নানা অভিযোগ শুনেছি। এক্ষেত্রে প্রকাশকদের আরও পেশাদার হওয়া উচিত। 

বামিহাল: কী লিখতে এসেছিলেন? কবিতায় আপনার স্বপ্ন এবং সত্তাকে কতটা ধরতে পেরেছেন?

শুভ্রনীল সাগর: আমার অন্যতম অতি প্রিয় একজন কবি অঁরি মিশো। তার একটি লাইন এমন, ‘অস্তিত্ব আর সময় প্রবাহকে আমি আঁকতে চেয়েছি মাত্র, যেভাবে নিজের নাড়ি টিপে দেখে…’ 
এটা আমারও কাব্য-দর্শন। আমি অস্তিত্বের চেতনা আর যে সময় আমাকে কেন্দ্র করে প্রবাহিত হচ্ছে সেটার অনুভূতি-উপলব্ধিগুলো লিখি। ‘যে সময় আমাকে কেন্দ্র করে প্রবাহিত হচ্ছে’ – কথাটা এইজন্য বললাম, আমি যা চিন্তা করি তাই একজিস্ট করে বা বিদ্যমান। অন্যভাবে বললে, আমি চিন্তা করি বলেই সবকিছু বিদ্যমান। 

‘স্বপ্ন ও সত্তা’ সময় প্রবাহের মধ্য দিয়ে সদা পরিবর্তিত। সেইসঙ্গে আত্মচেতনার খোঁজ তথা পরিভ্রমণ চলতে থাকে। তবে এটা ঠিক, আত্মচেতনার পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ শব্দে ধরতে পারি না, সম্ভবও না বোধহয়! এই মহাশূন্য ও গভীর আত্মচেতনার স্বরূপ কোনো শব্দ বা ছবিতে সম্পূর্ণ প্রকাশ সম্ভব নয় বলে অনুধাবন করি…

বামিহাল: লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে তথাকথিত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার আপনার বিশ্লেষণ কী?

শুভ্রনীল সাগর: প্রশ্নে আগে থেকেই ‘তথাকথিত’ শব্দটি বসিয়ে একটি বিশেষ অবস্থান নিয়ে ফেলা হয়েছে। যাইহোক, আমার উত্তর হলো, বাংলাদেশে যারা ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’র চর্চা করেন বলে দাবি করেন, তাদের ‘প্রতিষ্ঠান’ সম্পর্কেই সম্যক জ্ঞান নেই। ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’র পুরোধা বলে যারা পরিচিত তাদের প্রায় প্রত্যেকেই পারিবারিক, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, নির্দিষ্ট কোনো ধর্মপালনসহ রাষ্ট্রে বসবাস করেন এবং এগুলোর প্রত্যেকটিই প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। মোটা দাগে আলোচনা করছি এবং প্রেক্ষাপট বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ। তাদের ইশতেহারে সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী আগ্রাসনবিরোধী এবং ধর্ম নিরপেক্ষ প্রগতিশীল রাজনৈতিক অবস্থান থাকে কিন্তু সেটিও তাদের কর্ম ও চর্চায় প্রতিফলিত হয় না। সজ্ঞানে ও কাছ থেকে প্রায় দুই দশক বাংলাদেশে ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’র চর্চা দেখার সুযোগ থেকে যেটি আমার মনে হয়, তাদের ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’ মূলত দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা এবং তাদের ঠিক করে দেওয়া ‘লিটলম্যাগের চরিত্র’ ধারণ করে না এমন সাহিত্য পত্রিকাগুলোতে না লেখার বিরোধিতা থেকে। সম্প্রতি অন্যতম এক ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী পুরোধা’-কে বড় এক প্রতিষ্ঠানের পত্রিকার পক্ষ থেকে পুরস্কার নিতেও দেখা গেছে, যাদের বিরোধিতা তিনি আজীবন করে এসেছেন। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বা লিটলম্যাগের চর্চা করতে গিয়ে তারা নিজেরাও প্রতিষ্ঠানের চর্চা করেন, যেখানে সামন্তীয় শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান। 

প্রশ্ন: কবিতা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ কোনো পরিকল্পনা ও তারুণ্যের দায় সমর্পকে জানতে চাই।

শুভ্রনীল সাগর: উল্লিখিত কথাই বলবো, অস্তিত্ব আর সময় প্রবাহকে আমি লিখে যেতে চাই…
আর দায় প্রসঙ্গে, ‘তারুণ্য’ শব্দটি থেকে বেরিয়ে এসে বলবো, সকল সত্তার দায় নিজের কাছে – আত্মচেতনার খোঁজ ও উপলব্ধিতে লীন হওয়া…

Post a Comment

2 Comments

  1. "সম্প্রতি অন্যতম এক ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী পুরোধা’-কে বড় এক প্রতিষ্ঠানের পত্রিকার পক্ষ থেকে পুরস্কার নিতেও দেখা গেছে, যাদের বিরোধিতা তিনি আজীবন করে এসেছেন। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বা লিটলম্যাগের চর্চা করতে গিয়ে তারা নিজেরাও প্রতিষ্ঠানের চর্চা করেন, যেখানে সামন্তীয় শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান। " cheers

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভাইডি অনেক দিন বাদে চোখে পড়লো আপনার অস্তিত্ব

      Delete