গৌতম দত্ত’র প্রবন্ধ


তাপস ওঝার কবিতা চন্দ্রাহত চোরটির কথা নিয়ে আলোচনা 




তাপস ওঝা তার একটি কবিতার বই "চন্দ্রাহত চোরটির কথা এবং অন্যান্য " আসলে তাঁর চতুর্থ বই থেকে একটি দীর্ঘ কবিতা" চন্দ্রাহত চোরটির কথা " নিয়ে আলোচনা
কবি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বেশী  সময়ে কবিতা লেখার সঙ্গে  সম্পাদনার কাজ করছেন।বিশেষত করে  মানসলোকে পত্রিকা টি।যারা পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলো।

মূলত বীরভূমের দুবরাজপুর তাঁর নিজিস্ব ভিত্তি ভূমি। তাঁর লেখায় লালমাটির লোকজন, মাটির গন্ধ, তাঁর গাছগাছালি, তাঁর দিন, রাত, পুকুর, মন্দির, গ্রামের ভিক্ষুক, চোর, রাতের চাঁদ, ধান কল, যুবতী নারী, পুরুষ, কাম, রাগ, হাসি সব এমন ভাবে কবিতা হয়ে যায়, আপনি নিজে  বীরভূমের হয়ে যাওয়া আগেই মনে হবে এটা আমার দেখা।এই সব আমার জানা।
দীর্ঘ দিন লেখার মধ্যে থাকতে  থাকতে  তাপস ওর সময়কার কবিদের থেকে আলাদা, তাঁর লেখনী অন্য রকম বোঝা যায় তাঁর শব্দ চয়ন, দেখা ভঙ্গি, উপমার ব্যবহার আর সংযম।  এই বৈশিষ্ট থাকার জন্য, ওর কবিতা পড়তে পড়তে, পাঠক কবিতার পাত্র হয়ে ওঠেন।
তেমনি এই কবিতা "চন্দ্রাহত চোরটির কথা" এখানে পাত্র একজন চোর, ভিখারি, রাতের চাঁদ আর সাপ। দুবরাজপুর লাল মোরামের রাস্তা। কবিতার বিষয়  গ্রামের ভিখারী সারাদিন ভিক্ষা করে ফেরার সময়ে সদাশিব চোর ঝোলা কেড়ে নিয়ে দৌড় লাগায়। পূর্ণিমা রাতে কিছুদূর গিয়ে চোরটি ঝোলা খুলে দেখে কিছুই  নেই। চাঁদ এই সবাই দেখেছে, কিন্তু সদাশিবকে সাপে কামড়ে দেয়। গাছে উঠে চাঁদ কে ধরতে গিয়ে পুকুরে পড়ে যায়।
এক দীর্ঘ কবিতা পড়তে শুরু করলে শেষ করে উঠতে হয়। এমন লেখা, তাঁর উপমা,
শব্দবন্ধ, তাপস কে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতেই  পারে.

“ভিখারির ঝোলা ভর্তি হয়ে গেছিলো ঘুঙুরের ধ্বনি, আলামাটির বর্ণ আর
দন্ডধারীদের মিথ্যে আশ্বাসে ”
আরো একটি “বিকেলের সজ্জা সেরে আদিনারী জমার্ধ
কাটাতে গেলো শাস্বত প্রথায়.
রাস্তা জানতো না। ফিরলো না”
“ব্যাঙ নেই পাখির নেই এমন কি ইঁদুরও নেই। পেস্টিসাইডে ক্লান্ত ধানক্ষেত ”
এই রকম অনেক অনবদ্য কথা এই কবিতা কে আলাদা করেছে।
শেষ আরেকটি “একটি পতন ঘটে পুকুরের জলের গভীরে।
ত্রস্ত চাঁদ বহুধা বিভক্ত হয়ে, নেমে আসে পুকুরের জলে”
তাপসের কবিতার পরতে পরতে দুবরাজপুর তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে উপস্থিত হলেও
এক মায়াময় জগৎ উঠে আসে। অলীক মনে হলেও সত্যি হয়ে ওঠে। এই জন্যই  সবার অগোচরে  আলাদা হয়ে
ওঠেন কবি তাপস ওঝা। তাঁর বিষয় বস্তু  কথাশিল্পি তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় কে মনে পড়ায়।
এই বইটার প্রচ্ছদ সিদ্ধার্থ গুপ্তের,খুব দৃষ্টিনন্দন। বাঁধাই ও মুদ্রণ খুবই উচ্চ মানের। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং কবি শ্রদ্ধেয় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কে।
এই কবিতা ছাড়া আরো অনেক কবিতা বইটি কে সমৃদ্ধ করেছে। কবি ছুঁয়ে গেছেন সাত এর দশকের সেই মুক্তির দশক করার দিনগুলিতে। গ্রামের সাধারণ যুবক তাঁর যৌবনের দিন নিয়ে একটি ভীষণ প্রিয় কবিতা “গ্রাম, তোর মন” কবিতার প্রথম চারটি লাইন ছবি হয়ে থাকে। “হারান তোর গরুর গাড়ী  ভীষণ জোরে চালা
সামনে তোর বোকা উড়ে যাক
বটের দুধের বক
পেছন দিকে রাঙা ধুলোয় ঢেকে যাক তোর মা
তোর মা’এর চোখের নীল জল সব নদী হয়ে যাক
ডাইনে বাঁয়ে শিয়াল ডাকুক
হাক্বা হুয়া হুয়া ।” আরো একটা না যোগ করলে আধা মফস্বল এলাকার অন্ধকার এলাকা দেখা যাবে না।
“হারানরে তুই দেখতে ভালো চৌকিদারের ছেলে
বিশে বাগ্দীর মেয়ের যৌবন লুটে নিলি বলে
শকুনের শাপে গরু মরে যায়
নিলুবাবুদের মিলে "
এ রকম অজস্র উদাহরণ বিভিন্ন কবিতায় তাপস ছুঁয়ে
গেছেন তাঁর বিভিন্ন সময়, সমাজ, তাঁর সামন্ততান্ত্রিক গ্রামের দিনলিপি। আরো লিখুন কবি। সমৃদ্ধ হোক এই সমেয়র বাংলা কবিতাএবং মূল্যায়ন হোক কবি তাপস ওঝার।

Post a Comment

0 Comments