কবির হোসেন এর কবিতা





পাল্কিতে চড়ছেন পথিকবর


কবরে গিয়ে তো আর মরেন না। ঘরে মরে থাকা আপনার শব, চার দুগুণে আটপা ঘাড়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এতটুকু পথ বাকি রেখেই কেনো আপনাকে মরতে হয়? পৌনে-গন্তব্যে ঘুমিয়ে পড়া খরগোশকে ঘাড়ে তুলে দৌড়ে নিয়ে যাচ্ছে যেন একজোড়া কচ্ছপ। কচ্ছপের দৌড়কে আপনার হাঁটা বলে উপহাস, ভেঙে-ভেঙে পড়ছে আপনার পায়ে, অট্টহাসিতে। ঘর থেকে কবরের দূরত্বটুকুই আপনার না-মাড়ানো পথ, ঢুকে যাচ্ছে অন্যের হিসাবে।


বাকিতে কেটে যাচ্ছে আরেকজনের জীবন; যুদ্ধে হারিয়ে ফেলা যাঁর এক পা এখনও অন্য পা’কে হাঁটা শেখাচ্ছ।







ডারউইনের বাসায় ডেভিড কপারফিল্ড


যতটুকু পেছনে এলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে, ততটুকু পৌঁছে দেখি আমার দেয়ালটা নেই। দেয়ালের খোঁজে আমি পেছন দিকে যেভাবে হাঁটছি, যে কেউ দেখে তাঁর ভেতরে বিশ্বাস গেঁড়ে নিচ্ছেন ভূতের অস্তিত্ব। হারিয়ে যাওয়া সেই দেয়াল, পিঠের কাঙ্ক্ষিত বিছানা যেন, যার ওপর বসে পা দুলিয়ে একজন ঘুড্ডিবালক সুতা গুটিয়ে নিরচ্ছ আমাকে টেনে। সেই সুতার টানে, পেছন দিকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে একদিন বেখেয়ালে এক বটির উপর ধপাস করে পড়ে যাই। দ্বিখন্ডিত আমি লক্ষ্য করি, আমার কোমর থেকে পা অব্দি খণ্ডিত অংশটুকু তড়পাচ্ছে রুইমাছের মত। কিঞ্চিৎ হেসে, দরজায় বসে ঝিমানো এক মা’কে ডেকে বলি—মাগো, এভাবে যেখানেসেখানে বটি দাঁড় করে রাখবেন না, বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। জেগে ওঠা অপরিচিত প্রাচীন মা, মুখে ভার এনে বলেন—বড়শি কেনার টাকা নেই বাবা, তাই দীর্ঘদিন ঘরের কোণে পড়ে থাকা অব্যবহৃত বটিটা উঠানে পেতে রেখেছিলাম।







আমার বিখ্যাত জামাটি


জামাটা পরতে পরতে সেটা আমি হয়ে গেছি, মা। বাবাকে বলে দিও সেটা পরে বের না হতে। আমাকে পরে বাবা বের হলে বন্ধুরা বাবাকে আমার নাম ধরে ডেকে বসবে। আমার ভেতরে বাবা চলে গেলে, স্বামীর খোঁজে তোমার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বিব্রতবোধ জাগবে। তারচে বরং আমাকে তুলে রাখো ঘরের পুরনো হ্যাঙ্গারে। সেখান থেকে নামিয়ে কোলে করে মুখে খাবার তুলে দিও। ময়লা হলে কুসুম জলে স্নান করিয়ে দিও। রোদে শুকিয়ে ফের হ্যাঙ্গারে রাখতে গিয়ে যদি টের পাও তার ভেতরে বিবিধ কলুষ—দাগ, অদৃশ্য ময়লার নানাবিধ দুর্গন্ধ; এবং এইসব কলুষ, ময়লা ধুতে গিয়ে যদি তোমার হাত নুয়ে পড়ে, তার ভেতরে মুখ লুকিয়ে বলো শুধুৃৃ

আমি তো জামা খুলে মাছের দম নিয়ে বসে আছি নদীর তীরে। তাৎক্ষণিক নেমে পড়ব আজীবন স্নানে।







আপেল এবং আয়ু


আপেলের মাংশের পরিমাণ আয়ু নিয়ে বেঁচে থাকে ভেতরের পোকাটি। আপেল খাওয়া শেষ হয়ে গেলে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে তাকে মরে যেতে হয়। আপেলটি কি জানে তাকে খেয়ে খেয়ে আয়ু কমাচ্ছে একটি কীট? যে জেনেছে সে এখন সেজেগুজে বসে আছে বিক্রেতার ঝুড়িতে। যেকোনো দিন কারও হাত ধরে পৌঁছে যাবে কোনো রোগীর উদরে। সে জানে না একজন রোগী তাকে খেয়ে খেয়ে আয়ু বাড়াবে। এ এক রহস্যময় ফল, যার ভেতরে সে ঢোকে তার আয়ু বাড়ে, যে তার ভেতরে ঢোকে তার আয়ু কমে। দুজনেই খাদক, কারো বাড়ে, কারো কমে। আর আপেলের আয়ু?


খুন হওয়াই যার মৃত্যু, আয়ু নিয়ে তার কোনো ভাবনা থাকার কথা নয়।





পান্তা ভাত


মা,দেখো, পান্তাভাত পানসে বেশি বলে লবণও লাগে বেশি। পানসে আর নোনতা সমান সমান হলে খাওয়ায় স্বাদ আসে। একথালা পান্তাভাতে কয়েক চিমটি লবণ, দেখো, ফাইট দেয় কেমন সমানে সমানে। পানসে'কে হারিয়ে নোনতা বিজয়ী হলে, ভালো লাগে না, পানি ঢেলে সমতা আনি। আবার নোনতাকে হারিয়ে পানসে বেশি হলে, নোনতা বাড়াতে হাত বাড়াই লবণের দিকে। কেউ হেরে গেলে ভালো লাগে না, জিতে গেলেও। মা, আমি তো চাই যুদ্ধটা এভাবেই চলতে থাকুক, সমানে সমানে।


এমন একটা যুদ্ধই চলুক যে যুদ্ধ এক থালা ভাত খাওয়াতে পারে।






উন্মাদ


মুরগি কাটতে বসেছি। হাত দিয়ে টের পাই মুরগিটা অনেক গরম। চেতে আছে। কাঁচা হাতে কাটাকুটি করি। কলিজা, আমার পছন্দের পিস, যত্ন করে কাটি। চুলায় তরকারি বসিয়ে, আবর্জনার ঝুড়িতে পলিথিন ফেলতে গিয়ে দেখি, রক্তস্নাত পলিথিনের কোণায় মাথা আর পা ঘুপটি মেরে আছে। বুদ্ধি আঁটছে, এভাবে গোপনে লুকিয়ে থাকবে নাকি দৌড়ে পালাবে? আমি মুরগির পা খেতে পারি না। ঘিন করে। মাথা বিশেষ পছন্দ, মগজ হেতুতে। মাথা ছাড়া পা পালিয়ে গেলে যাক, যতদূর যেতে পারে।

পা না জেনেই হাঁটুক, ভারমুক্ত হাঁটাকে যে ভ্রমণ বলে!







কাফনের রঙ সাদা কেনো


দেয়ালের দূর্বল পলেস্তরা খসে মানুষের একটি সুন্দর অবয়ব ফুটে উঠেছে। অবয়বটা দেখতে কার মত যেন মনে হয়। চেনা চেনা লাগে। কোনো মুখোশ নেই, চামড়া খসে বেরিয়ে এসেছে চেহারার নির্যাস। বিমর্ষ, বিষণ্ণ এক চেহারা, আহতভঙ্গি নিয়ে ছেপে আছে দেয়ালে। চলতি পথে হয়তো কোথাও এক পলক দেখে ত্বরিত মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। এমন দেখা দেখা লাগছে। দেয়াল ঘড়িটা ঠিক বলতে পারবে কার হৃৎপিণ্ড নিয়ে সে চলছে। শুনেছি, শিকারি প্রাণির ছবি গুহার দেয়ালে চিত্রিত করে রাখতেন গুহামানবেরা। আমার দেয়ালে তবে এ কাকে শিকার করে ছেপে রেখেছি?

চেহারাটায় সাদা রঙ দিয়ে মুছে ফেলতে গিয়ে দেখি আমি মুছে যাচ্ছি পৃথিবী থেকে!


       



জালালউদ্দিন রুমিকে


জেনেছি, মৃত মানুষ মূলত বীজ, যা কবরে রোপন করা হয়, মানুষ হয়ে গজিয়েউঠতে। যেহেতু নতুন কবর খুঁড়তে গেলে হাড়গোড়সহ পুরনো একটি কবর আবিষ্কার হয়, আমাকে কবর¯’ করতে গিয়ে, হে রুমি, কার কবরে রোপন করেছিলেন? আমার কবর খুঁড়তে গিয়ে তার হাড়গোড় সরিয়ে কতটুকুইবা তাকে সরাতে পেরেছিলেন? মাটিতে মিশে ছিল অচেনা সে, আমি মিশতে মিশতে গজিয়েউঠেছি তার উর্বরতা নিয়ে—আবার একজন মানুষ হয়ে। আমগাছে শাখা কলম নিয়ে বেড়ে ওঠা লিচুকে আপনি কোন গাছের পরিচয় দিতে বলবেন? শাখা কলমের মতই মিশে গিয়েছিলাম আমি, তাই তো আমাকে আমার-না আমার-না লাগে।

যাবতীয় আয়নাকেই এখন টেলিভিশন লাগে। তাকালেই অন্যের জীবনী দেখি।





ভাড়ায় চালিত পা


নিজের পথটা হারিয়ে ফেলার পর যেখানে থমকে দাঁড়াতে হয়— সেখান থেকে ভিন্ন কোনও পথে যাওয়ার উপায় নেই। যেহেতু প্রত্যেকের পথে হাঁটছে প্রত্যেকের পা, ভিন্ন পথ বলে কিছু নেই এবং অন্যের পথ মাড়ানোর কোনও সুযোগ নেই, থমকে দাঁড়ানোতে গড়ে তুলি পায়ের গ্যারেজ। গ্যারেজ থেকে জুতা নিয়ে পা চলে যায় পঙ্গুদের পথে— হেঁটে আসতে। পঙ্গুর পথে কুড়িয়ে পাওয়া যাপন, যার একটা অংশ ভাড়া হিসাবে জমা হচ্ছে একাউন্টে, তার খরচায় চলছি।

রূঢ় বজ্রপাতের চাপায় এক কিশোর পথিমধ্যে থমকে দাঁড়িয়েছে—হে পা, আসো, অকাল প্রয়াতের বাকি পথটা হেঁটে দিয়ে আসি।

Post a Comment

0 Comments