উপজেলা শহর থেকে গ্রামে ঢোকার মুখে এই বটতলাকে এখন আর কেউ হাটখোলা বলে না, বলে বটতলাবাজার। আগে এই বটতলায় সপ্তাহে দুই দিন হাট বসত, শনি ও মঙ্গলবার বিকেলে। আর এখন সপ্তাহে এই দুই দিন হাট বসলেও স্থায়ী দোকান হয়েছে অনেক। বটগাছকে কেন্দ্র করে তিনদিকে রাস্তার দুই পাশে এখন তিন/চারটা পোশাকের দোকান, মুদিখানা আছে গোটা চারেক, আছে সারের দোকান, ঔষধের দুটি দোকানের পাশাপাশি প্লাস্টিক জিনিসের দোকান, মিষ্টির দোকান দুইটি আর আছে সাত/আটটা পান সিগারেট চায়ের দোকান। অন্যসব দোকানগুলো একটু বেলা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকলেও চা-পানের দোকানগুলো সকাল সাতটা থেকে রাত দশটা/এগারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর সেখানে পুড়ি পিঁয়াজু চায়ের পাশাপাশি বিনোদন হিসেবে চলে ডিস লাইনে এলইডি টিভি। লোকজন বসে বসে সিনামা টকশো দেখে, খবর শোনে। অনেক দোকানে সংবাদপত্র নিলেও পড়ার লোক তেমন একটা নেই। লক্ষণ দাস ওরফে লখাইকে সে হিসেবে অবশ্যই ভিন্ন বলতে হয়। সে দোকানের কোণে টিভির চেহারাটা দেখলেও সংবাদপত্রটাই হাতে টেনে নেয় বিজ্ঞের মতো। গ্রামের হাইস্কুলে ক্লাশ সেভেন পাশ দিয়ে পড়ালেখা বাদ দেয়া লখাই দোকানের বাইরের বেঞ্চে বসে পাঁচ টাকা দামের আট পৃষ্ঠার সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ খবর বিশেষ করে রাজনৈতিক খবরগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ে। রাজনৈতিক খবরগুলো পড়ার পেছনে তার যুক্তি রাজনীতি করতে হলে খবর পড়া বিশেষ দরকার। লখাই আগে রাজনীতি না করলেও বছরখানিক আগে সেখানে নাম লিখিয়েছে, সে এখন দলের সক্রিয় কর্মী। এই বটতলাবাজারের মোড়ে দলের সভা-সমাবেশ হলে সে সেখানে নিয়মিত উপস্থিত থাকে, মিছিলে দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে রাস্তায় হেঁটে গলা ছেড়ে শ্লোগান দেয়। সেই উদ্দেশ্যেই সে আজও এই বাজারে এসে ঘোরাঘুরি করছে, দুপুরের পর মোড়ের ওপর সমাবেশ হবে, হবে মিছিলও। কারণ, ইলেকশন এগিয়ে আসছে, দলকে সংগঠিত করে চাঙা রাখতে নাকি এখন ঘন ঘন সমাবেশ আর মিছিলের দরকার। স্থানীয় নেতারাই বলেছে তাকে, ওপর থেকে নাকি এরকমই নির্দেশ এসেছে।
এদিকে লখাইয়ের বাড়িতেও এক নতুন ঝামেলা শুরু হয়েছে। লখাইয়ের মা বিমলার মন ও মেজাজ ভীষন খারাপ। মন-মেজাজ খারাপের একটাই কারণ, লখাইয়ের বউ নির্মলা বিয়ের প্রথম বৎসরেই গর্ভধারণ করে একটা মেয়ে-সন্তানের জন্ম দিয়েছে। তার অনেক আশা ছিল তার নিজের পর পর পাঁচটা মেয়ের পরে একমাত্র ছেলের বউয়ের ছেলে-সন্তান হবে। সেই মোতাবেক সে ‘নাতি’র জন্য ঘরের পুরনো কাপড় দিয়ে লেপ-কাঁথা তো সেলাই করেছেই উপরন্ত সে কিছু পয়সাপাতি গুছিয়ে সোনার একটা বাজুবন্ধ বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু সে-আশায় তার গুড়ে বালি। ঠাকুমাকে ঠকিয়ে নাতির বদলে তার ঘরে এসেছে নাতনি। আর সে-কারণেই বিমলার মন-মেজাজ খারাপ, সবসময় এ নিয়ে খিটিমিটি লেগেই আছে। আর অন্যদিকে লখাইয়ের দিকের চিত্রটা একেবারে তার বিপরীত ছিল। লখাই মেয়ে-সন্তান হওয়াতেই বেজায় খুশি। খুশি তো খুশি, খুশির চোটের এ পর্যন্ত সারা পাড়াময় প্রায় দশ কেজি মিষ্টি তার বিলানো সারা। এছাড়া আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি তো আছেই। লখাইয়ের এই আনন্দ দেখে অনেকে হতবাকও। কারণ, এ-রকম ঘটনা সত্যি দেখা যায়নি এ এলাকায়। এলাকা তো বটেই অন্য কোথাও শোনা পর্যন্ত যায়নি যে মেয়ে-সন্তান হলে এ-রকম ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতে। আর এতেই লখাইয়ের মা বিমলা আরো বেজায় চটেছে লখাইয়ের ওপর, ‘ক্যারে বাপু, বেটা-ছাওয়াল হলে একটা কথা ছিল। মিয়্যা-মানুষ হইছে তাতি আবার সারা গাঁ মিল্যা মিষ্টি খাওয়ানি লাগবি!... ফুটানি! ফুটানি বাড়ায় পড়বিনি। মিয়্যা আগে বড় হউক। তখন দেখা যাবিনি!’
লখাই মায়ের এই কথায় থোরাই কেয়ার করে মুখ অন্যদিকে ঘোরায়। আর এই পুরো ব্যাপারটায় যে সবচেয়ে চুপচাপ সে হচ্ছে লখাইয়ের বউ নির্মলা। আঁতুড়ঘর থেকে সাতদিন পর বেরিয়ে সে সারাক্ষণ মেয়েকে নিয়েই বিভোর। মাঝে মধ্যে অবশ্য স্বামী ও শাশুড়ির মধ্যেকার তর্কে মুখ টিপেটিপে হাসে। তাও আবার শাশুড়ির অলক্ষ্যে। এছাড়া তার অন্য কোনো ভাব বা ভাষা নেই। আর সে তো অনেক আগেই জানত তার মেয়ে হবে। সন্তান পেটে আসার মাঝামাঝি সময়ে যখন তার স্বামী তাকে একদিন শহরে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল সেদিনই সে জেনে গিয়েছিল তাদের মেয়ে হবে। ডাক্তারেরা নাকি আল্ট্রাসনো করে দেখেছে, কম্পিউটারে ছবি তুলে দেখেছে তার মেয়ে সন্তান হবে। সন্তান হওয়ার উচ্ছাসে দু’জন খুশি হলেও লখাই তাকে বার বার করে নিষেধ করেছে বাড়িতে বা বাইরে আর অন্য কেউ যেন না জানে ব্যাপারটা। বউও সেদিন মুখ টিপে হেসেছিল শুধু। বাড়িতে সারাদিন নির্মলা ছোটখাটো কাজকর্ম আর নিজের যতœ-আত্মীতে সময় কাটালেও রাতে স্বামী-স্ত্রী মিলে অনাগত সন্তানের জন্য ভবিষ্যৎকর্মপন্থা নির্ধারণ করেছে। মেয়ে-সন্তানের সংবাদের কারণে লখাই বাড়িতে মুখ খোলেনি কিন্তু রাতে বউয়ের সাথে কত রকম খুনসুটি কত রকম রং তামাশা আর কত স্বপ্ন বুনেছে তার তারা দু’জন ছাড়া ভাল আর কে জানে?
সে-দিন মাঝরাতে ব্যাথা উঠলে লখাই খানিকটা হতবাক হয়ে যায়। কী করবে না করবে এই ভেবেই ভ্যাবাচ্যাকা খায়। অবশেষে বউ-ই তাকে রক্ষা করে। বউ কাতরাতে কাতরাতে বলে, ‘মায়েক ডাক দেও, মায়েক এট্টু ডাক দেও তাড়াতাড়ি।’ লখাই তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে মাকে ডেকে আনে। মা বিমলা এটা ওটা বউকে জিজ্ঞেস করে। কথাবার্তার ফাঁকে আচমকা ব্যাথাটা থেমে যায় নির্মলার। আর ব্যাথা উঠে নাকি সে আশায় মা বেশখানিকক্ষণ তার পাশে বসে থাকে। লখাইও উপায়ান্তর না দেখে ঘরের এক কোণে চুপচাপ হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকে দু’জনকেই দেখে। বেশ খানিকক্ষণ এভাবে চলার পর ব্যাথার কোনো লক্ষণ না পেয়ে মা বিমলা নিজ ঘরে শুতে চলে যায়। বাকি রাতটুকু লখাই বউকে নিয়ে খানিক ঘুমে খানিক জেগে কাটিয়ে দেয়। সকালবেলা বউ একেবারে তরতাজা হয়েই ঘুম থেকে ওঠে। ব্যাথার কোনো চিহ্ন তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। লখাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বউটা রীতিমতো বাড়ির টুকটাক কাজও করে। যদিও শাশুড়ি তাকে কাজকর্ম থেকে বিরত থাকতে বলে। সকালের খাওয়া সেরে বউটা যখন হাত ধুতে যায় তখনই আবার ব্যাথা ওঠে আচমকা। লখাই তখনো বাড়িতে বসে, বউয়ের মৃদু কাতরানি দেখে বউকে ধরে ঘরে বিছানায় শুইয়ে দেয় মাকে ডেকে আনে। মা দেখে শুনে পাশের বাড়ির পুষ্পর মা, ধলার পিসি, বুঁচির ঠাকুমাকে ডেকে আনে। তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারে আজই বাচ্চা হবে। এ ব্যাথা বাচ্চা হওয়ারই, এটা সকলেই নিশ্চিত। মা বিমলা লখাইকে দাই ডেকে নিয়ে আসার জন্য পিড়াপিড়ি করে। লখাই হন্তদন্ত হয়ে ছুট দেয় বাইরের দিকে। বটতলাবাজারের ওপর গিয়ে সে দেখতে পায় খালি ভ্যান ঠেকিয়ে দবির চা শেষ করে বিড়ির পাছায় টান দিচ্ছে। লখাই কাছে গিয়ে খানিকটা দাবির সুরেই বলল, ‘এ্যাই দবির, চল শহরে যাওয়া লাগবি। আমার বউয়ের ব্যাথা উঠিছে। এখুনি চল, তাড়াতাড়ি কর।’
দবিরের সেদিকে তেমন একটা হয়তো নজর নাই, সে এদিকে নজর না দিয়ে বিড়ির পাছায় টান দিতেই ব্যস্ত থাকে। লখাই কথাটা দ্বিতীয়বার বলার পর একটু ঘুরে বলে, ‘আরে দাঁড়াও বিড়িডা খাত্যে লাগিছি, খায়েলি। এত পাড়াপাড়ি করতিছো ক্যা?’
লখাই দবিরের কথায় কান না দিয়ে ভ্যান নিয়ে টানা দিতেই দবির উঠে তার পিছু পিছু ছুট দেয়। বাড়ি পৌঁছে দেখে এলাহি কান্ড। দুনিয়ার মেয়েমানুষ জড়ো হয়েছে তার বাড়ির উঠানে। বউকে ঘরের বাইরে বের করা হয়েছে। পেশাবখানার সামনে ফাঁকা জায়গায় কাপড় দিয়ে ঘিরে ধরেছে পাড়ার দু’জন মেয়ে মানুষ। লখাই এসব কিছু দেখে থমকে গেল। কাউকে কিছু বলার সাহসও নেই তার। কথা বলতেই যেন ভুলে গেছে। এক সময় সদ্যজাত বাচ্চার ‘ওয়াঁ ওয়াঁ’ শব্দে সে বাস্তবে ফেরে। দেখে ভ্যানয়ালা দবির দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই। ওর দিকে সলজ্জ তাকিয়ে বলে, ‘হেঃ হেঃ হেঃ হয়্যা গ্যাছে, ছাওয়াল হয়্যা গ্যাছে। দবির ছাওয়াল হয়্যা গ্যাছে রে, হেঃ হেঃ হেঃ!’
দবিরও লখাইয়ের দিকে অবাক চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় শুধু। লখাইয়ের ইচ্ছে ছিল তার বউকে শহরের বড় সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাবে। সেখানেই তার বাচ্চা হবে। পাড়ার নীরেন সাহার ছেলের বউকে সেবার নিয়ে গিয়েছিল তারা বাচ্চা হওয়াতে। মাঝরাতে বউয়ের ব্যাথা উঠলে কোনো উপায়ন্তর না দেখে তাকেই ঘুম থেকে ডেকে তার ভ্যানে করে নিয়ে গিয়েছিল। সে যাত্রায় লখাইয়েরও যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানকার পরিবেশ আর ব্যবস্থাপত্র দেখে তখন থেকেই সে পরিকল্পনা করতে থাকে। যত টাকাই লাগুক সে তার প্রথম সন্তানকে হাসপাতলে দেখতে চায়। সে মোতাবেক সে দিনে দিনে টাকা পয়সাও গোছাতে থাকে। নীরেন সাহার ছেলেকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল টাকার ব্যাপারটা কতো কী। শুনে সে অবাক হয়েছিল যে, এমনি হলে নাকি সরকারি হাসপাতালে টাকাই লাগে না। কেবল একে ওকে মিষ্টি খাওয়ানোর খরচ আর কী। আর পেট চিড়ে বের করতে নাকি নার্সদের খুশি করতে কিছু দেওয়া লাগে। রক্তের দরকার হলে রক্তও দিতে হয়। সব শুনেটুনে লখাই সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু সবকিছু পন্ড করে দিয়ে যে এভাবে সাদামাটাভাবেই তার সন্তান জন্মলাভ করবে তা সে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি।
বিমলার মন খারাপ কমে কিনা তা বোঝা যায় না তার কথাবার্তা বা কাজকর্মেও। সে লখাইয়ের মেয়ে-সন্তানকে ইদানিং কোলে নিলেও বেশিক্ষণ রাখে না। আর যতটুকু রাখে ততটুকুর মধ্যে খানিকটা সোহাগ আর বেশির ভাগই গালিগালাচ পেরে বাড়ি মাথায় তুলে রাখে, ‘মাগী আমার শত্তুর হয়্যা আইছে। আমার সতীন... মরদ নাই আবার সতীন!’
ঠাকুমা জোড়ে জোড়ে কথা বলায় মেয়ে প্রথমে হয়তো দুই ঠোঁট ফাঁক করে এক চিলতে হাসে তারপর পরিস্থিতি বুঝে উঠলে কেঁদে ওঠে। কান্নার তোড় জোড়ে হলে বিমলা ও ও ও করে সোহাগ জুড়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত থামাতে না পেরে ছেলের বউকে ডাক পারতে থাকে, ‘ও বউমা, এদিকে আসো তো, দেখো খালি কান্দে। একে একে আমার ছয়ডা ছাওয়াল হলো, একটাও এরকম ছিল না। ও- ও- ও-’ শাশুড়ির রাগ আর সোহাগ মিশ্রিত কথায় বউ খানিকটা মুখ টিপে হেসে মেয়েকে নিয়ে তার কান্না থামাতে উদ্যোগি হয়। এদিকে বিমলা সেদিকে চেয়ে আরো বেশি রাগে না হিংসায় গজ গজ করে তা অবশ্য বোঝা যায় না। লখাইয়ের কাজকর্ম সব লাটে উঠেছে। মেয়েটা জন্মানোর পর থেকে সে যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ মেয়ের পিছু পিছু আর আদর সোহাগে কাটে তার সময়। আর বাড়ি থেকে বের হলে এর বাড়ি ওর বাড়ি, বাজারের ওপর এর দোকান ওর দোকান। হাত পা চোখ মুখে ফুর্তি তার লেগে আছে সবসময়। কোনো রকমে হাতে দু’টো টাকা এলে মেয়ের জন্য এটা কিনো আর মেয়ে বড় হলে কী করবে না করবে তার ফিরিস্তি দেয়া তার বর্তমানের কাজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আগে বটতলাবাজারে দৈনিক সংবাদপত্রে দিনের গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো খুঁটে খুঁটে পড়ত এখন সেটাও তেমন আর হয়ে উঠছে না। কেউ কেউ তাই তার অভাববোধ করছে সেখানে।
২.
সন্ধ্যা থেকেই ভারি কুয়াশা পড়ে। পৌষের শীত নিয়ে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে পাড়াগাঁয়ে গতকালও নেমেছিল রাত। আলগা বাতাসের ছিটেফোটা ছিল না অবশ্য কোথাও। শান্ত আবহাওয়ায় ঝিঁঝিঁ পোকারা ডাকছিল শুধু। সে-শব্দ একটানা বেজে চলেছিল কানের মধ্যে। বউ নির্মলা আর মেয়ের পাশে একই বিছানায় শুয়েছিল লখাই। মেয়েটা জেগে উঠেছিল কিছুক্ষণ আগেই। মেয়ের বয়স দেখতে দেখতে মাস পেরিয়ে গেছে। মেয়েটা তখনো বুকের দুধ খাচ্ছিল চপর চপর শব্দ তুলে। রাতের এই নিস্তব্ধতায় টানা ঝিঁঝিঁ শব্দের মাঝে এই শব্দটা ছাড়া আর অন্য কোনো শব্দ কানে আসছিল না নির্মলার। ঘরের হারিকেনটা টেবিলের ওপর ছোট করে জ্বালান ছিল। সন্ধ্যার পর থেকে ঘরে কারেন্ট ছিল না, প্রতিদিনই এই কান্ড। হারিকেনের লালচে আলো পড়েছিল তখন স্বামী লখাইয়ের মুখের ওপর, লোকটা একদিকে মাথা কাত করে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। সারাটা দিন কোনখানে কোনখানে ঘুরে বেরায়, কাজকর্মের ঠিক-ঠিকানা নেই। বাড়িতে যতক্ষণ ততক্ষণ মেয়েকে নিয়ে খেলাধুলা করে। বাকি সময়টা বাইরে বাইরে আড্ডা দিয়ে ক্লান্ত শরীর মন নিয়ে বিছানায় পড়ে যায়। নির্মলা পূর্ণমনোযোগে স্বামীর মুখপানে তাকিয়ে ছিল তখন। কী মায়া ভরা শান্ত সুবোধ একটা মুখ! কী পরিতৃপ্তির ঘুম! সবাই কি পারে এমনি করে ঘুমাতে?
৩.
হঠাৎ করে আক্রমণটা আসে পেছন থেকেই। বটতলা মোড়ে তখন দলীয় সমাবেশ শেষে নেতাদের সামনে রেখে মিছিল এগিয়ে চলছিল বাজারের মুখে। ঝাঁঝাঁলো শ্লোগান মুখরিত মিছিলে তখন সকলেই ব্যস্ত হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে শ্লোগান দিতে। আচমকা পর পর দুই রাউন্ড গুলির শব্দ। তখনো সামনের দিকের নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দিকে, পেছনের কথা হয়তো তাদের মনেই আসেনি। হঠাৎ করে পেছন থেকে সামনের দিকে দু-চারজন করে সামনের দিকে ছুটে এগিয়ে যেতে থাকলে প্রায় সকলেরই হুঁশ হয় তখন। গুলির মুহূর্তে পেছন থেকে কেউ একজন মুখ থুবড়ে পড়ে রাস্তায়। সামনের কর্মীরা ছুটে এগিয়ে গেলেও তখনো পেছনের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পড়েছিল হতবিহŸল হয়ে। রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়া কর্মীটাকে দু-একজন তাকিয়ে দেখে চিৎকার করে উঠেছিল, ‘ল-খা-ই!... লখাই গুলি খাইছেÑ লখাই গুলি খাইছেÑ’
একটা ককটেল বিস্ফোরিত হলে মুহূর্তে বাজারটা ফাঁকা হয়ে যায়। শুধু পড়ে থাকে গুলিবিদ্ধ প্রাণহীন লখাই। একটা গুলি লখাইয়ের মাথার পেছন দিক দিয়ে ঢুকে বাদামী রঙের ঘিলু বের করে ফেলেছে রাস্তায়, অপরটা পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক ফুটো করে দিয়েছে। লখাইয়ের নাক-মুখ দিয়ে রক্তের চিকন কয়েকটা ¯্রােতের ধারা নিচের দিকে নামছে, আর তার মাথাটা একপাশে কাত হয়ে যেন তাকিয়ে আছে দূর মাঠের দিকে। বাতাসেরও আগে খবরটা লখাইয়ের বাড়িতে পৌঁছলে লখাইয়ের বউ নির্মলা উঠানের ওপর একটা পাক খেয়ে টলে পড়ে, আর সাদা থানের আঁচল মাটিতে ছেঁচড়ে লখাইয়ের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে তার বিধবা বৃদ্ধা মা।
0 Comments