“যারা শান্তির জন্য শান্তিনিকেতনি স্টাইল চিন্তা করেছেন, সেই সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তির পাঠশালাগুলো দাতাগোষ্ঠীর বুদ্ধি বিক্রির কারখানায় পরিণত হয়েছে। বিলেতি পয়সা, শিক্ষার্থীদের পয়সা দিয়ে পাঠশালার মালিকদের আখের দিনদিন সমৃদ্ধির দিকে গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।... বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অশোভন রাজনীতির চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। নিজেদের অধিকার, শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নের চেয়ে পড়াশোনা যেনতেনভাবে শেষ করে চাকরি কিংবা ক্ষমতাবাজি করে সমাজে তৃণমূল মানুষকে দমিয়ে রাখতে শিখছে, চর্চা করছে।”
হয় না, কিছুই হয় না হয়তোবা অনেক কিছুই হয়। সমাজ সুশৃঙ্খলভাবে চলতে গিয়ে স্বাভাবিকের কিছু অস্বাভাবিক অবস্থা হতে পারে। যখন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ার পরিণতি শেষ মুহূর্তের কাছাকাছি চলে যায় তখন কেবলই বিনাশ হতে থাকে। ভেঙেচুরে যায় সমস্ত কিছু। এর জন্য দায়ী প্রচণ্ড ভোগবাদিতা, পুঁজির সাম্রাজ্যের প্রতি আকৃষ্ট থাকা, অসম ও অপসংস্কৃতির প্রতি মুগ্ধ হওয়া, মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলা, শিক্ষাহীন একটি জাতির বেড়ে ওঠা, উদ্দেশ্যপ্রবণ ও সহিংস রাজনীতি করা, মিথ্যার জালে আদর্শকে বেসাতি রূপে হাজির করা, রাষ্ট্র উদাসীন হয়ে-উপায়হীন হয়ে চলা, সময়ের অস্থিরতার সাথে মানুষ তাল মেলাতে না পারা, অন্যদিকে দুর্বৃত্তায়ন, দখলদারিত্ব নিয়ে সমাজে অসমতার বিকাশ। এ-সকল মূলের ঘটনাটি হলো, সমাজে একধরনের অবক্ষয় বিরাজ করা।
তখন আর কিছুই থাকে না, হয়তো সংশোধনের একটি পথ থাকে নয়তো ধ্বংস। কিংবা পুনর্বিন্যাস। যা কিছু এগিয়ে যাওয়া অথবা হারিয়ে যাওয়া- এর পুনর্রুদ্ধারের চেষ্টা করা।
এমন কিছু অবক্ষয়ের নমুনা হাজির করা যেতে পারে। কথা বলা যেতে পারে। হয়ত প্রাসঙ্গিক কিংবা অপ্রাসঙ্গিক। যা-ই ভাবি না কেন সমাজ তো শ্রেষ্ঠ মানুষদের পছন্দ করে। শ্রেষ্ঠটা হয়তো মুখোশ? হয়তোবা আবার নাও হতে পারে। এই যে এক দুদোল্যমানতা। এটি শুধু অস্থিরতা। অস্থির সমাজে অল্পতে সন্তুষ্ঠ হওয়া যায় না। আরো চাই...
পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ মানুষ যাদেরকে জানি, তাদের কিছু দাবি থাকে। আপনি ভালো হয়ে চলুন কিবা নাই চলুন। আপনি সমাজকে কিংবা পরিবারকে ভালো রাখুন। যদি আপনি দায়িত্ববান হয়ে থাকেন তবে অনেক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব বর্তাতে গিয়ে আপনি কি-রকম সৎ হয়ে থাকবেন। হয়তো পারবেন না। এই দেশের এমন পরিস্থিতিতে পারবেন না। যদি না আহামরি ক্ষমতাবান কিংবা চালবাজ কিংবা ধূর্ত না হয়ে থাকুন।
এ সমাজে বৈষম্য বাড়ছে তো বাড়ছে। সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক, মানসিকও। যে মানুষটি পিছিয়ে পড়া ছিল অনেকদিন, যদি সে চালাকি করতে পারে তাহলে সে অসম ক্ষমতা নিয়ে কর্তৃত্ব ফলাবে। যে জ্ঞান, দক্ষতা, মেধা নিয়ে কাজ করতে চাইবে, সে যদি ক্ষমতাবান না হয় তখনতো সর্বনাশ। সে পিছিয়ে পড়তে পড়তে ঝরে পড়বে।
ভাবনা-চিন্তা, উন্নত চিন্তা, উন্নয়নের চিন্তা, অন্যের চিন্তা, মঙ্গলের চিন্তা কোনোটাই যদি না থাকে, তাহলেতো বুঝবেন অবক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে ঐ মানুষটি অমানুষ হয়ে ওঠছে। সমাজের সকল কাঠামো উলোট-পালোট হয়ে যাবে। দেশ পাবে না কোনো সুশৃঙ্খল জাতি।
ঐ যে কবি বলেছেন, ‘আমার অরূপের ঘর/রূপের ঘরে তাই মন নেই।’ ঈশ্বর ত্রিপাঠীর পঙক্তিগুলো থেকে অনুধাবন করে নিতে চাই, আমি যে ভাবছি, কেমন ভাবনা আমার। আমি তো অরূপের মাঝে থেকে কীভাবে রূপের কথা চিন্তা করবো!
এমন উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ার সময়ে এই অবক্ষয় সমাজে অপরাধ বাড়িয়ে দেয়। এর জন্য আমাদের রাজনীতি অনেকাংশে প্রভাব বিস্তার করে। বিবেকবান মানুষের অভাব হওয়ার কারণে এমনটা ঘটে। এমন রাজনীতি হয়।
শিক্ষার অভাব, শিক্ষার কাঠামো আমাদের দেশে অনেকাংশে শক্তপোক্ত হয়ে দাঁড়ায়নি। এই ঠকে যাওয়া জাতির জন্য শিক্ষা তৈরি হয়েছে ব্যবসায়িক বিদ্যাপীঠ হিসেবে। যারা শান্তির জন্য শান্তিনিকেতনি স্টাইল চিন্তা করেছেন, সেই সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তির পাঠশালাগুলো দাতাগোষ্ঠীর বুদ্ধি বিক্রির কারখানায় পরিণত হয়েছে। বিলেতি পয়সা, শিক্ষার্থীদের পয়সা দিয়ে পাঠশালার মালিকদের আখের দিনদিন সমৃদ্ধির দিকে গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিজেরা আরাম আয়েশ চিন্তা করে এমন ধূর্ততার সাথে চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অশোভন রাজনীতির চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। নিজেদের অধিকার, শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নের চেয়ে পড়াশোনা যেনতেনভাবে শেষ করে চাকরি কিংবা ক্ষমতাবাজি করে সমাজে তৃণমূল মানুষকে দমিয়ে রাখতে শিখছে, চর্চা করছে।
ওদিকে ঠকে যাওয়া জাতির জন্য অপেক্ষা করছে মৌলিক অধিকারে অন্যতম চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার অনন্য অধিকার। কোথাও মানবিক সাহায্যের সহজ চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা মিলবে। তাও আবার শ্রেণি বিশেষের বিশেষ ব্যবস্থায় একটা অবস্থা তৈরি হবে। বিশেষ অনুদান ও রাষ্ট্রের চিকিৎসা ক্ষেত্রকে দুর্বল করে গড়ে ওঠছে ব্যবসায়িক চিকিৎসাকাণ্ড। দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষ সহজে মরে যেতে পারে, নিষ্পেষিত হতে পারে। মেরুদণ্ডহীন জাতিতে পরিণত হতে হতে দেশ, সত্তা সব এক সময় আমরা বিকিয়ে বসি কিনা!
আমাদের মৌলিক অধিকারের অন্যতম খাদ্যের অধিকার। দরিদ্র-ক্ষুধার্তরা খাই একবেলা, কিংবা সিকিপেটা হয়ে পড়ে থাকি। কিংবা অনাহারের সয়ে যাওয়ার কৌশল রপ্ত করেছি। আমি ভিখেরি, ভিক্ষে ছাড়া আমাকে কেউ খেতে দিবে না। পেলেও ভেজাল, বিষাক্ত, পরিত্যক্ত খাবার। তাতে মরণফাঁদ অপেক্ষা করছে। তাহলে যে আপনারা বলছেন, খাদ্য নিরাপত্তা, নিশ্চয়তার দুর্দান্ত বুলি। সেগুলো কেমনতর কথা। ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’। এই সম্পূর্ণ খাবারটি কি আমার জন্য ভালো হবে, না পুষ্টিহীন জাতিতে পরিণত হবো। কারণ ভেজাল খাবারের পর আমার জন্য অপেক্ষা করছে ভেজাল ঔষধ, ভেজাল চিকিৎসা পদ্ধতি।
এই ঠকের বাজারে বুদ্ধির মাল বিক্রি করেন যারা তথাকথিক বুদ্ধিওয়ালারা, তাদেরও রাজনৈতিক জ্ঞানকাণ্ড নিয়ে হাসি আসে। বুদ্ধির বিকাশ কিংবা মুক্তি কোনোটাই আজ পর্যন্ত হয় নাই। সর্বোচ্চ গণমাধ্যমের কলাম বাণিজ্য কিংবা টক-শো নামক চটপটি খাবারের প্রতি লোভ-লালসায় লালায়িত হন। ফলে কী ঘটে? জাতি বিভ্রান্ত নিয়ে ঘুমুতে যায়, সকালে অন্যরকম বিভ্রান্ত নিয়ে ঘুম ভাঙে।
ওদিকে ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তি, হানাহানি, সহিংসতা, দ্বিধাবিভক্তি সবই স্বার্থবাজ রাজনীতিকদের দুর্বল প্রতিফলন। যা আমাদের দিনদিন পঙ্গু করে দিচ্ছে। এর মূলেও রয়েছে অপরিপক্ক শিক্ষা ব্যবস্থা। সেখানে মারাত্মকভাবে অবক্ষয় বিষাক্ত সাপ হয়ে বড় হচ্ছে। একদিন ছোঁবল দেবে, কঠিন ছোঁবল।
আমরা যারা সাহিত্যকর্মি, তাদের কাছে সাহিত্য পরম ধন। তাই বেশি বেশি নীতির কথা বলতে পারছি। তখন বলতে পারতাম না যখন সাহিত্যে ভেজাল করতে শুরু করবো। অমুকের লেখা তমুকের হয়ে ছেপে গেল, তমুকের কবিতা অমুক মেরে দিল। হাহাকারময় লেখাগুলো বেশি বেশি লেখা হলো। ভাষার বিকৃতি, কথার বিকৃতি, সাহিত্যের বিকৃতি করছেন যারা, তাদের তো কিছুই হয় না। হয় কেবল বাণিজ্য, মিডিয়াবাজী। সামান্য খ্যাতির ক্ষত। এই তো জীবন। কী হয়, কী লাভ? কবিতার মানুষ হয়ে গল্পে, গল্পের মানুষ খেলায়, অর্থের মানুষ সমাজ বিক্রির পুরস্কার পেয়ে। পুরস্কার পেয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভেদাভেদ ভুলে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েন। অপরাধী হয়ে যান। অবক্ষয়ের মাত্রা মাথায় নিয়ে সমাজ, দেশ ধ্বংসের পাঁয়তারা করেন।
পরিশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো একটি প্রশ্ন করতে চাই,
‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে।/আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।’
3 Comments
হয় না
ReplyDeleteকিছুই হয় না হয়তো
ধন্যবাদ। সাথেই থাকুন।
Deleteঅতঃপর শান্তি নিকেতনের কবিতা পঙতিই শেষ ভরসা।
ReplyDeleteতবে চিন্তার নবায়ন নয় দরকার পরিবর্তন।