‘সমুদ্র পাশাপাশি দুটো জাহাজ/ জল জানে, ঝড় কি জানে/ ভেসে থাকার মানে?’ মানে নামীয় কবিতায় কবি সরকার আমিন এমনটি বলেন। কবি সরকার আমিনের দ্বিভাষিক কাব্যগ্রন্থ সেক্স এন্ড স্পিরিচুয়াল কাব্যগ্রন্থভুক্ত এই কবিতার রেশ ধরে বলা যায় জীবন কি জানে জীবনের মানে?
সেই মানে খুঁজতে যাই বলেই হয়তো আমরা কতিপয় সংবেদনশীল মানুষ কবিতার ঘোরে কাটিয়ে দেই এক জীবন। মানে খুঁজতে যাই বলেই নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও পতঙ্গের মতো আগুনে ঝাঁপ দেই। আমাদের আটকানোরও তে কেউ নেই। ফলে যা হবার তাই হয়ে যায়।
যেমন কবি-সম্পাদক ফারুক সিদ্দিকী বত্রিশ বছর ধরে বিস্ময়করভাবে একটি গুরুগম্ভীর কবিতার কাগজ ‘বিপ্রতীক’ করে গেলেন। কোনো মানে হয়! হয়তো কোনো মানে হয়। আমিন ভাই ফারুক ভাইকে বলেন এর মর্ম হয়তোবা আমরা বুঝছি না। তাই হয়তো ইহলৌকিক কোনো প্রতিক্রিয়া আপনি দেখছেন না। কিন্তু আমার বিশ্বাস পরলৌকিক কোনো না কোনো প্রতিদান আপনি পেয়ে যাবেন। আমিন ভাইয়ের কথা শুনে ফারুক ভাই বগুড়াস্থ অধুনালুপ্ত ভাই ভাই বই ঘরের চেয়ারে একটু নড়ে চড়ে বসেন। তার মুখে স্মিত হাসি। আমিন ভাইয়ের কালো ফ্রেমের চশমার ভেতরে চোখে ঝিলিক দেয়া আনন্দ। তাঁদেরকে ঘিরে আমরা কতিপয় কবিতা-পাগল তরুণ। আমি, মাহমুদ শাওন, প্রান্তিক অরণ্য, ঈশান সামী প্রমুখ।
অনন্ত সুজন হন্ত দন্ত হয়ে আসরে ঢুকে পড়ে। এতক্ষণ সে এখানে ছিল না। আমাদের বিস্ময়কর এ বন্ধু এরকমই। চীর চাঞ্চল্য সুরে বলে ওঠে ‘তাহলে আসর জমে উঠেছে। কিন্তু আমাদের এখনই উঠতে হবে।’ আমার হাত ধরে আসর থেকে বের করে সপ্তপদী মার্কেটের আলো আঁধারীতে নিয়ে যায়। মানি ব্যাগ বের করে পাঁচশত টাকার একটা নোট আমার পকেটে ঢুকে দিয়ে বলে, আমি জানি তোর কাছে কোনো টাকা নেই। মেহমানের যেন কোনো অসম্মান না হয়। আমি কিছু বলি না। আজ টিউশনির টাকা পাওয়ার কথা ছিল। পাইনি। সুজন এসব বোঝে কী করে? ভাগ্যিস! অনন্ত সুজনের স্পষ্ট কথা, এখুনি এখান থেকে আমিন ভাইকে বের করে আন। রিকসা করে সোজা বারপুরের চৌরাস্তায় নামবি। ওখানে চাটাই দিয়ে ঘেরা এক চায়ের দোকান আছে সেখানে আমিন ভাইকে চা খাওয়াবি। চাটাই দিয়ে ঘেরা বলে অবহেলা করিস না। ওরকম চা তোরা জীবনে খাসনি। আমি আসছি। আমিন ভাইকে বিশাল ধানখেতের ভেতরে বিকেল দেখাব।
আমি বলি ওদিকে তো আমার এলাকা। দেখার কিছু নেই।
সুজন বলে, যা বলি তাড়াতাড়ি তাই কর।
আমি তাই করি। ষাটোর্ধ ফারুক ভাইয়ের সাথে তখন আমিন ভাইয়ের দারুণ জমে উঠেছে। আমি ফারুক ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে আসর থেকে আমিন ভাইকে বের করে আনি। ফারুক ভাই শর্ত দেন পরের দিন তার আতিথেয়তায় দই খেতে হবে সবার। আমরা সানন্দে রাজী হয়ে যাই। সময়টা এই শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে।
বারপুরের চৌরাস্তায় আমাদের রিকসা থামে। আমরা ভাঙা চাটাইয়ের দোকানে বেঞ্চিতে বসি। আমিন ভাইয়ের ভেতরে কোনো সঙ্কোচ নেই। আমি বলি, সুজন বলেছে এ দোকানের চা নাকি অসাধারণ।
আমিন ভাই বলেন, সুজন যখন বলেছে তখন অসাধারণ না হয়ে পারে না।
আমিন ভাই চায়ে চুমুক দিলেন। তারপর সেই স্বর্গীয় হাসি দিয়ে বললেন, ফ্যানটাসটিক। মুনাকে এই চা খাওয়াতে পারলে খুব খুশি হতো। আমার কন্যারা এখনো চা খাওয়া শেখেনি।
চা শেষ হতে না হতেই সুজন এলো। আমরা সদল বলে উঠে পড়লাম। সুজনের নেতৃত্বে আমাদের অভিযান শুরু হবে। শুরু হলো আইল দিয়ে ধান ক্ষেতের ভেতরে হাঁটাহাঁটি। সূর্য তখন ডুবি ডুবি ভাব। আকাশে হালকা আবীর। দূরে বহুরঙা মেঘের ওড়াউড়ি। চোখের সামনে ধানক্ষেত। দূরে তাকালে আলো আঁধারী। কুয়াশামাখা গোধূলি। আমিন ভাই বলে ওঠেন, ওই গোধূলি মাখা আলো আঁধারিই কবিতা। দিনের রোদ কবিতা হতে পারে না, তাতে যত রঙই থাকুক।
আমরা হাঁটছি তো হাঁটছি। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। কেউ কেউ ফিরতে চাইলো। সুজন বলল, আমরা ফিরব মধ্যরাতে। ফিরতে সমস্যা হবে না। জোসনা উঠবে। তোমরা তো এসব খবর রাখো না।
সত্যি আমরা এসব খবর রাখি না। কখন চাঁদ ওঠে, কখন পূর্নিমা, কখন শুক্লপক্ষ, কখন কৃষ্ণপক্ষ। হাঁটতে হাঁটতে আমরা এক বাড়ির সন্ধান পেলাম। এই গহীন ধানক্ষেতের মধ্যে এরকম একাকি কোনো বাড়ি থাকতে পারে তা ছিল সবার ভাবনাতীত। সুজন সবই জানে। কী এক নামে ডাক দিলো সুজন। কয়েকবার। বের হয়ে এলো এক সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ। হাতে তাঁর একটা বাঁশি। জানলাম এ বাঁশি সবসময় তাঁর সাথে থাকে।
সুজনকে দেখে এক অমায়িক হাসি দিলো। সন্ধ্যার আলো আঁধারি যেন নিমিষেই দূর হয়ে গেল ওই হাসিতে। সুজন বলল, ঢাকা থেকে বড় কবি এসেছে। আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। ততক্ষণে তিনি জেনে গেছেন কে বড় কবি। প্রকৃত কবি প্রকৃত কবিকে চিনতে ভুল করে না। তিনি আমিন ভাইয়ের সামনে এসে প্রণামের মতো করলেন। আমিন ভাই খুব বিনয়ের সাথে তার সাথে একাত্ম হয়ে গেলেন।
তিনি বললেন, ‘গরীবের ঘরে চাঁদের আলো এসেছে আজ। কীভাবে যে সম্মান করব। ভেবে পাচ্ছি না।’ তার কথার ভেতরে বাংলা এবং অন্য ভাষার সংমিশ্রণ। এবং অপরিচিত এক টোন। আমরা শুধু বিস্মিতই হচ্ছি।
তিনি উঠোনে মাদুর পেতে দিলেন। আমরা সবাই বসে পড়লাম। তিনি বাঁশি বাজাতে শুরু করলেন। কী যে অপূর্ব। কচি ধান ক্ষেতেরও এক ধরনের গন্ধ থাকে। মাটির গন্ধ তো আছেই। ততক্ষণে আকাশে প্রকান্ড চাঁদ উঠে চারিধারে দুধ সরোবর করে ফেলেছে। বাতাস এসে আমাদের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। বকুল ফুলের ঘ্রাণ এসে মাতোয়ারা করে দিচ্ছে চারপাশ। অথচ এটা স্থানটি যেন ধান-সাগরের দ্বীপ।
বাঁশি বেজেই চলেছে। আমিন ভাই, মোবাইল বের কররেন। মুন্নী আপাকে ফোন দিয়ে বললেন, মুনা বাঁশি শোনো...কিছুক্ষণ পর বললেন, আমার কন্যাদেরকে ভালোবাসা দিও।
আমাদের সবার একটি প্রশ্ন। কে উনি। এই নিঃসঙ্গ চরাচরে এরকম বাস করা চাট্টিখানি কথা নয়। আমিন ভাই বলেই ফেললেন, কে আপনি। আমি অভিভূত..
বৃদ্ধ হাসলেন। কী নিষ্পাপ সে হাসি। তারপর আকাশের দিকে তাকালেন। বললেন, উনিই জানেন আমি কে? তিনি উঠে পড়লেন। ঘর থেকে একটা একতারা অথবা দোতারা নিয়ে এলেন। কিছুক্ষণ টুংটাং টুংটাং আওয়াজ তুললেন। থামলেন। আবার আওয়াজ তুললেন। বৃদ্ধের ভেতরে এক ধরনের অস্বাভাবিকতা ভর করতে থাকল। তিনি যেন কোনো কিছুর ভেতরে লীন হতে চাচ্ছেন। তারপর টুংটাং আওয়াজ ক্রমশঃ বাড়তে থাকল। বাড়তেই থাকলো। একসময় হঠাৎ থেমে গেল। তখনই তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি আমার মা বাবার প্রেমের ফসল। বিয়ের নয়।’ টুংটাং আওয়াজ উঠলো। আওয়াজ থেমেও গেল। ‘এটা নিয়ে আমার কোনো গ্লানি নেই। আনন্দ আছে। গর্ব আছে।’
এরপর তিনি সুর তুললেন তার বাদ্যযন্ত্রে। একটা কীর্তন গাইলেন। আমাদের কেউ কেউ তার সাথে সুর মেলালো। গান থামলে বললেন, ‘আমার জন্ম করাচিতে। বাবা ছিলেন ঝাড়–দার। দেখতে সুদর্শন। তার প্রেমে পড়ে গেলো শহরের এক ধণাঢ্য অভিজাত ব্যক্তির কন্যা।’
আবার কীর্তন শুরু হলো। শেষ হলো।
‘কন্যার গর্ভে একটি সন্তান এলো। বিষয়টি জানাজানি হলো। কন্যার বাবা ঝাড়–দারকে খুন করতে চাইলেন। অপমান করলেন। গুন্ডা ভাড়া করে মারলেন। কিন্তু মেরে ফেলতে পারলেন না।’
এবার শুরু হলো গজল। তালে তালে হেলে দুলে নাচ। চাঁদ তার দুধ সরোবর আলো উজাড় করে দিচ্ছে। আমরা তাঁকে দেখছি। তিনি চোখ বন্ধ করে গানের সাথে লীন হয়ে আছেন। আমরা আমিন ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছি। আমিন ভাই আমাদের দিকে তাকাচ্ছেন। আমরা আমাদের দিকে তাকাচ্ছি। আমরা আমাদেরকে চিনতে পারছি না। আমরা যেন আমাদেরকে ভুলে গেছি।
গজল শেষ হলো। তিনি বললেন, ‘ঝাড়–দার জখম হয়েছিলেন। সেরে উঠে তিনি ওই ধণাঢ্য ব্যক্তিকে খুন করলেন। তার অন্তসত্তা কন্যাকে নিয়ে চলে গেলেন দূরে কোথাও। একদিন তার ঘরে এক সন্তানের জন্ম হলো।’
আবার টুংটাং। আবার গজল। আবার কীর্তন।
‘একদিন জানাজানি হয়ে গেলো তাদের ঠিকানা। ধনাঢ্য ব্যক্তির আত্মীয় স্বজন এসে জোর কোরে তাদের কন্যাকে নিয়ে গেলেন। ঝাড়ুদার এক হাতে ঝাড়– আরেক হাতে তার সন্তানকে নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পালিয়ে এলেন।’
বৃদ্ধের বাদ্যযন্ত্রের তারগুলো বেজে উঠলো আবার। আবার শুরু হলো গজল। আবার কীর্তন।
‘একাত্তর সালে ঝাড়–দার মারা গেলেন। আমার বাবা। বাবা গো...’
বৃদ্ধের চোখে জল। ‘শুনেছি সেই ধনাঢ্য কন্যা তার হারানো সন্তানের জন্য পাগল হয়ে গেছে। আমার পাগলি মা...।’
আবার শুরু হলো গজল। আবার শুরু হলো কীর্তন।
‘আমার মা এখনো বেঁচে আছে..। আমার আশায়। আমি তাাঁকে দেখতে যাব। কিন্তু যেতে পারছি না। আমি জানি না কীভাবে যেতে হয়।’
আমরা দেখি আমাদের প্রত্যেকের চোখে জল। চাঁদের আলো সেখানে এসে আরো চাঁদ হযে যাচ্ছে।
বৃদ্ধের সুর থামলো এবার। বৃদ্ধের স্বর থামলো এবার। আমিন ভাই বললেন, ‘আপনি এক পবিত্র মানব। কবিতার যথার্ত সংজ্ঞা আজ আমরা জানলাম।’
সব হয়তোবা শেষ হয়। আমাদের বিস্ময় শেষ হয় না। আমরা সে-উঠোন ছেড়ে উঠি না। বৃদ্ধও সে-উঠোন ছেড়ে তার ঘরে যান না।
আমরা বসে থাকি আর অপেক্ষা করি কবে শেষ হবে এই পবিত্র বৃদ্ধের অপেক্ষা। আমাদের অপেক্ষা শেষ হয় না।
দুই
আমরা হয়তোবা ওখান থেকে ফিরে আসি। হয়তোবা ফিরে আসি না। আমিন ভাই বলেন, ‘ভাবি আমি মনে মনে প্রেমও তো জমজম!/ প্রেম সূত্রে সেরে যায মনের জখম।’
আমিন ভাই আরও বলেন, ‘এত রক্ত কোথা থেকে আসে/ লিখতে বসলে কান্নাগুলি হাসে।’
আমরা সেই জখম ও জমজম নিয়ে বাস করি যার যার জগতে। রক্ত আসে, রক্ত হাসে, রক্ত এসে আমাদের পাশে বসে।
আজ কবি সরকার আমিনের জন্মদিন। জন্মদিনে কত কথা মনে পড়ে যায়!*
*কবিতাগুলো কবি সরকার আমিনের দ্বিভাষিক কবিতার বই ‘সেক্স এন্ড স্পিরিচুয়াল ’ থেকে নেওয়া।
3 Comments
ভালো লাগলো
ReplyDeleteভালোলাগলো
ReplyDeleteধন্যবাদ। সাথেই থাকুন।
ReplyDelete