মজিদ মাহমুদ এর গল্প





এটি ছিল এপ্রিলের শুরুর দিকের একটি গুমোট দিন শেষে গরম ক্লান্তিকর ও আদ্র এক সন্ধ্যা। রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরির পরে আমরা কিছুক্ষণের জন্য জনপথ হোটেলের কফি লাউঞ্জে বসেছিলাম; আর খুব আয়েশ করে দু’জনা কফির কাপ উজাড় করছিলাম।
মনে হচ্ছিল যেন একটি যুগ আমাদের ধীর উদ্দেশ্যহীন চুমুকের মধ্যে হামাগুড়িয়ে দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল, আর তিক্ত শূন্যতার তলানিটুকু পশ্চাতে পড়ে থাকছিল।
ওম প্রকাশ ওরফে ওম আমায় দ্বিতীয়বার কফি ঢেলে দেয়ার চেষ্টা করল।
ও কিছুটা খালি হয়ে যাওয়া কাপে দুধ ঢেলে দিতে যাচ্ছিল; আর তখনই আমি বলে উঠলাম- ‘না, না দুধ দিতে হবে না’।
ও বলল, ‘চিনি?’
আমি বললাম, ‘তাও না।’
‘ব্ল্যাক কফি’?
‘হু।’
ওম প্রকাশ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, ‘ঠিক রুশদের মতো।’
আমার মন এমনিতেই নিজের ওপর বিগড়ে ছিল; ফলে এর জবাব দিতে ইচ্ছে করল না।
এক সময় আমি ওমের জীবনের এই হাংলামিকে ঘৃণা করতাম। আমি এমন মারাত্মক কিছু বলতে চাচ্ছিলাম যাতে তার বাইরের এই ভণ্ডামির তৃপ্তিটুকু ধারালো ছুরির আঘাতে টুকরো হয়ে যায়। এ ধরনের মুহূর্তে তার সতর্ক-চর্চিত নাগরিকতা আমাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছিল। সব কিছুই যেন একটি উন্মুক্ত স্বচ্ছ আবরণের মধ্যে দেখা যাচ্ছিল; বড়জোর আধইঞ্চি ফাঁকের মধ্য দিয়ে।
তবে আমি যখন একটি টুকরো করি; না, এমনকি তখনো আমি কোনো টুকরো করি না, একটি সোজা, তীক্ষ্ন রেখা, অনেকটা অস্ত্রোপচারের ছুরি দিয়ে মসৃণ লাইন টানি- আর সুতা কাটার মতো করে সেটি দেখি; আর পরিশেষে আমার বিরক্তির জন্য অনুতপ্ত হতে শুরু করি।
আসলে ওর কাছ থেকে আমি কি প্রত্যাশা করেছিলাম? সম্ভবত উষ্ণ ভালোবাসার একটি মনোরম বাড়ি; আর নিজস্ব অধিকার নিয়ে ওমের বুকে একান্ত মাথা রাখা, চার দেয়ালের মধ্যে নিরাপদ ও নিরাপত্তা, বই ও মিউজিক; আর সম্ভবত এ ধরনের আরো অনেক কিছু।
আর এসব এখনো না হয়ে থাকলে তার সবটার জন্য ওম একাই দায়ী, কারণ সিদ্ধান্ত সর্বদা ও একাই নিয়েছে।
যখন আমরা কাপে তৃতীয়বার কফি ঢালছিলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।
ওম তার ঘড়ির দিকে তাকালো।
সেই সময় হয়তো কোনো কিছু হঠাৎ দৃষ্টিগোচর হওয়ায় তার নাকের ওপর বরাবর কপালের মাঝখানে ভাঁজ দেখা দিল। নিঃসন্দেহে এটি কোনো কিছু যে তাকে বিহ্বল করেছে তারই ইঙ্গিত বহন করে।
অধিকাংশ সময় সে পুরোপুরি নিজেকে সংবরণ করে চলতে পারে; আর যে-কোনো পরিস্থিতি সে সামাল দিতে পারে; এমনকি রোমান্টিক চেতনার সেতুবন্ধের মধ্যেও ছুঁয়ে থাকার দূরত্বে থেকেও নিজের ওপর সে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে।
যে কারণে তার ঘনকালো ভ্রু ও কপালের দিকে দ্রুত আমার চোখ চলে যায়; আর আমার হৃদয় তার প্রতি কোমল হতে থাকে।
‘এই, কি হলো তোমার; হঠাৎ পাল্টে গেলে যে?’
‘না; তেমন কিছু না।’
আমি বাকা হেসে বললাম, ‘তোমার কি আর কোথাও যাওয়ার কথা ছিল; হঠাৎ মনে পড়েছে; নাকি?’
একজন নারী আপাতভাবে তার মায়ের জরায়ুর মধ্য থেকে এ সব ছলাকলা নিয়ে বেড়ে ওঠে। সে তার পুরুষকে কিভাবে সন্তুষ্ট করতে হয় তা জানে। সকল ক্ষেত্রেই সে কিছুটা ছাড় দিয়ে থাকে; এমনকি তার প্রতিবেশি কিংবা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আনন্দ কিংবা বেদনা ভাগাভাগি করার সময়েও তাকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়। এই ছাড় দেয়াকেই কি তারা নারীর প্রকৃতি বলে অভিহিত করে থাকে? এটি কি অসম্মানের? এটা কি দুঃখজনক? কিন্তু কেন? কেন একজন নারী তার এই ত্যাগের জন্য মূল্য পাবে না?
ওম খুব তস্ত্র হয়ে বলল, ‘না, না’।
‘তাহলে’?
সে কিছুটা ধাতস্ত হলো, স্মিত হেসে বলল, ‘তুমি যে ভাবে অনুমান করছ! তুমি কি জ্যোতিষী নাকি’?
ওমের হাসির সাথে তার সামনের দু’টির দাঁত থেকে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ল। কিন্তু বাকি দাঁতগুলো হলুদ বালির মতো সাধারণ ও কুৎসিৎ।
ওমের গোপন উৎকণ্ঠা তার কপালের ভাঁজ ঢাকতে পারেনি; কিন্তু সামনের দুটি দাঁত তা পেরেছে। আর ওম ময়ূরের মতো পুচ্ছনৃত্য ছাড়াই আমাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করেছে। তার হাসি দিয়ে সব অপরাধ ঢেকে দিতে পেরেছে; আর আমার সারা শরীর মোমের মত তার হাসির কাছে গলে পড়ছে।
‘না, এটি কোনো জ্যোতিষশাস্ত্র নয়; আমি একজন সচেতন মানুষ।’
‘ওহ; ঠিক আছে, নিশ্চয় সচেতন।’
‘তাহলে আমাকে বল, তুমি আসলে কি চিন্তা করছিলে? তুমি কি তোমার সবজান্তা বাবার কাছে কিছু গোপন করতে পারবে?’
‘আমি শুধু ভাবছিলাম, সাড়ে সাতটা বেজে গেছে; এখন সিনেমা বা থিয়েটারে যাওয়ার সময়ও তো নেই। আমরা কোথায় যেতে পারি?’
আকাশে কালোমেঘ দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এটি যেন শান্ত প্রকৃতির রাগের প্রকাশ। অসন্তোষ ও অসহায়ত্বের প্রকাশও হতে পারে। এই লোকটি একটি ঘরের পরিবর্তে আমাকে দিয়েছে রাস্তা; পরিণত করেছে যাযাবর, ঘরহীন ভবঘুরে।
তবে আমার ভেতরের নারীত্ব, যে কিনা একজন দক্ষ অভিনেত্রীও বটে, সে অবশ্য আমাকে সতর্ক করেছে; আমি ঠোঁটে লিপিস্টিকের মতো হাসি টেনে বলেছি, সাবধান হও; ‘নিশ্চয় আমার জন্য কোনো ঘর আছে, হে পৃথিবীর মালিক; আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলে ঠিকই এসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে।’
ও অট্টহেসে বলল, ‘চল।’
‘তুমি কি আমাকে গোল্লায় যেতে বলছ?’
‘বেশ তো চলো।’
সে ওয়েটারকে বিল দিতে বলল, বিল পরিশোধ করে বাকিটা ফিরিয়ে নিলো, যদিও তা করার কথা নয়; হয়তো পরবর্তী খরচের কথা মাথায় রেখে করে থাকবে। আমি নিজেকেও তার হিসাবের খাতায় দেখতে পেলাম।
আমরা উঠলাম এবং বেরিয়ে পড়লাম।

তবে তখন পর্যন্ত আমাদের কাছে সে প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিল না যে, বাকি সন্ধ্যাটা আমরা কোথায় কাটাবো।
সে ট্যাক্সি ডাকল এবং বলল, ‘আমরা রানুর ওখানে যেতে পারি।’
‘কিন্তু তুমি তো বললা সে এমপি’র বাংলো ছেড়ে গেছে।’
‘আমি জানি, ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে কালু তার জন্য অন্য একটি বাড়ি দেখে দিয়ে গেছে। আমি তার ঠিকানা জানি।’
কালু ওমের বন্ধু। তার খৃষ্টান নাম বেশ জটিল, যেটি আত্মার মুক্তির জন্য দাদাদাদিরা রেখে থাকেন। যাই হোক, তার সকল বন্ধু তাকে কালু বলেই ডাকে।
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, চলো যাওয়া যাক।’
যাই হোক, এই সন্ধ্যায় এসব নিয়ে ভাবার সময় ছিল না; দেখা যাক ভাগ্য কোথায় নিয়ে যায়।
ট্যাক্সিটা বিশাল এক বাংলোর সামনে দাঁড়ালো- নিশ্চয় এটি আরেকটি সরকারি বাংলো। আমরা গেটের ভেতর দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। বাড়ির সুবিশাল ও প্রাণহীন লনের ঘাসগুলেতে বাদামি রঙ ধরেছে। শুকনো ঘাসের অপরদিকে বিশাল গাছের ডালপালায় কুঞ্জবীথি রচিত হয়েছে। গাছটির আশেপাশে লনের চারিদিকে কেমন যেন সুনসান ভৌতিক নীরবতা।
ওম বাড়ির পেছনের দরজায় কড়া নাড়ল। রানু দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘ভেতরে আস। তোমরা হঠাৎ কি মনে করে আজ এ বাড়িতে পা দিলে?’
ওম বলল, ‘হঠাৎ করে নয়। আগেই তোমাকে দেখতে আসার কথা ভেবেছিলাম।’ ওমের সঙ্গে রানুর এসব কথা হচ্ছিল কক্ষে ঢোকার চৌকাঠের গোড়ায়। আমি তাকে অনুসরণ করছিলাম। বাইরের তরুছায়া রানুর চুলে ঢেউ তুলছিল। তাকে কিছুটা বিষণ্ন ও চিন্তিত মনে হচ্ছিল।
এই কক্ষটি হয়তো এক সময় লাকড়ি ও কয়লা রাখার জন্য ঘোষেল ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হতো; কিংবা যারা রান্নাবান্না ও ধোঁয়ামোছার কাজ করতো তাদের জন্য নির্ধারিত ছিল।
রানুর রুমটি বেশ ছোট; তার খাটেই অর্ধেকটা ভরে গেছে; বাকিটাতে একটা বৈদ্যুতিক চুল্লি, বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি কাপপিরিচ ছড়িয়ে আছে; তার পাশে খালি জ্যাম ও কফির পাত্র পড়ে আছে, সেগুলোর মধ্যে লবন শুকনো মরিচ ও মশলাজাতীয় কিছু রাখা আছে। এসবই কেমন যেন নোংরা হয়ে আছে।
যে চুলা জ্বলে না, ঠাণ্ডা ঝুলকালিযুক্ত, সেকি মারাত্মক কষ্টের নয়? এ ধরনের পরিস্থিতি দুর্ভাগ্য ও অভিশপ্তময়ই বলা চলে।
তার রুমটিতে পুরনো দিনের স্বাক্ষর হিসাবে এখনো রয়ে গেছে একটি মখমলের লেপ- যার রঙ বিবর্ণ হয়ে গেলেও সদ্য নিভিয়ে দেয়া চুলার কয়লার তপ্ত অবস্থার মতো কিছুটা উষ্ণতা ও উজ্জ্বল্য রয়ে গেছে।
এছাড়া তার কক্ষে একটি রেডিও রয়েছে। রেডিওটি কালু তার প্রেমিকাকে দিয়েছিল- যখন তারা বাপমার অমতে বিয়ের জন্য পালিয়ে এসেছিল। এই গল্পটি অবশ্য তার বন্ধুরা বলেছে।
রানু সাধারণ পরিবারের মেয়ে। চণ্ডীগড় সচিবালয়ে সামান্য টাইপরাইটারের কাজ করার সময়ে সে কালুর অগাধ সম্পদ ও নিয়মাফিক প্রেমপ্রকাশে বিমোহিত হয়ে পড়ে। অবশ্য সে যখন এই উচ্চতর ভাবজগত থেকে নিচে নামে তখন সে কয়লা ও কাঠ রাখার এই ক্ষুদ্র কক্ষে নিজেকে আবিষ্কার করে।
কালু তার স্ত্রীকে একবারই বিলেতে নিয়ে গিয়েছিল। এটি অবশ্য স্ত্রীর প্রতি এক ধরনের ঘুষই বলা যায়। যখন কোনো স্বামী তার স্ত্রীর কাছে কোনো কিছু লুকায়; তখন তার ক্ষতিপুরণ হিসাবে স্বামী তার স্ত্রীকে এমন কিছু বেশিই দিয়ে থাকে, যেটি উপপত্নীর জন্য করতে হয় না। উপপত্নীকে কেবল খাবার, পোশাক ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়েই তুষ্ট থাকতে হয়। এই মেকি ভালোবাসা থেকে সৃষ্টিকর্তাও এ ধরনের মহিলাদের রক্ষা করতে পারেন না।
আমরা রুমটিতে ঢোকার পর সেটি যেন আরো ছোট হয়ে আসছিল। রুমটির সীমিত বায়ু আমাদের তিনজনের শ্বাস নেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। রুমটি কোথায় এমন কিছু রয়েছে, যা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা তৈরি করছিল।
ওম খাটের মাঝখানে বসে হাতের ওপর মাথা রেখে রানুর উদ্দেশ্যে বলল, ‘তো কি খবর?’ আমি বিরক্তি নিয়ে খাটের এক প্রান্তে বসে পড়লাম।
রানু চুলার পাশে টুলের ওপর বসা ছিল। সে কিছুটা ঔদাসীন্যের সাথে বলল, ‘ এই যেমন দেখতেই পাচ্ছ।’
‘কোনো চিঠিপত্র আসছে?’
‘দিন দশেক আগে একটি এসেছিল।’ রানুর কণ্ঠে ওই মাত্র দশদিন শব্দটির মধ্যে একটি হতাশা ও শূন্যতাবোধার প্রকাশ দেখা দিল।
‘আর সব কিছু ঠিকঠাক চলছে?’
‘হ্যা চলছে।’
‘আর তুমি কেমন আছ?’
‘আমি?’ হঠাৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রানু ওমের দিকে তাকালো।
‘তুমি কি ভালো আছে।’
‘আছি বই কি!’ তার অশ্রুসজল কণ্ঠ যেন কোনো এক শান্ত পুকুরের তলদেশ থেকে ধ্বনিত হচ্ছিল।
কিছুক্ষণের জন্য পুরো কক্ষে নীরবতা নেমে এলো। মধ্যরাতের বায়ুমণ্ডলকে ভেদ করে ছুটে চলা মোটরযানের সাইরেনের শব্দ থেমে গেলে যে ধরনের নিঃষÍব্ধতা গ্রাস করে অনেকটা ঠিক সেরকম। কিংবা বিস্ফোরণের মাঝখানে আরেকটি শব্দ শোনার জন্য কানে যে নীরবতা বিরাজ করে।
‘কালু যে পত্রটি পাঠিয়েছিল তাতে তাকে অনুরোধ করা হয়েছিল কালু যে লাগেজটি প্লাটজর্মে ফেলে গিয়েছিল সেটির ওপর নজর রাখতে।’ ওম একটু মুচকি হাসল।
‘তাই নাকি!’ পাউডারের গুড়োর মধ্যে অভেদ্য অন্ধকারে যেন তার কণ্ঠস্বর নিপতিত।


আমি আড়চোখে ওমের দিকে তাকালাম। তাকে উত্তরের জন্য হাতড়ানো খুব অস্বাভাবিক। রানুর চোখে কোথায় যেন অবিশ্বাসের ছায়া ছিল; এবং আমি সংঘাতের আভাস দেখতে পেলাম।
ওম তার চ্যালেঞ্জকে পাশ কাটিয়ে গেল; এবং তার অবস্থান বদল করে বলল, ‘তোমাদের বাড়িতে মেহমান এলে তোমরা কি তার আদর- আপ্যায়ন করো না?’
‘চা তৈরির মতো দুধ নেই।’
‘তুমি যদি সব খেয়ে না ফেল তাহলে যা আছে তা দিয়েই তো চা বানানো যেতে পারে।’
‘ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। আমি আজ ভোরে দুধ আনতেই যাইনি।’
‘কেন?’
‘এই ছোট ও গুমোট কক্ষে আমি এতটাই বিরক্তবোধ করি যে সারারাত ঘুমাতে পারি না; আর সকালে যখন ঘুমাই তখন দুধের দোকান বন্ধ হয়ে যায়।’
আমি রুমটির চারিদিকে দেখলাম। আমার চোখ চলে গেল বদ্ধ দেয়ালের দিকে; যেখানে কোনো জানালার উপস্থিতি নেই। মনে হচ্ছিল, জানালার ভেতর দিয়ে আলোবাতাস ঘরে আসার ব্যাপারটিই যেন এখানে রহিত হয়ে গেছে। পেছনের দেয়ালের একটি দরোজাও মনে হয় চিরদিনের জন্য বন্ধ। সম্ভবত অন্যপাশের বাড়িওয়ালা এটি করেছে।
রানু যখন কালুর সঙ্গে পালিয়েছিল, রানু তখন ভাবতেই পারেনি, এত অগাধ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও কালু তাকে থাকার মতো একটা গৃহ দিতে পারবে না।
‘একটু হুইস্কি নিয়ে আস।’
‘হুইস্কি-ওয়ালা বিলাতে গেছে; এখন খালি বোতল ছাড়া কিছু নেই।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রানু বলল, ‘এটা কি ঠিক?’
ওম ভেড়ার মতো হেসে উঠলো। কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে এলো। বলল, ‘তুমি সারাদিন কাটাও কিভাবে?’
‘রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে।’
‘কোন কোন রাস্তা শেষ করলে?’
‘আমি তাদের নাম মনে রাখিনি।’
‘খুব বেশি বেশি রাস্তায় ঘুরো না। তুমি কি জান, রাস্তায় একা ঘুরে বেড়ানো মহিলাদের কি বলে?’
‘কি বলে?’
ওম হাসতে হাসতে বলল, ‘পথবেশ্যা।’
আমি কেঁপে উঠলাম এবং রানুর দিকে তাকালাম। তার মুখাবয়ব পরিত্যক্ত রাস্তার মতো মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল রানু যা বলছে, তারা তা করছে না। সম্ভব করেও না। সে হয়তো অন্য কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিল।
আমি ওমের দিকে তাকালাম; আর মনে মনে ভাবলাম ওম একজন ধর্ষকামীর মতো নিষ্ঠুর হতে পারে।
এই মুহূর্তে আমার জন্য সবচেয়ে সঠিক ছিল, রানুর পক্ষ নেয়া; কারণ সেও আমার মতো একজন বাড়তি মহিলা হিসাবেই পরিগণিত। এ ধরনের মহিলারা ঝামেলা করে না। ঝামেলা করার অধিকার শুধু থাকে স্ত্রীদের। আমাদের মতো মহিলাদের পুরুষদের সঙ্গে ঝামেলা করা অনেকটা কানাগলিতে আত্মহত্যার জন্য ঝাঁপ দেয়া। আমার ভেতরের সুবিধাবাদি সত্বা আমাকে চুপ থাকতে উদ্বুদ্ধ করলো।
আমরা আবার কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ রইলাম।
ওম আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা এখন যেতে পারি?’
হ্যা। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। রানুও তাই করলো।
রানু বলল, ‘তমি যখন এরপর তাকে চিঠি লিখবে তখন তাকে বলতে ভুলো না যে হাসান চার/পাঁচ দিন পরপর এসে তাকে বিশ রুপি দিয়ে যায়। এটাও বলবে যে, আমি না খেয়ে মরতে বসেছি।’
খুব সতর্কতার সঙ্গে ওম বলল, ‘হাসান এখানে আসে?’ হাসান তার বন্ধুর খামার দেখাশোর কাজ করে।
‘হ্যা। কালু তাকে আসতে বলেছে।’
রানু দরোজা খুলল। বদ্ধ ঘরের বাইরে পরিত্যক্ত লনের মুক্ত বাতাস ভালো লাগছিল। শ্বাস-প্রশ্বাসে আরাম বোধ হচ্ছিল।
কোনো কথা না বলে আমরা তিনজন লন পেরিয়ে গেটের কাছে আসলাম। বাইরের রাস্তা আলো ঝলমল। মৃদুমন্দ বাতাস; নরম আলো।
আমরা রানুর কাছ থেকে বিদায় নিলাম; বললাম, ‘আচ্ছা, যাই।’
রানু অস্ফুট স্বরে বলল, ‘শিগগির আবার এসো।’
রাস্তায় সুনসান নীরবতা। মনে হয় এখানে অত গাড়িঘোড়া চলে না। রাস্তার দুপাশের বড় বড় গাছের তৈরি অন্ধকার পুরো রাস্তাটিকে যেন গিলে ফেলেছে।
মৃদু বাতাস বইছে। ধীর হেঁটে গাছের নিচে দাঁড়ালাম। ভয়ে আমি কুঞ্চিত হয়ে গেলাম। মনে হলো গাছগুলো থেকে চাপা কান্না ভেসে আসছে।
‘এটা কি?’
‘কিসের কি?’
‘কেউ বোধহয় কাঁদছে।’
‘কোথায়?’ ওমা বলল।
‘কোথাও না।’
এই কান্নার ভেতরে আমি অবিরত হাঁটছি।



অলঙ্করণ: চারু পিন্টু
মূল: অজিত কৌর; ইংরেজি : সুধীর; বাংলা : মজিদ মাহমুদ

Post a Comment

0 Comments