শিবলী মোকতাদিরের ৫০ তম জন্মদিন




শিবলী মোকতাদির, নব্বই দশকের অন্যতম কবি ও প্রবন্ধিক। আজ ১১ জুন কবির ৫০তম জন্মদিন। ১৯৬৯ সালের এই দিনে বাংলাদেশের বগুড়ায় জন্মগ্রহন করেন। চিন্তা চেতনায় কবিতা-অন্ত প্রাণ শিবলী মোকতাদির দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়ান সর্বক্ষণ। ইতিমধ্যে তাঁর ৬টি কাব্যগ্রন্থ ও ৩টি প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কাব্যগ্রন্থগুলো হলো__ ধানের রচনা দিলে পত্রে, নিষিদ্ধ পুষ্ঠির কোলাহল, সোনার কার্তুজ, ব্যবহারিক বিস্ময়, কায়া ও কৌতুকী।
প্রবন্থগ্রন্থ__ ছন্দের নান্দনিক পাঠ, রৌদ্র বঞ্চিত লোক, ছন্দ কথা।
কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছে বগুড়া লেখক চক্র পুরুস্কার।
কবি’র ৫০তম জন্মদিনে বামিহালের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা।



.....................................................................................




গুচ্ছ কবিতা

শিবলী মোকতাদির


নাবিকের গান

যে গল্পের পরিশেষে হরিণ দিয়েছে ধরা; তুমি বলো_ তারপরে?

যেন এক বিদুষী বালক রাশিতে মিথুন হয়ে এলে
পালকীতে পালকীতে দস্তা-তাবিজের মহারূপে 
এলে তস্কর, তুর্কি তরুণীর প্রলোভনে
স্নিগ্ধ অবগাহনের বাতাসে বাক্যঝরা দিনে

একে একে পুত্র আর কন্যা তার বিবাহ আলোর ঘোরে
থেমে যাবে সব; সমষ্টি বাক্য প্রয়োগ জলের
সেই থেকে কর্তা তুমি চলিত নিয়ম চলে

যে পুত্র তোমার কৃষ্ণ হয়ে যায়
তারে আজ কোন প্রতিভায় ছাতার নিয়মে সবে ছাত্র দিয়ে গড়ো?
অভিমানে, যেন লবণের প্রলোভনে তারে বলো;

কত ক্ষুদ্র আর ক্ষণিকের সেই দেশে
চিত্রিত দ্বীপের কালে-কালে কত ভূগোল ভাসিয়া যায়
সেথা অচেনা নাবিক দেখ, জটিল কম্পাসে তার;
কত গান ফুটে আছে ঝলোমলো
পরিচিত পল্লবে পল্লবে আরও...


রাজা ব্যক্তিগত

রাজা ব্যক্তিগত, নিরোধক, প্রজা প্রথায় বিভাজিত
ফিকে যে প্রেমিক, তুমি তার মৌলিক সংক্রান্ত
রাজা সিদ্ধান্তের, শোকে সংকেতে, রাগে প্রজ্বলিত
লঘু সমর্থনে, আঁধারে রঙিন, ইতিহাসে যুগে যুগে
রাজা নির্বাচনে, গ্রহণে-বর্জনে, কাহিনীকেন্দ্রিক দৃশ্যে নিবেদিত
দিবসের সমাগমে মাত্র নিচু মদে বিনীত বাঁকের বিশেষণে
রাজা মনোনীত, প্রাচীন-প্রবীণ, চিরদিন আর নিদ্রাহত
সমাহারে উচ্চাবচ, ব্যক্ত সারা দলে_ জেগে থাকা ছিন্ন নকশালে
রাজা আরোপিত, সমগ্র জনকে, বহু ধর্মে সহজাত
সমকালে ভাসা-ভাসা ছত্রে, নিরাপদে, বামে বাতিল ধারাতলে
অনুজ-অগ্রজ দুইতীরে আঁকাবাঁকা উদ্ভাসিত দীর্ঘ বাকশালে
রাজা বরাবর, রেখাচিত্রে, দেহের দ্রবণে নিয়োজিত
সমবেত ভ্রান্তি, যুক্তি, যথা_ আগামি আলোর বিকশিত টাকশালে
যেন ঊর্ধ্ব দিয়ে নিম্নে গড়া ধাতুর ধরণে নীতিগত
বিশেষ্য-বিশেষণে তিনি সর্বহারা, স্থানে প্রস্থানে সবিনয়ে আন্দোলিত
রাজা সূত্রমতে, সময়-সূচিতে, মুখে মুখে আংশিক রঞ্জিত



কৃতী

আবার মরীচিকা ফিরে এলে নাকি রাত্রি পথপাড়ে
দেয়ালে বর্ণবাতি জ্বালোতারপর দুহাতে তুলে
চলো, নিয়ে যাই খালি দেহ সৌরভ আর ফুলে
শুয়ে দিই শান্ত, এইভাবে বুকে নিয়েছিলে যারে

যেখানে শাদা মাঠজুড়ে শীতের তারা উড়ে যায়
খুরের আঘাতে ধূলিকণা। আমার সমস্ত পোশাক
উড়ে গিয়েছিল নীল মেঘে। আর বালুচর থেকে লাখ লাখ
কচ্ছপ উঠে এসে তাদেরই সাথে আমাকে জড়ায়

তবুও পৃথক আমি_ রজনীর পাশে হামাগুড়ি দিয়ে এসে
দাঁড়িয়েছি নগ্ন, সহযোগী বাতাসের বর্শাকে বিঁধে
করেছি লোমশ ছাল পরিধান, মাংসটুকু রেঁধে
খেয়েছি দুজন_ আমি আর মৃতরাত আধাআধি হেসে

ঘুমিয়েছি বেশ, তখনই শীতের রাত্রি আমাকে তুলে
চালিত করেছে নীলক্ষেতে, উঁচু-নিচু চুন আর পারদের পাশে
সেখানে বিচিত্র নৌকো, ধুলোঝড়, মেঘে মন্ত্র ভাসে
যায় ধাতুকণা দিয়ে হাতে_পালিয়ে রাত্রি উপকূলে

সেদেশে তীব্র বেগ। ঝাঁজালো নির্গত গ্যাস, হয়তো-বা
আরও কঠিন ফুটন্ত জলাশয়ে বহুকাল শুয়ে ছিল তারা
রূপালি আগুন গায়ে জ্বেলে দেখি লাল চাঁদে যারা
বসেছিল আমাকে কেন্দ্র করে অনন্তকাল কৃতী বিধবা




বালিকা বিদ্যালয়

ধুলো কিংবা তুলোবাণিজ্যে লাভ হবে কোনটি?
এই নিয়ে আশায় আক্রান্ত ভাববাদী বিয়ে না করা লোকটি
নানান চিন্তা কাজের ৎপরতায়, বিবিধ ব্যথায়
প্রচ- রৌদ্রে, ঝড়ে, বিফল বজ্রপাতে
আহাম্মকের মতো বসে আছে ঘাসের কার্পেটে মৃদুমন্দ প্রভাতে

সেইখানে যাবতীয় ধ্যানের ৎস হতে দূরে
কুয়াশাগড়া গ্রাম, অসৃজন মাঠ
কিছু কিছু হাট জেগে ওঠে পায়ে পায়ে ঘুরে
সরু আর সরলতায়, বিবিধ নদী, তারা না বোঝে নদের অগ্রগতি
সেথা আচ্ছা আচ্ছা পারাপার, হাতে মাখা জাত পরশ দিয়েছো যদি!

ধরি, শিশুতোষ করে বন আছে বনানীর কোণে
আছে পশুতে পয়মাল হয়ে, স্মৃতি কি বাজলো অনুরণনে?
ভয় আছে, আরও আছে রাগী-অনুরাগী দরবেশে ছেয়ে
বট-পাকুড়-পলাশের উপঢৌকনে, হাহাকার বেয়ে
আমাকে ধরতে এসে ওহে বাতাস, হচ্ছো মর্মরিত
এসবই তরঙ্গযান রোজ রোজ তোমাকে জানাতো
অথচ লোকটি দেখতে অসহায়
ধরে তো কারক আলগোছে বিভক্তি ছুটে যায়
ফলে_ সব জ্বলে, জলে জ্বলে জাগ্রত অযথায়
কী ছলে হিয়ার মাঝে গোপনে যাপন করে অনাগত বালিকা বিদ্যালয়!


ডাক্তার

এমন শ্রাবণে
হাসপাতালের পাশে ভাঙাচোরা ট্রাক,
পড়ে আছে বহুদিন

তাদের চুপসে যাওয়া চাকার নিচে ছত্রাক
আশেপাশে রক্তমাখা তুলো, ব্যান্ডেজ...
কিছুটা দুর্গন্ধ, অভিমানী নার্সদের সাথে তার 
চূড়ান্ত প্রকাশনা, অসাধ্যের ছড়াছড়ি

তবু এই নির্জন বসন্তে
প্রতিদিন মেডিক্যাল ছাত্ররা দলবেঁধে আসে, তাই_
ঝুঁকে পড়ে তারা ট্রাকদের দ্যাখে

ঘন চৈত্রে
ভাঙাচোরা ট্রাকগুলো পড়ে থাকে বহুদিন।        


গমন

চূড়ায় নেমেছে চাঁদ, মাহেন্দ্র বনের আশেপাশে
আর তুমি প্রতত্নবিদ_
রক্ষিত ধানের ব্যাকুল বাতাসে ভেসে এলে

যদি আসে গণিত শিক্ষিকা 
নিবেদিত অন্ধকারে, সভ্যতার তৈজসপত্র ভেঙে যায়

ভাসে যদি বেনজিন সংকেত 
ধরোনিমগ্ন গ্রামের পথে;
গার্হস্থ্যবিজ্ঞান ফেলে ছাত্রী চলে যায়



ভ্রমণকাণ্ড

বনে, পাহাড়ে, সাগর কিংবা মরুভূমিতে আমরা_লোকেরা 
কারণে, অকারণে ঘুরে-ঘুরে বেড়াতে যাই। 
এইসব খবরে আমার ইচ্ছা মাঝেমাঝেই ঈর্ষিত হয়। 
কিন্তু অশ্ব আমার নিরুপায়। 
এইরূপ ভ্রমণে কতিপয় ছোলা সে বেশি চায়। 
আমি তো গরীব চাষী। অঙ্কে ফেল। 
এই যে নাইন-টেনশোন, সূত্র সদাই শুয়ে। 
দু-মুঠো ছোলার হিসাব এই দুর্দিনে
দুর্ভিক্ষের রাতে কী করে মিলাই?

এই শুনে বনের এক পরিচিত বাঘ 
পাহাড় থেকে অনেক পাথর এনে, বিক্রিত অর্থে 
সাগর থেকে উচ্চাঙ্গের সুরা এনে দিয়ে 
বললো_যা, মরুভূমিতে যা
এত এত সুরা সারাদিন শোষণ করে 
মরুভূমিতে মাতাল হয়ে পড়ে আছি আমি, অবশেষে। 

ভ্রমণে ক্লান্তি থাকে_ 
এই কথা, প্রিয় হিউয়েন সাং, কেন তবে বলোনি আগে


গ্রামগঞ্জের হাটে

পথ দিয়েই যেতে হয় রোজ, একা, এই লোকটিকে
কারণ যা কিছু আছে ধীরে ধীরে হয়ে আসে ফিকে
রোজ দেখি মাথায় নিয়েছে কিছু। সামলিয়ে একহাতে
অন্য হাত -কাঁধ--কাঁধ করে। কোমর বাঁকে না তাতে

করুণা হয় করা তো উচিত কিছু। ফের ভাবি যদি মারে?
এই ভয়ে হয়নি যাওয়া গৃহে। নিকটে কিংবা তার দ্বারে
দূরে বসে হাট সন্ধ্যা সমাপ্ত হলে। এত ক্রেতা, লাগে অদ্ভুত
সে ছিলো বিক্রেতা। তবে মানুষ নয়, তুলোয় জড়ানো ভূত!



শিরোনামে সম্পাদিত

প্রচলিত অণুর ভিতরে অনুবাদে জেগে আছো
নিরীহ গানের সুরে 
দক্ষিণে সে স্বরচিত নারী, পাশে প্রশ্নে জর্জরিত
দ্বিধাগ্রস্ত সহকারী

দিয়েছো শ্রাবণ, সেই ফাঁকে ঘটনায় শান্ত নদী
তার চেনা মুগ্ধ বাঁকে
বিপরীতে ভুল, মন্দভাবে ধেয়ে আসা ধৃত মেঘে
ছায়া তবু ভেসে যাবে

যদি-না বাতাস সমর্থনে ঘিরে রাখে একতায়
করে মেঘ অন্য মানে
ফলে তারা দেহের পশ্চাতে দলে-দলে ভ্রাম্যমান
দৃশ্যায়িত আজ রাতে

দূরে থাকে বাঁকা বনভূমি, শাদা শ্রাবণ রঙে
বিবিধ গঠনে তুমি
আলোচ্য আকাশে তবু ডাকো স্নিগ্ধ হাতছানিতে
বর্ষা ঋতু যার টানে

রূপকে রূপের ভিন্ন মানে, আহা রূপ! যুক্ত দেহে
মৌন শত অভিমানে
শূন্যে রাখো, চিহ্নে-নারীগত, পূর্ব হতে পশ্চিমে সে 
শিরোনামে সম্পাদিত


বাসর

অকারণে চোর এসে চুড়িতে রেখেছে হাত
ভয়ে_মদিরায় ডুবে আমি ধরেছি নির্ঘাত
মনে হলো বাসরের রাত_যথা যেমন
দেখি, চোর গেলে থেমে যায় চুড়ির কাঁপন


...................................................................................................................................................................










পরিচিতি :

নাম : শিবলী মোকতাদির
         কবি, প্রাবন্ধিক
জন্ম : ১১ জুন ১৯৬৯ বগুড়া, বাংলাদেশ


প্রকাশিত গ্রন্থ :

ধানের রচনা দিলে পত্রে (কাব্যগ্রন্থ)
ছন্দের নান্দনিক পাঠ (প্রবন্ধগ্রন্থ)
নিষিদ্ধ পুষ্টির কোলাহল (কাব্যগ্রন্থ )
সোনার কার্তুজ (কাব্যগ্রন্থ )
রৌদ্রবঞ্চিত লোক (মুক্তগদ্য)
ব্যবহারিক বিস্ময় (কাব্যগ্রন্থ)
দুর্ভিক্ষের রাতে (কাব্যগ্রন্থ)
কায়া ও কৌতুকী (কাব্যগ্রন্থ)
ছন্দকথা (প্রবন্ধগ্রন্থ)


e-mail : kobi.shiblymoktadir@gmail.com
মোবাইল : ০১৭৫১-৫৮০৬২২



Post a Comment

2 Comments

  1. পড়লাম। আবার পড়বো।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ। পাশে চাই, কাছে চাই আরও।

    ReplyDelete