দীলতাজ রহমান এর গল্প



বেশ ক’দিন আগে একজন ফেসবুকে আমার একটা লেখায় কমেন্ট করলেন, ‘অনেক আগে পাবলিক লাইব্রেরি থেকে একটা বই চুরি করেছিলাম। ফেসবুকে আপনার লেখাগুলো পড়ে, সেই চুরি করা বইটির ফ্ল্যাপে যে ছবি দেওয়া আছে, সেই ছবির সাথে আপনার প্রোফাইলের ছবি মিলিয়ে দেখলাম, বইটা আপনার কিনা। দেখলাম আপনারই!’ 
চোরকে কে আবার আপনি আপনি করতে যায়! তাই সাথে সাথে আমি তার কমেন্টের নিচে লিখলাম, ‘তুই চোর!’ আপনি সম্পর্ক থেকে একেবারে লাফ দিয়ে তুইতে নেমে গেলাম! 
চোর উত্তর দিলো, ‘আমার কাছে দুর্লভ অনেক বই আছে। একটাও কেনা নয়, সব চুরি করা এবং তা সংখ্যায় হাজার পাঁচেকের কম হবে না! তবে বিশ্বাস কর, আমি গরিব দোকান থেকে বই চুরি করি না!’ 
দেখলাম, চোরও আমাকে তুই তুই করছে! আমি সে চোরকে লিখলাম, আরে তুই আমাকে তুই তুই করছিস কেন? আমি তো তোর মতো চোর নই! কোনো অনুষ্ঠানে গেলে আমি বড়জোর এক প্যাকেট খাবার চুরি করি! সবার হাতে একপ্যাকেট, কিন্তু আমার হাতে দুই প্যাকেট থাকলে নিজেকে নিজের কাছে ভিআইপি ভিআইপি লাগে, তাই...!
ক’দিন এইরকম সব কথোপকথনের পর চোরের আর খোঁজ নেই। তারপর ছড়াকার, আমলা, আলম তালুকদারকে একদিন রাইটার্স ক্লাবে পেয়ে, চোরের কথা মনে পড়ে গেলো। কিন্তু হইহট্টগোলের ভেতর আলম তালুকদারকে জিজ্ঞেস করার মতো পরিবেশ পেলাম না_ আপনি যে কতদিন আগে ফোনে জানিয়েছিলেন, ‘একজন পাবলিক লাইব্রেরি থেকে দু’টো বই চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলো, তার ভেতর একটি দীলতাজ রহমানের ধূসর আঁচলে চাবি।’ তা সে বইদু’টি কি তার থেকে কেড়ে রেখে দিতে পেরেছেন! জিজ্ঞেস করতে না পেরে আমি আলম তালুকদারকে ভিড় থেকে ডেকে সাথে নিয়ে জুতমতো একটি জায়গায় একখানা ছবি তুলতে যাবো, এমন সময় সেখানে পাশে আরেক ছড়াকার তাহমিনা কোরাইশী এসে দাঁড়ালেন। 
তারপর তিনজনের সেই ছবি দিয়েই বই চুরির বিষয়ে স্ট্যাটাস লিখলাম। ক্যাপশন দিলাম, ‘চোরকে না পেয়ে সাধুকে ধরলাম...।’
বহু লাইক, কমেন্ট পড়লো তাতে। তবু চোরের খোঁজ নেই। ভাবতে বাধ্য হলাম, বাঁধাধরা ওই স্ট্যাটাসটি দেখে সে হয়তো এবার আমাকে ব্লক-ই করেছে! কারণ ততদিনে চোরের প্রতি আমার চোরাটানটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে, আমি সে টানভরা মাথাটি কুটেও তার ইনবক্সে ঢুকতে পারছিলাম না! সে বোধহয় সিস্টেম করে রেখেছে, যেন আমি আর না ঢুকতে পারি। আহা, চোরকেও যে মিস করা যায়, তাও বোঝা হয়ে গেলো! 
ইনবক্সে চোরের উত্তরগুলো ছিলো প্রখর বুদ্ধির! ফেসবুকজীবনে ওইরকম ধীমান আরেকটি চোর কেন, কোনো সাধুকেও পাইনি! যার জন্য কারো সাথেই আমার কখনোই চ্যাটিং হয় না! কেউ যদি ইনবক্সে ঢুকে প্রশ্ন করে, কেমন আছেন? আমি সাথে সাথে খেঁকিয়ে উঠে লিখি, ওয়ালে দেখেন, কেমন আছি। কোথায় আছি! 
এই খেঁকানো কখনো এমন মানুষের সাথেও হয়, যে, পরে নিজেকেই অনুতপ্ত হতে হয়।

চোরকে আমি বলেছিলাম, তোকে আমি এক হাজার টাকা দামের আমার ৬৪০ পৃষ্ঠার সদ্য বের হওয়া ‘গল্পসমগ্র’টা নিজে হাতে তুলে দেবো। একদিন সময় করে আমার অফিসে আসিস! চোর বলেছিলো, ‘সে হয় না। ওটা আমি মেলা থেকেই চুরি করেই সংগ্রহ করে নেবো, তুই ভাবিস না।’ 
আলম ভাইয়ের কাছ থেকে তো সেদিন আমার জানা হয়নি, পাবলিক লাইব্রেরি যদি সেদিন বইচোর ধরেই থাকে, তাহলে তো তাকে উত্তম মধ্যম গোটাকয় দিয়ে বই রেখে দেওয়ার কথা! 
এই চোর তবে কোন চোর, দীলতাজ রহমানের ‘ধূসর আঁচলে চাবি’ গচ্ছিত রাখা থেকে, আরো বহু বই চুরির চড়াই উতরাই পেরিয়ে এখন তার চোখ নাকি কোথায়, কোন দেশে পিকাসোর কোন একখানা ছবি তার পছন্দ হয়ে আছে, সেখানে। সে ছবির মূল্য কোটি টাকাও হতে পারে এবং সে চোর বদ্ধপরিকরÑ সে সেটা চুরি করে আনতেই পারবে! 
আমার এতবছরের লেখালেখির জীবনে কখনোই আমাকে বা আমার কোনো বই নিয়ে তেমন লেখা হয়নি। এমতাবস্থায় একদিন দেখি কোনো বইটই ছাড়া আমার লেখা নিয়ে, আমার ছবিসহ চোরের খুব বেশি নয়, মাত্র কয়েক লাইনে লেখা ফেসবুকের বুকজুড়ে ভাসছে! 
আমার বইচোর আমাকে নিয়ে লিখেছে! মানে আমার লেখা নিয়ে! কী লিখেছে, তা না দেখে, আমি শিহরণে কাঁপছিলাম! চোরকে নিয়ে আমার বিরহের অবসান হলো, এটাই আমার কাছে তখন মুখ্য বিষয়! তারপর চোরের ইনবক্সে ঢুকে চোরকে গাল ফুলিয়ে লিখলাম, এতদিন কোথায় ছিলিস? তোর জন্য আমার পরাণটা পুড়ে পুড়ে ছাই হয়েছে!
চোর পটাপট লিখলো, ‘পেটের ধান্ধায় ঢাকার বাইরে ছিলাম। যোগাযোগ করতে সময় হয়নি! কিছু মনে করিস না! এখন থেকে যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে...!’
কিন্তু ক’দিন না যেতেই আবার সে নিরুদ্দেশ! কী করি এমন খামখেয়ালি চোরকে নিয়ে! তার দুটো আইডির একটিতেও ক’দিনধরে সবুজ বাতি জ্বলতে না দেখে জীবন বুঝে গেছে, লেশমাত্র প্রেম নয়, এ শুধু বিরহেরই ঘনঘটা ঘটাতে আমার প্রতি নিয়তির পাতা সে এক ফাঁদ ছিলো! 
তারপর এই ক’দিন আগে, যখন প্রায় শেষরাতে ফেসবুক অফ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেবো, দেখি চোরের সদ্য লেখা বিরাট এক বিপ্লবী স্ট্যাটাস! আমি দ্রুত ইনবক্সে নাম্বার দিয়ে লিখলাম, ‘দেখা না করিস, ইকটু কল দে! আমার কণ্ঠটা শুনতে খারাপ না!’ সাথে সাথে সেই রাত তিনটায় ফোন বাজল। আমি উৎফুল্ল হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘চোওওওর!’ ওপাশ থেকে চোর হা হা করে হেসে বললো, ‘হ্যাঁ রে, ঠিক তাই!’ তারপর কত যে কথা! কী যে ঝরঝরে চোরের প্রতিটি শব্দ! কী যে অকম্প্র তার কণ্ঠ! জীবনের কোনো বিষয়ই আমাকে খুলে বলতে তার কোনো কুণ্ঠা টের পাইনি। কিন্তু আমি কী রেখে কী বলি! প্রমাদ গুনি, মনে মনে বলি, ঈশ্বর, এ-বেলা বকুলের মতো প্রাণে কিছু কথা দাও অকারণ টুপটাপ ফুল হয়ে ঝরে পড়তে! দাও কিছু সুবাসও রাখির মালায় নীরবে জড়িয়ে থাকতে!
চোর স্কুল থেকে লেখাপড়া করেছে লন্ডনে। কিন্তু এই বয়সেও তার পিএইচডি করা হয়নি বলে আক্ষেপ! দেশে বিদেশে তার বিভিন্নরকম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে এবং তার বাবা একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ! বউ আমেরিকাতে আছে। স্ট্যাটাস তার বাবারও কম নয় এবং সে ভালো চাকরিও করছে। বিদেশে বেড়ে উঠলেও নিয়মিত নামাজ পড়ে চোরের বউ। চোরের কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখা থেকে রুমালখানাও ইস্ত্রি করে পকেটে ভরে দেয়। কিন্তু দোষ একটাই, কুকুর পোষে। আর সে কুকুর বিছানায়ও ওঠে। চোরের আপত্তি এখানেই। চোর নাকি বউকে বলে দিয়েছে। হয় কুকুর ছাড়ো, নাহয় আমাকে। তো, বউ এখনো যখন কুকুর ছাড়েনি, তাহলে এবার বউকে নাকি চোরের ছাড়তে হবে। চোর নাকি মোটামুটি সেরকমই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।
চোর বুঝতে পারছে না, তার এইসব কথা ক্রমাগত আমাকে মাথার ছাদ মেকে খসেপড়া পলেস্তারা হয়ে ইট-পাটকেলের মতো আঘাত করছে। আমি আরো নিরাশ হচ্ছিলাম। শুরু থেকে আমি ভাবছিলাম, এটা একটা ছিঁচকে চোর এবং আমার সাথে পরিচিত হয়ে সে চোরমানুষটি আহ্লাদিতই হবে। দ্রুত সম্পর্ক গাঢ় করে সে চোর-বাউ-ুলে যখন তখন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে ফোনে কল দিয়ে বলবে, ‘নেমে আয় সাধুবন্ধু, আমরা দু’জন কোনোখান থেকে ঘুরে আসি! তবে রিকশা ভাড়া, ফুচকা আর ক’টা বিড়ির টাকা নিয়ে নামতে ভুলিস না যেনওওও!’
ভেবেছিলাম, চোরের হাত ধরে এবার অপূরিত ইচ্ছেটুকু র্প্ণূ করে নেবো। দুনিয়া ঘুরে! বাংলার কোনা-কানছি থেকে শুরু হবে সে দীর্ঘ, অনির্দিষ্ট যাত্রা...! চোরের করা এমন আব্দারের সাধও জেগেছিলোÑ ‘তোকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আমার জুতো ছিঁড়ে গেছে। কালই মোজাসহ একজোড়া জুতো কিনে দিবি, না হলে এই শেষ দেখা...!’ 
বিদেশে লেখাপড়া করা বিত্তবান চল্লিশোর্ধ চোরের সাথে কথা বলতে বলতে ফজরের আজান পড়লো। সুবেহসাদেকের আলোতে প্রচ্ছন্ন পৃথিবী! ফোনে আর ঝুলে থাকাটা বাদুরের থেকেও অধম মনে হতে থাকে নিজেকে। অনিচ্ছাতেই কণ্ঠে অবদমন ভাব এনে বললাম, চোর, তাহলে রাখি রে! সুপ্রভাত! কিছুটা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে আবার বললাম, তা তোর সাথে দেখা-টেখা হবে না? 
চোর বললো, ‘দু-একদিনের মধ্যে টরেন্টোতে যাচ্ছি। এসে তোকে কল দেবো! সুপ্রভাত...!’ বলে ঠাস করে পিছুটানহীন শব্দে ফোনটা রেখে দিলো। 
আমার চোখ ভেঙে যে ঘুম আসার কথা ছিল। তা সুদূর পরাহত হয়ে গেলো। চোরের প্রতি ক’দিনে কুয়াশার মতো জমে ওঠা একটা বালখিল্যভাব, ক্রমশ ভারি পাথরের মতো গম্ভীর হয়ে উঠেছিলো, তাতে যেন প্রখর সূর্যের আভা এসে লাগলো। এই বয়সী এবং এই স্ট্যাটাসধারী চোরের কি আর অত সময় থাকবে তার বউয়ের সাথে দূরসম্পর্কের জের টেনে, আবার তার সাথেই পাল্লা দিয়ে পিএইচডির সব কাগজপত্র তৈরি করে, সাথে বিষয়সম্পত্তি রক্ষার কায়দাকানুন সব মেনে, তারপর আমাকে নিয়ে শরৎ-আকাশে সুদূরের মেঘ হয়ে নীহারিকাপুঞ্জ ছুঁতে...।



Post a Comment

0 Comments