ইসলাম রফিক এর গদ্য “ঘুরে ফিরে দিন কেটে যায় কবিতার টানে”

ঘুরে ফিরে দিন কেটে যায় কবিতার টানে





ধ্যরাতে ঘরে ফিরে যখন খাবারের জন্য টেবিলে বসি, মনটা খারাপ হয়ে যায়। সারাদিনের ক্লান্তি নতুন করে ফিরে আসে। কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে উঠি। মনটা বিগড়ে যায়। পাশে তাকাই একজন ঘুমাচ্ছে বিকারহীন, অনুভূতিহীন। কখনো ঔষুধ খাওয়া হয়, কখনো হয়না। ঘুমেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করি। তারও আগে ভাবি কী হয় এগুলো করে। অফিস শেষে বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় যখন সাতমাথা কিংবা পড়–য়ায় ফিরি, তখন কত কথা, কত স্বপ্ন  আর কত আশা। কিছু ব্যবধানে বাড়ীতে ফিরে তা ফিকে হয়ে যায়। 

সময় হলেই একে একে চলে আসে সব পড়–য়ায়। কবি শিবলী মোকতাদির, শিশু সংগঠক আব্দুল খালেক, গল্পকার কবীর রানা, সিকতা কাজল, কামরুন নাহার কুহেলী, হাদিউ হৃদয়, হাবীবুল্লাহ জুয়েল, এস এম আনিছুর রহমান, করিম মোহাম্মদ, ইসরাফিল আলম, বেলাল সরকার, আমির খসরু সেলিম, আল আমিন মোহাম্মদ প্রমুখ। কয়জনের নাম বলব ? মাঝে মাঝে আসেন শিশুর সারল্যে যিনি এখনও আমাদের অভিভূত করে রাখেন, আমাদেরকে বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন কবি বজলুল করিম বাহার, আসেন কবি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি মতিয়ার রহমান, কবি শোয়েব শাহরিয়ার। শারীরীক অসুস্থতার কারণে আসা হয়ে ওঠেনা কবি রেজাউল করিম চৌধুরীর। তবে প্রতিনিয়ত ফোন দেন, খোঁজ খবর রাখেন, কার্যকর পরামর্শ দেন। আসেন সেলিম রেজা কাজল। কবিতা লেখেন, কবিকে ভালবাসেন। খালেক ভাইয়ের সুত্রে প্রাপ্ত কাজল মামা আসামাত্র আমাদের মধ্যে খাবার খিড়িক পড়ে যায়। মামা খাবই। মামাও স্বাচ্ছন্দে খাওয়ান। কবি শিবলী মোকতাদির ইয়ার্কি মারেন, খালেক ভাই ইয়ার্কি মারেন, মামা আনন্দচিত্তে তা গ্রহন করেন। শুধুমাত্র কবিতাকে ভালবাসে তিনি প্রতি মাসে কিছু সহযোগিতা সবাইকে করেন। মাঝে মাঝে আসেন এ্যাড. পলাশ খন্দকার। বগুড়া লেখক চক্রের প্রতিষ্ঠাতা সহ সভাপতি তিনি। বর্তমানে উপদেষ্টা। বগুড়া লেখক চক্র কেন্দ্রিক পড়ুয়ার এই আড্ডায় সবাই যুক্ত হন কিংবা হবার চেষ্টা করেন। সারাদেশ থেকেই কবি সাহিত্যিকরা আসেন, তাদের সাথে আড্ডা হয়, হয় মতবিনিময়, সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হয়। মাঝে মাঝে শেরপুর থেকে আসেন রনি বর্মন। কবি। বিতল নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। আসেন সাকিল আহমেদ। শেরপুর থেকে । শেরপুর থেকে আরও আসেন নাহিদ হাসান রবিন। কবি ও সম্পাদক। পাবনা থেকে আসেন লতিফ জোয়ার্দার। যিনি এখন আমাদের হয়ে গেছেন। পাবনা থেকে আরও আসেন রেহানা শিল্পী। মহিয়সী নামের একটি প্রকাশনা যিনি চালান। রবু শেঠ প্রকাশনার কাজে বগুড়া এলেই একবার ঢু মারবেন বগুড়ায়। দিনাজপুর থেকে প্রায়ই আমাদের সাথে আড্ডা দিতে আসেন কবি জলিল আহমেদ ও কবি মাসুদুল হক। রাহমান মিজান, গাজীপুর থেকে হাম নিঃশ্বাস ছাড়েন, আহা বগুড়া বলে। মামুন রশীদ। কবি ও সাংবাদিক। ঢাকায় একটি জাতীয় দৈনিকে কাজ করেন। হুটহাট চলে আসেন। যথেষ্ট পরিমাণ সময় না দেওয়ার অভিমান তার সব সময়ই ছিলো। তবুও তিনি আসেন। বগুড়ার সংস্কৃতি অঙনের মানুষেরা তো আছেনই। এইরকমভাবেই চলে, এই ভাবেই দিন কেটে যায়।

আমাদের আড্ডায় কী হয়? আড্ডায় উঠে আসে অনেক কিছু। বলতে গেলে গোটা বিশ্ব। সেটা যেমন সাহিত্যের, তেমনি রাজনীতির। প্রতি সপ্তাহের সাহিত্য পাতা, লিটল ম্যাগাজিন, শব্দঘর কিংবা কালি ও কলম পত্রিকার লেখাটি পড়ার পর ভালো লেখার যেমন প্রশংসা হয়, তেমনি হয় মন্দ লেখার সমালোচনা। আলোচনা হয় সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে। আড্ডায় উঠে আসে লিটল ম্যাগাজিন, বইয়ের মূল্য থেকে শুরু করে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার এর বাংলা একাডেমী পুরস্কার পর্যন্ত। উঠে আসে দেশের সাহিত্য সংগঠনগুলোর কাজের মান ও ধরন। সেটা রাজশাহীর কবিকুঞ্জ কিংবা চিহ্ন যেমন, তেমনি বগুড়া লেখক চক্র,  ময়মনসিংহ সাহিত্য পরিষদ, টাংগাইলের সাধারণ গ্রন্থাগার, নওগাঁওর রবু শেঠের পুনশ্চ কিংবা মনিরুল মনিরের চিটাগাংয়ের সাহিত্য। পড়–য়ার আড্ডায় উঠে আসে বগুড়ার সাহিত্য আন্দোলন, পূর্বাপর। ইসলাম রফিক সম্পাদিত ‘দোআঁশ’ কিংবা ‘নিওর’, বগুড়া লেখক চক্রের মুখপত্র ‘ঈক্ষণ’ কীভাবে, কত দ্রুত বের করার যাবে তার চেষ্টাও থাকে আমাদের আড্ডায়। চেষ্টা চলে বগুড়ার সাহিত্য অংগনকে আরও কীভাবে বিস্তৃত করা যায়, কীভাবে কবিতাকে পাঠকের উপযোগী করা যায় কিংবা কবিতা নিয়ে পাঠকের কাছাকাছি যাওয়া যায়। এইসব এলোমেলো ভাবনার মধ্যেই উঠে আসে ভ্রমণ বিষয়ক কথা। ফলত আমরা দলবেঁধে ভ্রমণে যাই। সেটা বগুড়ার মহাস্থান গড় হোক, আর কবিগুরুর পতিসর হোক। এইরকম ভ্রমণে কত মানুষের সাথে কবিতার বন্ধন হয়ে যায়। যেমন হয়েছে আত্রাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মোঃ মোখলেছার রহমানের সাথে। চমৎকার মনের মানুষ। সাহিত্যকে ভালবাসেন, ভালবাসেন সাহিত্যিককে। সম্প্রতি পাবনাতে ভ্রমণে গিয়ে কথা হলো কথা হাসনাত এবং মেহেরজাবিন খানের সাথে। সুমন সাব্বির আর জুলফিকার কবিরাজের সাথে দেখা না হলেও মোখলেছ মুকুল ডাক্তারি পেশা ছেড়ে ঠিকই আমাদের সময় দিন, কবিতার টানে। এরকমভাবেই তো অনেকের সাথে পরিচয়। কবিতার টানে ভ্রমণ, ভ্রমণের সাথে পরিচয়।

এইসব আড্ডার মধ্যে দিয়ে দিনযাপনের মধ্যেই সারাদেশ থেকে ফোন আসে লেখা চেয়ে, ফোন আসে সাহিত্য সম্মেলনে যাওয়ার। কোথাও লেখা দেয়া হয়, কোথাও হয় না, অনেক আয়োজনে যাওয়া হয়, অনেক আয়োজনে যাওয়া হয় না। আবার অনেক আয়োজনের আমন্ত্রণ না পেলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। এভাবেই দিন কাটে। এসবের মধ্যে কবি শিবলী মোকতাদির তার মেয়ে পড়শি নিয়ে ক্যান্টমেন্টে যান, আমি যথারীতি পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে কনডমের হিসাব কষি। ভ্রমণে গাড়ী ঠিক করার কথা 

-২-

যেদিন, তার তিনদিন পর দেখা গেলো শিবলী মোকতাদির পড়–য়ায়, তার অলংকরণ আর কবিতার জন্য ‘নিওর’ আটকে যাচ্ছে, তবুও সময় হয়ে ওঠে না তার। কবিতার বই হচ্ছে না বলে মাঝে মাঝে মৃদু ধমকাচ্ছেন। হাদিউল হৃদয় লেগে আছে কবিতার জন্য । বিভিন্ন পত্রিকার জন্য গড়ে প্রতি মাসে একটি করে কবিতা হৃদয়কে দিতে হয়। ছাপা হোক বা না হোক মতিয়ার রহমান ‘নারুলী’ নামে একটি গল্পের আবদার করে যাচ্ছেন দীর্ঘ ১ বছর ধরে। হয়তো লেখা হবে, ছাপা হবে না। এরই মধ্যে হুট করে কবি শিবলী মোকতাদিরের ফোন। আজ সন্ধ্যায় থাকিস। দেখা গেলো রহমান ওয়াহিদ ঢাকা থেকে বগুড়ায় এসে উপস্থিত। আড্ডার জায়গা বদলে যায়। টাইম কার্ডে যাই। সুপ চলে, চলে সাহিত্য আড্ডা।  আমি, শিবলী মোকতাদির, কবীর রানা আর হিরুন্য হারুন। রাত করে বাড়ী ফেরা। 

হুট করে দেখা গেল একদিন এসে উপস্থিত নাজমল হক খান। তার আবদার আমার গানের একটা আয়োজন আপনারা করুন। আর রিয়ার্সেল হিসেবে একদিন আপনারা সবাই বাসায় আসেন। বাসায়ও যাওয়া হয় না, একক গানের আয়োজনও করা হয় না। ভদ্র লোক লিখে চলেছেন। মাঝে মাঝে আমাদের আড্ডার সংগী হন জিএম সজল আর জে এম রউফ। সাংবাদিক এই দুই বন্ধু মুলতঃ কবিও। জেএম রউফের কবিতার বই বেরুলেও, জিএম সজলের এখনও বেরুয়নি। বইয়ের জন্য তাড়া দেন কেউ কেউ। হুট করে কোন দিন দেখা গেল শংকর দা এসে উপস্থিত। প্রদীপ ভট্টাচার্য্য শংকর। দৈনিক করতোয়ার বার্তা সম্পাদক। আমরা তো অবাক। এই সময়ে...। পত্রিকার চাকরী। সন্ধ্যা তো পিক আওয়ার। তবুও তিনি আসেন মাঝে মাঝেই। কবিতার টান ফেলতে পারেন না কবি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি রাতে কম বেরোন, তবে দিনে আড্ডা দেন। এইসব সিনিয়র জুনিয়র, বড় ছোট মিলেই তো আমাদের আড্ডা, আমাদের উঠাবসা, ঝগড়া বিবাদ, মান অভিমান। আবার সব কিছু ঝেড়ে ফেলে আবার উঠে দাঁড়ানো। এই রকম নানা কাজে, অকাজে, আড্ডায়, অনুষ্ঠানে ভ্রমণে, গসিপে দিন কেটে যায়। সময় কেটে যায়। সময়ের সাথে সাথে শিবলী মোকতাদির বড় কবি হয়ে ওঠে, রাহমান মিজান, হাদিউল হৃদয়, বেলাল সরকার, হিরুণ্য হারুন কবিতার পাঠ নিয়ে নিয়ে বড় হয়। সিকতা কাজল, কামরুন নাহার কুহেলী আর আফসানা জাকিয়া বন্ধু হয়ে ওঠে। কী এক মেল বন্ধন। কেউ কাউকে আমরা চিনতাম না। কবিতা আমাদের চিনিয়ে দিয়েছে, সাহিত্য আমাদের ঘনিষ্ঠ করে দিয়েছে। এই ঘনিষ্ঠতার কারণে রনি বর্মনের বামিহাল আমাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে, সাহাব উদ্দিন হিজল আমাদের কাছে শিশু সাহিত্যিক হয়ে ওঠে, হাদিউল হৃদয়ের তাড়াশ নিজ বাড়ী মনে হয়। আমরা আসলে সবাই কবিতার যাত্রী। আমাদের জন্ম হয়েছে আসলেই কবিতা লেখার জন্য। না হলে এত অপমান, এত যন্ত্রনা ভোগ করে কবিতা লেখা, সাহিত্য সংগঠন করা ? কেউ আমাদের আলাদা করতে পারেনি, পারবে না।  যদি কেউ পারে সেটা কবিতা। কবিতার জয় হোক। 


ইসলাম রফিক
সভাপতি
বগুড়া লেখক চক্র
সম্পাদক-দোআঁশ ও নিওর




Post a Comment

0 Comments