ঘুম
ভেঙেই মনে হল আজ ওদের বিশেষ দিন। চোখ না খুলেই প্রতিবারের মতো অপেক্ষা করতে থাকে
চেনা পদশব্দের। চোখের উপর চেনা নিঃশ্বাসের। প্রতীক্ষা নিয়ে চোখ বন্ধ রাখতে রাখতেই
তন্দ্রা এসে যায়।
দুটো
টিকটিকি ঝগড়া করতে করতে হঠাৎ ওর উপরে পরে। তড়াক করে বিছানার উপর বসে পরে। দেয়ালে
টানানো ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই দ্রুত উঠে পরে।
প্রতিদিনের
মতো শূন্য বাড়ি। নূপুর সময় মতো অফিসে চলে গেছে। ও ধীরে সুস্থে বাথরুমে ঢোকে।
একেবারে ফ্রেশ হয়েই বের হয়।
ওর
মন বলছে আজ টেবিলে ওর পছন্দের যে কোন একটা পদ থাকবেই। সাথে দোলনচাঁপা বা গোলাপ যা
আপন সৌরভে মাতোয়ারা হয়ে এই শূন্য বাড়িতে ওকে সঙ্গ দেবে। কোনটা বেশী প্রিয় নূপুরের,
দোলনচাঁপা না গোলাপ?
দোলনচাঁপা
বর্ষার ফুল আর গোলাপ শীতের। এখন অবশ্য সারা বছরই এ দু’টোর উপস্থিতি লক্ষ্য করা
যায়। তবে শীতের গোলাপ রঙ, রূপ, সৌরভে অনন্য।
ডাইনিং রুমে এসে পরপর দু’গ্লাস পানি পান করে
বরাবরের মতো। এক কাপ র’ চা হলে ভালো হতো। ফ্ল্যাক্সটা টান দিতেই বুঝতে পারে ওটার
ভেতর রায়হানের পকেটের মতোই খালি। টেবিলে খাওয়ার মতো তৈরি কোন খাবারও নেই। এক কোনায়
পরে আছে আধখান পাউরুটি।
কিছু কিছু অনুভূতি সময়কে বিব্রত করে, থমকে
দেয়। চুলোয় চায়ের পানি বসিয়ে মোবাইলটা নিয়ে ফেসবুকে ঢুকে যায়। নোটিফিকেশনটা দেখতে
দেখতেই চায়ের পানি ফুটে যায়। বড় মগে ঢেলে দু’টো টি-ব্যাগ ফেলে দিয়ে আবার বসে।
বার্থডে উইশ করে কাউকে কাউকে। ম্যাসেঞ্জারে কে কি বলে রেখেছে সেগুলো দেখতে দেখতে
চা’টা শেষ করে।
দু’পিস পাউরুটি সেঁকা, একটা ডিম পোচ করা খুব
কঠিন কাজ নয়। এর জন্য সকালে বুয়াকে কেন দরকার। দরকারের চেয়েও বড়, বেশ কিছু টাকা
বেরিয়ে যায় তাতে। রায়হানই সকালের বুয়াকে ছাড়িয়ে দিয়েছে। এ কাজটুকু অনায়াসে রায়হান
করে নিতে পারে।
আজ এই মুহূর্তে ওর পাউরুটি সেঁকতে ইচ্ছে
করছে না, ডিম পোচ করতে মন চাইছে না। এবেলা উপোষ দেবার ইচ্ছেটা প্রবল হতেই মনে হয়,
ও যদি এখন এই রুটিটা না খেয়ে ফেলে রাখে তবে এটা কাল ময়লার বালতিতে যাবে। অপচয়ের
চূড়ান্ত। নূপুর কখনও এসব নিয়ে কথা না বললেও অপচয়টা রায়হান ইদানিং একেবারেই করেনা।
অনেক
দুপুরে অফিস পাড়ায় কোন কাজে গেলে পকেটে পর্যাপ্ত টাকা থাকেনা, তখন শুকনো মুখেই
বেলা পেরিয়ে যায়। সাতপাঁচ ভেবে ডিমপোচ করে খেয়ে সবকিছু গুছিয়েও ফেলে নিত্যদিনের
মতো।
ড্রয়িংরুমে
ঢুকে টিভি অন করে। গতকালের পুরনো খবর, টক-শো গুলোর পুনরাবৃত্তি। বারান্দায় গিয়ে
দাড়ায়। বাইরে তখন দিনের কর্মচাঞ্চল্য পূর্ণমাত্রায়।
প্রতিদিনকার
দৃশ্য তবুও আগের দিনের মতো নয়। কালকের সাথে আজকের কোন মিল নেই। সেই কালকের রাস্তা,
দোকানপাঠ, বাড়িঘর সব একই দৃশ্য- শুধু কি যেন একটু আলাদা। তবে সূত্র একই।
ওদের
বাসাটা একহাজার বর্গফুটের। এরমধ্যেই তিনটে বেডরুম, ড্রয়িং, ডাইনিং, কিচেন, দু’টো
বারান্দা, এটাচড বাথরুম সব মিলে চমৎকার এক দক্ষিণ খোলা বাড়ি। সমস্যা একটাই- বড়
রাস্তার পাশে বাড়ি, গভীর রাত অবধি গাড়ি আর মানুষের সম্মিলিত শব্দ যন্ত্রণা। এখন
সয়ে গেছে।
প্রিয়ন্তীকে
রোডের ওপাশের স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে ওরা এই বাসায় ওঠে। সেই প্রিয়ন্তীও
সামনের বছর এস.এস.সি দেবে।
ময়মনসিংহ ক্যাডেটে পড়ছে।
মায়ের
মতো স্মার্ট আর বাবার মতো মেধাবী। বাবার মতো মেধাবী’ বাক্যটা মনে হতেই থেমে যায়
রায়হান। কি হল রায়হানের এই মাথা ভর্তি মেধা নিয়ে?
গ্রামের
ছেলে মেধার জোরে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হল। সাহিত্য, সংস্কৃতি অঙ্গনেও পদচারনা ছিল
এক সময়। পাশ করে বড় কর্পোরেট হাউজে ভালো চাকুরীও হল। বিয়ে করলো ভালোবাসার নূপুরকে
দুই পরিবারের অমতে। দীর্ঘকাল পরে নূপুরের পরিবার মেনে নিলেও সম্পর্কে কিছুটা ফাটল
থাকলোই। আর রায়হানের বাবা ছিলোনা, মা মারা গেল রায়হানের বিয়ে মেনে নেয়ার আগেই।
মোটা
বেতনের চাকুরী আর বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে সংসার শুরু করলো দুজন। এলো প্রিয়ন্তী। আহা
কি সব দিনগুলো, হারিয়ে যাওয়া মোহময় রাত।
অফিস
রাজনীতিতে হেরে গেল রায়হান। ধুপ করে চাকরিটাই চলে গেলো। সংসার নিয়ে যখন চিন্তায়
চারদিক অন্ধকার দেখছিল তখন হাল ধরলো নূপুর। ওর বাবা, ভাই আর দুলাভাই মিলে শুরু
করেছিল যৌথ ব্যবসা। সেটা ফুলে ফেঁপে আজ বিশাল অবস্থা। নূপুর সেখানেই জয়েন করে। এখন
জান দিয়ে খাটছে- বাবার অফিসে।
বারান্দা
থেকে ঘরে ঢোকে রায়হান। নূপুরের বেডরুমে যায়, দেয়ালে চোখ রাখে। গ্রুপ থিয়েটারে কাজ
করতো দুজন। একটু একটু কাছে আসা, তারপর প্রেম। “ভালোবাসি”, কে প্রথম বলেছিল
ভালোবাসি’...?!
দেয়ালে
যে ছবিটা ঝুলছে সেটা সেইদিনের। নূপুরের পরনে সবুজ কামিজ আর শ্যাওলা সবুজ ব্লকের
ওড়না, ওর পরনে হালকা নীল রঙের শার্ট। রায়হানের হাতে এক তোড়া গোলাপ কুঁড়ি, নূপুরের
হাতে দোলনচাঁপা।
ছবিটা
থেকে চোখ সরিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে রায়হান। আজ কি নীল শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিয়ে গেছে
নূপুর? মনে হয় দিয়েছে।
হ্যাংগারে
ঝুলছে নীল শার্ট। এটা দুবছর আগে এই দিনে নূপুরের জমানো টাকা থেকেই কেনা রায়হানের
জন্য উপহার। খুব পছন্দের শার্ট রায়হানের। বেশ কয়েকবার পরার পর একটা বোতাম ভেঙে
যায়। রঙ মিলিয়ে শাঁখারী বাজার থেকে কিনে এনেছে ম্যাচিং বোতাম, পাশের দোকান থেকে
সোনামুখী সুই সুতো।
হ্যাংগার
থেকে শার্টটা নামানোর আগেই ধুলোয় ভরে যায় ঘর। তাড়াতাড়ি শার্টটা হ্যাংগারে রেখেই
বাথরুমে ঢোকে রায়হান। তার আগে ফ্যানের সুইচটা অন করে।
ওর
ডাস্ট এলার্জি আছে। নাকে মুখে পানি দিয়ে খুব ভালো করে অনেকটা সময় নিয়ে ধুয়ে ফেলে।
ততোক্ষণে ঘরের ধুলো গুলো ফ্যানের বাতাসে বাইরে উড়ে গেছে।
অন্য
একটা শার্ট গায়ে চাপিয়ে সামনের দোকানে বসে। ওষুধের দোকান, ওখানে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে
পত্রিকা পড়ে। সব মিলিয়ে গোটা তিনেক তো পড়েই। বিনিময়ে দু’একটা কাস্টমার ডিল করতে
হয়। পত্রিকা মোবাইলেও পড়তে পারে, সেটা ইচ্ছে করেই করেনা। এমনিতেই বন্ধুবান্ধব,
আত্মীয়স্বজন এড়িয়ে চলে চাকুরী চলে যাবার পর থেকে। এই যে পত্রিকা পড়ার জন্য দোকানে
বসে এতে কিছু লোকের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। ওরা ওর অতীত বর্তমান নিয়ে কোন প্রশ্ন
করেনা।
আগে বাসায়ই
পত্রিকা রাখা হতো এখন রায়হানই মানা করে দিয়েছে। এতেও তো কিছুটা খরচ বাঁচলো।
পত্রিকা পড়া শেষ পর্যায়ে তখনই রায়হানের ফোন
বেজে উঠলো। বুয়ার ফোন। ফোনটা নিয়ে একটু দূরে দাঁড়ায়।
-স্যার, আইজ
আইতে পারুম না। ম্যাডামরে কইয়া দিয়েন। কাইল আসুমনে।
-কেন? আজ
আসবে না কেন?
-আমার
স্বামীর শইলডা যুৎ নাই।
-তুমিই
তোমার ম্যাডামকে বল।
-না গো,
হেইডা পারুম না। হ্যার যে মেজাজ, কতাই হুনবো না। ধমকাইয়া একশেষ করবোনে। মুনে কয়,
আমরা কাম করি দেইখা আমাগো স্বামী সংসার নাই। আপনে কইয়া দিয়েন। আইজ আইতে পারুম না,
কাইল হ্যার শইল ভালা অইলে আমু। পোষাইলে রাখবেন, নাইলে বেতন দিয়া বিদায় দিবেন...
বুয়ার কর্কশ শব্দে কানের ভেতর পিঁপড়ে ঢুকে
যায়। এখন হাজারবার নূপুরের সমস্যার কথা বললেও শুনবে না। আর আল্টিমেটাম তো দিয়েই
দিয়েছে।
-ঠিক আছে,
ঠিক আছে।
ফোনটা কেটে দেয় রায়হান। বুয়াও বুঝে গেছে
সংসারে রায়হানের স্থান বুয়ার কাছাকাছি। কোন কোন ক্ষেত্রে বুয়ার চেয়েও নিচে। এই যে
বুয়া চিৎকার করতে পারলো, চ্যাঁচামেচি করতে পারলো, আল্টিমেটাম দিতে পারলো, রায়হান
এসবের কিছুই করতে পারবে না।
প্রিয়ন্তী হবার পরপরই বুয়া ওদের বাসায় কাজে
আছে। আগে দুইবেলা আসতো, চাকুরী চলে যাবার পর রায়হানই ওকে একবেলা আসতে বলেছে। এতেও
কিছুটা টাকার সাশ্রয় হয়।
বুয়ার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও
অভিজ্ঞতা ওকে বলে দিয়েছে- বেকার স্বামী, যে বউয়ের রোজগারে বসে বসে খায় সংসারে তার
মূল্যায়ন কতটুকু।
অথচ আগে এই বুয়াই ওকে ছার ছার বলে কত সমীহ
করতো। কোন সমস্যার কথা রায়হানকে নয় নূপুরকে বলতো।
অফিসে
যাবার আগে দেখতো, টেবিলে পরিষ্কার প্লেট গ্লাস তৈরি, নাশতা সাজিয়ে ফ্ল্যাক্সে গরম
চা রেখে কিচেনে চুপ করে অপেক্ষা করতো, রায়হান’ কোন কাজের কথা বলে কিনা।
রায়হানের চাকুরী চলে যাবার পরপর যখন বুয়া
দুইবেলা আসতো, দেখা যেত নানা অজুহাতে প্রায়ই সকালে কামাই দিতো।
বুয়ার অপমান গায়ে মাখতে চাইছে না আজ। ভালই
হল আজ, নূপুরের পছন্দের খাবার তৈরি করার সুযোগ তো হল। কিভাবে ডাইনিং সাজাবে ভাবতে
ভাবতে হাঁটতে থাকে বাড়ির পথে।
অনেক রাতে বাড়ী ফেরে নূপুর। বায়ারদের সাথে মিটিং ছিল। ডিনার সেরেই
ফিরতে হয়েছে। সমস্যা হয়নি, ওর ভাই আর দুলাভাই পৌঁছে দিয়ে গেছে। নূপুর মনে হয়
অপ্রকৃতস্থ ছিল কিছুটা।
রেডিওতে একটা রেকর্ডিং ছিল রায়হানের। ওর
ইউনিভার্সিটির বন্ধু এখন রেডিওর ডিজি, তাঁর কল্যাণে সপ্তাহে দু’টো প্রোগ্রাম
দিয়েছে। রূপনগর থেকে আগারগাঁও এসে প্রোগ্রাম করে যে চেকটা পায় সেটা খুবই হাস্যকর।
আগারগাঁও
দিয়ে হাঁটছিল রায়হান। যৎসামান্য টাকা ব্যাংকে জমানো আছে। যা দিয়ে প্রিয়ন্তীর
লেখাপড়ার খরচটা বহন করে ও’। এখনও লেখাপড়ার খরচটা
তেমন ভাবে লাগছে না, কিন্তু ভবিষ্যতে তো লাগবে।
তাছাড়া
আরও কতকিছু আছে, বিয়ে তো দিতে হবে মেয়েটাকে। বাবার পরিচয়ই বা কি দেবে মেয়েটা? ওকে
খুব ভালবাসে প্রিয়ন্তী। নূপুরও এক সময় ওকে ভালোবাসতো। আর
আজ দ্বিধাদন্দের মধ্য দিয়েই দিন কেটে যায়!!!
মুখ
ফুটে না বললেও ভেতরে ভেতরে প্রত্যেকেই অতিরিক্ত কিছু প্রেফার করে। কি সেটা?
ভালোবাসা? কেয়ারিং? বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠা? রায়হান বিষণ্ণ হাটতে থাকে...
গাড়ীর হর্নে সচকিত হয়ে পথ ছেড়ে পাশে দাঁড়ায়।
ওয়াইন কালারের এলিয়নের ডোর খুলে বেরোয় ওর একসময়ের ক্লাসমেট রুমানা তাবাসসুম।
রুমানার পীড়াপীড়িতে ওর পাশে গিয়ে বসে। গাড়ী একটানে রুমানার অফিসের নিচে গিয়ে থামে।
বিরাট কাজের লোক রুমানা। দেশবিদেশ জুড়ে ওর
ব্যবসা। দীর্ঘদিন পর দেখা দু’বন্ধুর। রুমানা রায়হানের ঠিক বন্ধুও ছিল না। বিরাট
বড়লোকের মেয়ে, ইউনিভার্সিটি যেত দামি গাড়ীতে চেপে। ওদের মতো মফস্বল
থেকে আসা ছেলেদের, যারা ওর বিত্ত এবং সৌন্দর্যের কাঙাল ছিল তাদের ঠিক
পাত্তা দিতো না। রায়হান কোনদিনই রুমানার কাছে ঘেঁষতে চায়নি। মোটামুটি দূরত্বই ছিল।
এতদিন পরও তেমন দূরত্ব না থাকলেও সংকোচে গুঁটিয়ে থাকে রায়হান। রুমানাই সে দূরত্ব
অতিক্রম করে।
ডিনার
শেষে নামিয়ে দিয়ে যায়। যাবার আগে কার্ড ধরিয়ে দেয়, কাল দুপুরের পর ওর অফিসে
আমন্ত্রণ তবে যাবার আগে ছোট্ট একটা ফোন।
রায়হানের
এতদিনের চেনা রুটিন বদলে যায় একটু একটু করে নীল শার্টটায় ধুলো জমতে জমতে। বেশ
কিছুদিন পর রুমানা’ ওকে ওর এক বন্ধুর অফিসে চাকুরির অফার দেয়। হাফ ছেড়ে বাঁচে
রায়হান। প্রথমতঃ চাকুরীটা ওর নিঃশ্বাসের মত প্রয়োজন ছিল, দ্বিতীয়ত চাকুরীটা
রুমানার অফিসে নয়।
ততদিনে
দুজন দুজনের সংসারের ভেতরে সন্তপর্ণে প্রবেশ করেছে। রুমানার জানা হয়ে গেছে নূপুরের
সাথে ওর টানাপোড়নের শীতল যাপনের কথা। রায়হান জেনেছে রুমানার সাথে ওর স্বামীর নানা
রকম জটিলতা থাকলেও ব্যবসাটা একই। তবে ওদের আলাদা যাপন বহুদিনের এবং দুই এলাকার দুই
বাড়িতে। ওরা কেউ কারো ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে নাক গলায় না।
নিয়োগপত্র
হাতে পেতেই ফোন দেয় রুমানাকে। রুমানার অভিনন্দন পর্বটা মনে রাখার মত। গুলশানের
অভিজাত মার্কেট থেকে কেনা হয় নীল শার্ট, গ্যাভারডিনের প্যান্ট আর দামী পারফিউম।
ডিনার প্রতিদিনের চেনা রেস্তোরাঁয় নয়, সম্পূর্ণ নতুন এবং আরও ব্যয়বহুল রেস্তোরাঁয়।
রুমানার
ফ্ল্যাট থেকে বেরুতে বেরুতেই মধ্যরাত ছুঁয়ে যায় বনানীর আকাশ। রায়হানের কাছে
ডুপ্লিকেট চাবি আছে তাই বেশি রাতে বাড়ী ফেরাটা সমস্যা নয় আর চাকুরী পাবার আনন্দে
রাতের প্রথমাংশটা একটু বেশিই বেহিসেবি ছিল রায়হানের। সব সমস্যা আজ তুচ্ছ।
সকালে
বাথরুমে ঢোকার আগেই হ্যাঙ্গারে ঝোলানো নীল শার্টটা নামিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়
রায়হান। গ্রিল গলিয়ে হাত দু’খান বাইরে বের করে শার্ট সমেত। উড়িয়ে দেয় শার্টটা।
ধুলোগুলো ঝরে ঝরে নিচে পড়ে এতদিনের অবহেলার স্মৃতি নিয়ে। শার্টটা হালকা বাতাসে
অল্প উড়ে গিয়ে দূরে ধুপ করে পড়ে।
বাথরুমে
ঢুকে সাওয়ার ছেড়ে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে রায়হান। শেভ, শ্যাম্পু এবং গোসল শেষে বেশ
ফুরফুরে মেজাজে বের হয়। যথারীতি আজও ব্রেকফাস্ট টেবিল খালি!!!
নিচে
নামতেই সামনে দাঁড়ায় রুমানার ড্রাইভার। দরজা খুলে দেয়। সিটে বসতেই মোবাইলে মেসেজ
ঢুকে যায়। “জয়েন করেই আমাকে ফোন দেবে সোনা”। ড্রাইভারের দৃষ্টি এড়িয়ে মোবাইলের
স্ক্রিনে চুমু দেয় রায়হান গত রাতের মত।
কাগজপত্রের
ঝামেলা শেষ করে কাজকর্ম বুঝে নিতে একটু দেরিই হয় রায়হানের।
লাঞ্চ
আওয়ারে ফোনটা নিয়ে ওর রুম সংলগ্ন বারান্দায় দাঁড়ায়। সারাক্ষণ এসি আর বন্ধ ঘর থেকে
বেরুতে পেরে ভালও লাগছে।
রুমানার
নম্বর R দিয়ে আর নূপুরের নম্বর N দিয়ে,
অবচেতন মনেই নূপুরের নম্বরটা বেরিয়ে পড়ে। দীর্ঘকাল ফোনে তো দূরে থাকুক, সামনাসামনি
প্রয়োজনীয় কথাই তো হয় না। নূপুরের নম্বরে চাপ পড়ে যায়। রিং হতে থাকে। এই আচমকা
মুহূর্তে ফোন কেটেও দেয়া যায় না। বাজতে থাকে রিং। রায়হান নিশ্চিত, বেকার স্বামীর
ফোন নূপুর ধরবে না। অফিস, বায়ার সংক্রান্ত কোন জটিলতায় আঁটকে আছে ওর সময়।
যাক
বাজুক ফোন, পরে রায়হানের চাকুরী প্রাপ্তি সংক্রান্ত কোন প্রশ্ন করলে এই মিসড কলটাই
সাক্ষী হয়ে থাকবে। রায়হানকে অবাক করেই ফোনটা ধরে নূপুর।
-আজ আমি
জয়েন করেছি।
উদ্ভাসিত
হয়ে নূপুর জানতে চায় চাকুরী বিষয়ক সকল কিছু।
অনেকদিন পর সেই বিয়ের আগের মত করে কথা বলে।
রায়হান প্রথম চাকুরী পাবার পর যেমন আনন্দিত হয়েছিল নূপুরের ঠিক তেমনি আনন্দ টের
পাচ্ছে আজ ওর কণ্ঠে। রায়হান ওর ডিপার্টমেন্ট, পদবী, সকল সুযোগ সুবিধার বিষয়গুলো
পইপই করে সব জানাচ্ছে। শুধু রুমানাকে বাদ রেখে।
-অ্যাই, কি
রঙের শার্ট পরে গেছ আজ অফিসে?
হঠাৎ খেয়াল করে ওর পরনে রুমানার উপহার দেওয়া
কালকে কেনা নীল শার্টটা নেই। পুরনো একটা সাদা শার্ট তার উপরে দু’তিন রঙের
স্ট্রাইপ। কাল প্যান্ট। সেটাই বলে।
-ঠিক আছে,
আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে নীল শার্টটায় বোতাম লাগিয়ে ধুয়ে ইস্ত্রি করে দেব। কাল ওটা
পরে যাবে।
-অ্যাই শোন,
নীল শার্টটায় বোতাম না লাগানোটা কাজে লাগলো তাহলে?!
বলে হাসতে থাকে নূপুর। মুহূর্তেই রায়হানের
শুষ্ক বুকে মৌসুমের প্রথম বৃষ্টির ছোট্ট একটা ফোঁটা পড়ে।
ততক্ষণে
মোবাইলে রুমানার নম্বর ওয়েটিং শো করছে.........
0 Comments