বাবুরাম সাপুড়ে ও হালহুদের মহাভোজ
পুং- এই শুনছো? ওরা বুঝি শুতে এলো।
স্ত্রী- হুম, শুতে দাও এবং ঘুমাতে দাও। হাভাতের মত ঘুম না জমতেই ঝাঁপিয়ে পোড়ো না।
পুং- হাভাতে বলছো কেন গো! আমরা কি আর ভাত খাই!
স্ত্রী- ঐ হোলো- হারক্ত, হালহু, হাখুন......
পুং- তুমি কত বিদ্যান গো, থুড়ি, বিদুষী......
স্ত্রী- ওদের ভাষায় কথা বোলো না। ওসব লিঙ্গভেদ আমাদের মধ্যে নেই।
পুং- নেই কি গো! তুমি স্ত্রী, আমি পুং......
স্ত্রী- প্রলাপ বোকো না। স্ত্রী-পুরুষ ব্যাপারটা বায়োলজিক্যাল, তাই বলে শব্দের ব্যবহার দিয়ে সেই পার্থক্য মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন কী?
পুং- খ্যামা দাও। আর অমন বলব না।
স্ত্রী- সুন্দর ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করো। আমার সাথে কোন ত্যাড়াবাঁকা কথা নয়।
পুং- ত্যাড়াবাঁকা আবার কী বললুম? বললুম তো ক্ষমা করতে।
স্ত্রী- সেটাই ঠিকঠাক শব্দচয়নে, নির্ভুল বাক্য গঠনে বলতে পারতে।
পুং- ঠিক আছে তাই বলছি। ক্ষমা করো আমাকে। আর কখনো তোমাকে বিরক্তিকর কিছু বলব না।
স্ত্রী- বেশ। এবার ওদের দিকে মন দাও। এই যে বাতি নিভল।
পুং- ইস্! খিদেটা পেটে কেমন মোচড় দিয়ে জাগছে। আহা! কতদিন পেট ভরে খেতে পাইনে!
স্ত্রী- সাধে কি আর তোমাকে হারক্ত বলতে হয়! এই তো তিন রাত আগে দিব্যি পেট ফুলিয়ে খেলে।
পুং- সে কি আর পেটে আছে গো? গত তিন রাত তো ওষুধের ভয়ে বেরুতেই পারছি না।
স্ত্রী- হুম, মিছেই মশা ভেবে ওরা স্প্রে করছিল। কেমন বিদঘুটে এক গন্ধ তাতে। এই বাঙ্গালগুলো যা বোকা না! কামড়ের পার্থক্যও ধরতে পারে না।
পুং- ব্যাপার কি বলো তো? আজ যে ওরা স্প্রে না করেই ঘুমিয়ে পড়লো! শোনো, কেমন নাক ডাকছে!
স্ত্রী- বুদ্ধুরাম তো তুমি, তাই বুঝতে পারোনি। তোমার কি নাক বলেও কিছু নেই? ঘরে যে আজ একটা লোক কম তা গন্ধেও বোঝোনি? যে লোকটা একটু গা চুলকালেই ফস করে স্প্রে করছিলো সে আজ নেই। এই সুযোগ। সব্বাইকে জাগিয়ে তোলো। ছেলেপিলেদের ডাকো। ওদের মাসী-পিসি-খুড়ো-জ্যাঠা যে যেখানে আছে ডাক দাও। আজ ভোজ উৎসব হবে।
পুং- আগে চলো তুমি-আমি একটু চেখে আসি। তারপর গোত্রের সকলকে খবর দেই।
স্ত্রী- স্বার্থপর! সুবিধাভোগী! এজন্যই তোমাদের ওখানে বিপ্লব ফেল মেরেছে।
পুং- আর তোমরা বুঝি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে ফেলেছ?
স্ত্রী- এটা অনেক বড় রাজনৈতিক ব্যাপার। তোমার মত আদার ব্যাপারীর সাথে ও আলোচনা বৃথা।
পুং- চিরকাল কি আমাকে এমন হেলাছেদ্দা করবে গো? স্বামী হিসেবে একটু সম্মানও কি.......
স্ত্রী- চুপ করো! স্বামী কী? তুমি আমার সঙ্গী মাত্র। আমাদের সমাজে ঐ দুপেয়েদের মত স্বামীগিরির ব্যাপার চালু নেই। তুমি কি ওদের রক্ত খেয়ে খেয়ে ওদের বিধান আমাদের সমাজে চালু করার স্বপ্ন দেখ?
পুং- কী যে বলো! তাই কি হয়! তবে ওদের কথা শুনে শুনে একটু ওদের মতো করে বলতে-কইতে ইচ্ছে করে আরকি। শুনছিলে না, কাল সেই লোকটা কেমন বলছিল, আমি স্বামী......
স্ত্রী- হুম, সে যা বলে তাই ঠিক, যা করে তাই অন্যকে মানতে হয়। না মানতে চাইলেই হুমকি-ধামকি। অমন স্বপ্ন তুমি দেখো না যেন।
পুং- দেখবো না। তুমি যা বলবে আমি চিরটিকাল তাই মেনে চলবো। এখন খেতে চলো তো জানু। ঐ শোনো ওদের নিঃশ^াসের শব্দ কেমন গভীর হয়েছে। আর গন্ধটা কি খাসা মাইরি!
স্ত্রী- সেই বদগন্ধ গায়ের লোকটা নেই যে। আজ এরা সব খুশবুদার মাল।
পুং- ওহ্! কেমন মিষ্টি কচি কচি গন্ধ! আজ আমি পেট পুরে খাবো। এমন খাবো যেন আর জীবনেও খিদে না পায়।
স্ত্রী- তাই হবে শেষে। এমন মরণ খাওয়া খাবে যে মদো মাতালের মত ওখানেই পেট ফুলিয়ে পড়ে থাকবে। তারপর সকালে ওরা তোমায় দেখতে পেয়ে এক টিপে পেট গেলে দেবে। খবরদার বলছি, সেদিনের মতো নাটক কোরো না। আমি এই বুড়ো বয়সে তোমাকে বয়ে আনতে পারব না তা বলে দিচ্ছি।
পুং- বুড়ো কি বলছো গো! তোমার গায়ে এখনো যা জোর! আমার দেশের মেয়েদের মতো তুমি তো আর লুতুপুতু না......
স্ত্রী- যতই তেল দাও, লাভ নেই। কদিন ধরে আমার সারা শরীরে ব্যথা।
পুং- তুমি তাহলে আমাকে একটু কন্ট্রোল কোরো সোনা। জানোই তো, আমার সংযম কম।
স্ত্রী- সে আর বলতে! জীবনভর তোমাদের ‘কন্ট্রোল বেল্ট’ মিছেই আমাদের হাতে ঝুলে থাকে। ঐ জিনিস আমাদের হাতে তুলে দেয়ার নামে কী প্রেমই না তোমরা দেখাও! আবার তোমাদের দরকার মতো কখন যে বেল্ট কেটে নিয়ে পালাও!
পুং- অতটা অবিশ^াস কোরো না জান। এই আমি আমার মরা মায়ের দিব্যি কেটে বলছি, জীবনে কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না।
স্ত্রী- অমন ছারুও বলতো। আমি একটু মুখ ঝামটা দিলেই পায়ে পা জড়িয়ে বসে রাতদিন কাঁদতো। অথচ ঝগড়া-ঝাঁটি কিচ্ছু না, এক সিজনে গ-া কয়েক আন্ডা পাড়িয়ে দিয়েই সে একদিন হাওয়া!
পুং- আমাকে তার সাথে তুলনা কোরো না গো, দিলে বড় চোট পাই।
স্ত্রী- হয়েছে! অমন কত ন্যাকামো দেখলাম এ জীবনে! পুরুষের মুখের মধুতে আর এ পোড়া মন গলে না। তার উপর তুমি বাঙ্গালী বাবু, বুদ্ধির বলিহরি। দু’পেয়েদের সুটকেসে লুকিয়ে ভ্রমনের নামে এই দক্ষিণ দেশে এসে জুটেছ, তারপর আমার মতো সুন্দরী বাগিয়ে......
পুং- হে হে হে, তা আর বলতে! দেখো না, তোমায় কেমন সুন্দর বাংলা বুলিও শিখিয়ে ফেলেছি। কথা-বার্তায়-চালচলনে তুমি খাঁটি বাঙ্গালী বঁধূ।
স্ত্রী- ফের! ফের তুমি আমায় বঁধূ বলছো!
পুং- থুড়ি, থুড়ি, বঁধূ না বঁধূ না, বান্ধবী, থুড়ি, প্রেমিকা, নাহ্, মনের মানুষ, জীবনসঙ্গী, অর্ধাঙ্গী, বেটার হাফ......
স্ত্রীঃ সে তুমি মুখে যাই বলো, অন্তরে কী ভাব সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যাও, এখন তাড়াতাড়ি সবাইকে জাগিয়ে তোলো। দেখো, কেউ যেন বাদ না পড়ে। কেউ খাবে, কেউ খাবে না, এমন হওয়া উচিৎ না।
পুং- এই তোরা সব ওঠ রে! দেখ, কী খুনসুবাস! ওরে, তোরা জাগ রে!
(২)
দেখেন, আপনাদের হোটেলে উঠে আমাদের কী দুর্দশা! সারা রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারি নাই......
হোয়াট হুয়া ম্যাডাম?
হোয়াট হুয়া? ব্যাটা ভোঁদড়! না জানে ঠিকঠাক ইংরেজি, না হিন্দি। বাংলাতো বোঝে না এক বর্ণও। কী করে যে বোঝাই!
আপ কুচ বলিয়ে?
নাথিং বলিয়ে। ইউ জাস্ট সী, মাই ডটার, মাই ডটারস্ লেগস্, হ্যান্ডস্, সী হার ব্যাক..... দিজ রেড স্পটস.....
ওহ্ ম্যাম, দিজ আর এলার্জি, এলার্জি স্পটস.....
তোমার মাথা! সারারাত আমার মেয়েটাকে ছারপোকায় খেয়েছে। হেই, ডু ইউ নো বাগস্? বেড বাগস্? ডোন্ট ইউ নো দেম?
বাগস্! হোয়ার ম্যাডাম? হোয়ার বাগস্? মি দেখিয়ে......
এই বিছানায় ভরপুর আছে। উল্টালেই দেখতে পাবে। জাস্ট টার্ন ওভার দিস বেড......সী, দিস ইজ ওয়ান,রেড-ব্রাউন, ফিলড্ উইথ ব্লাড, বিয়িং সো ফ্যাট, ইট কান্ট মুভ অন....দিস ইজ এনাদার ওয়ান......লুক, লুক, দেয়ার আর মেনি......হায়! কাল কেন যে স্প্রে করে ঘুমালাম না! মশা না দেখে ভাবলাম মিছে কেন ঘর গন্ধ করা! ঐ গন্ধটা আমার একদম সহ্য হয় না। উনি যখন স্প্রে করতেন আমি নাকে কাপড় গুঁজে হাঁসফাঁস করতাম, তবু উনি বাচ্চাদেরকে মশা কামড়াবে বলে খুব করে স্প্রে করতেন- আসলে নিজেই মশার কামড় ভয় করেন কিনা....কই, এই ঘরে তো আমি কোনই মশা দেখিনি। কাল তাই উনি চলে যাওয়াতে আমি স্প্রে না করেই.....
হিয়ার ম্যাম, হিয়ার মি প্লিজ। হাম বাংলা মালুম নেহি। আই তামিল। জাস্ট নো লিটিল ইংলিশ, থোড়া ছে হিন্দি।
তা দিয়েই তো দিব্যি চালিয়ে খাচ্ছ বাবা। আয়-উপার্জনও মন্দ না। এই পায়রার খুপরির জন্য চব্বিশ ঘন্টায় ছ’শো রুপি। মুরগী খোয়াড়ে ঢোকার সাথে সাথেই একবারে পাঁচ দিনেরটা কষে নিচ্ছ। তারপর আর তো কোন সার্ভিসের বালাই নেই।......আবার চোখ গোল গোল করে চেয়ে থাকা হচ্ছে? লিসেন, মিঃ ম্যানেজার, উই আর ফ্রম বাংলাদেশ, হ্যাভ কাম সো ফার ফর আওয়ার চাইল্ডস্ ট্রিটমেন্ট। উই আর স্টেয়িং হিয়ার ফর হার গেটিং ওয়েল, নট ফর গেটিং এনি নিউ ডিজিস।
ডিজিস! ও নো, ম্যাডাম। নো ডিজিস হিয়ার। হিয়ার ক্লাইমেট ইজ হট, বাট নো ডিজিস।
আরে বুদ্ধু! ডিজিস কোন দেশে নেই? তোমাদের এখানকার গরমে তেতেপুড়ে কাবাব হয়ে যাচ্ছি সে নিয়ে তো আর নালিশ করতে বসিনি। মরার উপর মরছি ছারপোকার যন্ত্রণায়, সেটাই দেখ না বাবা। হোটেল চালায় দিব্যি ভাল-মন্দ খাচ্ছিস, আর আমাদের খাওয়াচ্ছিস ছারপোকা দিয়ে?
বাংলা মালুম নেহি ম্যাডামজি......
মালুম নেহি তো মঙ্গল হ্যায়।
(৩)
অল ক্লিয়ার ম্যাডামজি, অল বাগস্ মে মার ডালা, আপ ডর নেহি হোতা.....
ভেলোরের থোট্টাপুলায়াম রোডের অরপুত্থাম লজের ম্যানেজার মিসেস হোসেনকে দিগবিজয়ী হাসির সাথে খবরটা দেন।
‘হয়েছে বাবা, ওষুধ ছিটায়ে কয়টা ছারপোকা মেরে যে হাসি দিচ্ছ বখতিয়ার খিলজি গৌড় জয় করেও বোধহয় সে হাসি হাসতে পারেন নি।’ মিসেস হোসেন মনে মনে ভাবেন। মুখে আর কিছু না বলে উঠে তার ঘরের দিকে যেতে যেয়ে দেখেন ক্লিনার মেয়েটা বিরক্তি ও বিবমিষা মাখা মুখে সতর্ক হাতে একটা বেলচা তুলে ধরে তার ঘর থেকে বের হচ্ছে। কাছাকাছি এসে তিনি যা দেখেন তাতে তারও কেমন বিবমিষা বোধ হয়। হলদে প্লাস্টিকের বেলচার পরে অগণিত লালচে খয়েরি অবয়ব চিৎ হয়ে পড়ে কিলবিলিয়ে নড়ছে। কিছু দেহ ছোপ ছাপ রক্তের মধ্যে গলে পড়ে আছে। এসব রক্ত তার ও প্রাণপ্রিয় সন্তানদের। তবু মানবদেহ থেকে বিসর্জিত যে কোন পদার্থই মানুষের চোখে অপ্রীতিকর, ঘৃণা উদ্রেককর, এমনকি হোক তা প্রিয়জনের। তাই সৌন্দর্যপিপাসু মিসেস হোসেন একটু শিউরে উঠেই চোখ সরিয়ে নেন। কিন্তু মনের চোখ দিয়ে দেখলে তার শিল্পী অন্তর হয়তো এখানেই দেখতে পেতেন লোলুপতার এক রক্তাক্ত ইতিহাস। জগৎ ও জীবনের নানা অধ্যায়ে ঘটে চলা অগণিত রক্তাক্ত প্রান্তরের মতোই এখানেও একই অপরিমিত অসংযমী অনিয়ন্ত্রিত খাই খাইয়ের করুণ পরিণতি।
.................................................................................................
গরীবের ঘর।
খানা-খাদ্যের ঠিক নেই। ঘরবাড়ির আব্রু নেই। শুধু মেয়েদের নামগুলো মনোহর। মেয়েও কম না, সব মিলায়ে দেড় গ-া। আল্লাহপাকের রহমতে খালি মাইয়্যে না, ছাওয়ালও পোনে এক হালি। তয় গাও-গেরামের আর দশজনের মতো ছাওয়াল নিয়ে গহর পাগলার কোন আহ্লাদি নেই। বৌ তার বছর বিয়ানি- ফি বছর এট্টা করে বিইয়েই যাচ্ছে। মাঝে একবার একসাথে একজোড়াও বিইয়েছিল। বাঁচেনি। এট্টা করে বাচ্চা না হয় মায়ের বুকের ওম আর মালশার আগুনের তাপে শীতকালেও ঠিকঠাক টিকে যায়। কিন্তু গরীব-গুর্বোর ঘরে একজোড়া গ্যাদার গতি কে করে? না, চার মেয়ে এক ছেলের পর আরেক জোড়া মেয়ে হয়েছিল বলে গহর কিছুমাত্র বেজার হয়নি যে হেলা করে আঁতুড়ে মারবে। ও পাড়ার শামছুর মতন সে কন্যেবিদ্বেষী নয়। হতভাগা শামছুর রকম দেখ- বৌ তার পর পর দুটো চাঁদপানা মাইয়্যে জম্ম দিলে হারামজাদা বৌয়েরে তিন তালাক দেয় আর কি! ভাগ্যি যে বৌডার মাইজে ভাই পুলিশের আরদালি না কী- তাই সে যাত্রায় কোনমতে রক্ষা। তয় তালাক ঠেকে গেলেও ঠেকে থাকে না শামছুর হম্বিতম্বি। যাচ্ছেতাই মুখ করার পাশে সে শ^শুরবাড়ির আঁতুড় ঘরেই তেড়ে যায় বৌয়েরে মারতে। আরদালি ভাই হয়তো সেখানে উপস্থিত ছিল, তাই শামছুর বৌ-বাচ্চা সে যাত্রায় বেঁচে যায় এবং ভালোমানুষ বৌটা স্বামীর রাগ পড়ার অপেক্ষায় মাসতিনেক বাপের বাড়ির মাটি কামড়ে পড়ে থেকে শেষে নিজ থেকেই ছানাপোনা কোলে ফিরে এসে শামছুর খোড়ো পোড়ো ঘর-দোর আলো করে তোলে।
তিনবারের বার বৌয়ের বাপ-ভাইয়েরা নাইয়র নেয়ার গরজ না দেখালে শামছু দয়াপরবশ হয়ে বলে, যা বিয়েবি, আমার বাড়ি থাহে বিয়ে, আমার ইচ্ছে হলি সে চান-সুয্যির মুখ দেখবি, ইচ্ছে না হলি না। বৌ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সময়ের আগেই তিন দিন ব্যথায় কাৎরে এক মৃত কন্যা প্রসব করে। এর পরের বার শামছুর বৌ মোটামুটি সুস্থভাবে এট্টা জিওল রঙের(শামছুর বরণের মতন) মাইয়্যে জম্ম দিলে শামছু শ^শুরকে ডেকে সোজা আন্ডা-বাচ্চাসহ মুরগী বুঝে নিয়ে পথ মাপতে বলে। নারাজ শ^শুর প্রতিবাদ করলে শামছু তার মস্ত গোল চোখ জোড়ায় সিঁদুরে মেঘ ঘনিয়ে বলে, ঐ খোল খালি মাগী জম্মাবার খোল। শামছু মিয়া ওতে আর মোতে না।
গ্রাম জুড়ে ছি-ছিক্কার আর হাসি-তামাশা দুইই চলে দিনকতক। অর্থাৎ নিস্তরঙ্গ গ্রামজীবনে শামছু মিয়া বেশ একটু আমোদ যোগালো। কিন্তু দিনে দিনে শামছুর ঘর যে শ্মশানপুরী! বাধ্য হয়ে একদিন সে বৌয়েরে আনতে এক পাড়াত ভাইপো পাঠায়। আর দেখ, বৌটা কেমন সুড়সুড় করে এক কাঁখে পুঁটুলি, আরেক কাঁখে চামচিকার ছা তুল্যি ছয়মেসে ছানা, আর হাড়-চামড়া সর্বস্ব বছর ছয়-আটের দুটো মেয়ে নিয়ে টলমল পায়ে বাড়ি ঢুকে ‘যেন কিছুই হয়নি’ ভঙ্গিতে শামছুর ঘর-সংসার ফের ভরে তোলে। মাইয়্যেমানুষ পারেও বটে! বছর না ঘুরতেই শামছুর বৌ শামছুরে এক পুত্রধন উপহার দিয়ে সারে। কিন্তু ফের বছর না আসতেই শামছুর মুখে কালি, চোখে শর্ষে ফুল। এত সাধের পুত্তুর বুঝি তার বোবা-কালা-হাবলা!
গহর পাগলা নামে পাগল হলেও বিবেচক মানুষ, হুঁ। ঘরে বৌ থাকলে বছরে এট্টা কি দুডে বাচ্চা বিয়োবে- হোক তা ছাওয়াল কি মাইয়্যে। পুরো ব্যাপারটাই তো আল্লা পাকের ইচ্ছে, মাইনষের এতে হাত কী! কিন্তু পরিকল্পনার আপারা কয়, এতেও নাকি মাইনষের হাত আছে! ব্যাপারটা গহরের মাথায় ঠিক খেলে না, খেলে না তার বৌয়ের মাথায়ও। আপারা রঙিন বইয়ের ছবি দেখায়ে কী সব বোঝায়, আর বৌটাা শরম মাখা মুখে দাঁতে আঁচল কাটতে থাকে। গহরের অবশ্য অত শরম-ভরম নেই। সে বাড়ি থাকতে পরিকল্পনার আপারা এলে সোজা তাদের সারা শরীরে তার জ¦লজ¦লে দৃষ্টির অমার্জিত জিহ্বা বুলোতে বুলোতে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসে। আপামনি গো, বালো আছেন? গহরের কুশল জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতেই আপামনি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। এরপর গহর পাগলা নিতান্ত নাদানের মতন মুখভঙ্গি করে আপামনির কাছে কনডমের ব্যবহার কৌশল জানতে চায়। না, এ ব্যাপারটা বৌয়ের বুঝে নিলে চলবে না। বৌয়ের বুঝব্যবস্থার পরে বড় ভরসা গহরের নেই। নাদান মাইয়্যেমানুষ- কনডম খায় কি মাথায় দেয়, তাই কি সে জানে! কাজেই গহর নিজেই এটা আপামনির থেকে শিখে নিয়ে ‘টিরাই’ করতে চায়। গহরের বৌয়ের হাতে একপাতা বড়ি ধরিয়ে তড়িঘড়ি ব্যাগ গুছিয়ে কেটে পড়া আপামনি আর কোনদিন গহরের বাড়ি মুখো হয় না। সরকারের পরিকল্পনা ভ-ুল করে গহরও সুস্থ্য-সবল ছয় মেয়ে তিন ছেলের বাপ হয়ে দিব্যি বেঁচে-বর্তে থাকে।
এই গহরের মেয়ে সুদূরিকা।
সহায় সম্পদহীন গহর পাগলা ছানাপোনার মুখ ভরাবার তাগিদে জন খাটতে ‘বিদ্যাশ’ যায়। তার এই বিদ্যাশ নিজ জেলার বাইরে বিভিন্ন মফস্বল শহর, এমনকি চেনা এলাকার বাইরে কোন অচেনা গ্রাম। হরেক রকম কাজে শ্রম বেচে যা সে হাতে পায় তা ঘরে এনে দিনকতক বেশ মৌজে থাকে। শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে সে ছেলেপুলের জন্য সস্তা মিঠাইয়ের বেশি কিছু না আনলেও বৌয়ের জন্য ঠিকই আনে রেশমি চুড়ি, রঙিন ফিতা, এমন কি এক কৌটা ¯েœা কিংবা বাসনা সাবান। আরেকটা বিশেষ জিনিস সে শহর থেকে সময় সময় বয়ে আনে- নাম। হ্যা, শ্রুতিমধুর নামের পরে গহরের বড় আকর্ষণ। তার মেয়েদের নাম তাই গ্রামের আর সবার চেয়ে আলাদা।
কত বয়স তখন সুদূরিকার? বারো-তেরো? হয়ত তাই, কিংবা তার চেয়ে কম। রোদেপোড়া রুক্ষ-কালচে ত্বক, ক্ষীণ-খর্ব দেহ, আর শ্রীহীন লালচে-বাদামী চুলের ঝুঁটি- এ সম্বল নিয়ে সে এলো গ্রামসম্পর্কীয় এক ফুপুর ঢাকার বাসায়। চাকরীজীবি ফুপুর কচি ছেলের কিলটা-চড়টার সাথে সবার উচ্ছিষ্ট ও বাসী খাবার এবং ফুপুর শত সতর্কতা সত্ত্বেও তার সংরক্ষিত দামী খাবারের ভা-ার সাবাড় করে অল্পদিনেই সে দিব্যি ফুলে-ফেঁপে উঠল। চোত-বোশেখের নিদারুণ দাহে জ¦লে-পুড়ে খাক হওয়া দূর্বাদল আষাড়ের এক টানা ঢলেই যেমন সবুজ-সতেজ হয়ে কলকলিয়ে ওঠে, সুদূরিকার শরীরও তেমনি জেগে উঠল।
হঠাৎ একদিন ফুপু ভেঙ্গে দিল তার দশ বছর ধরে গড়ে তোলা শত সাধের সংসার।
কালবোশেখের এক ঝড়ে মাথার উপর থেকে চাল উড়ে গেলে কেমন হয় তা জানে সুদূরিকা, মেয়ে মানুষেরে স্বামী তালাক দিলে তার কী দশা হয় তাও সে দেখেছে। কিন্তু এটা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না যে মেয়েমানুষ কোন ভরসায় নিজের ঘরের চাল উড়ায়। চাকরি আছে, তাই এত দেমাক? কিন্তু ফুপার দোষটা কী? সুযোগ পেলেই সুদূরিকাকে.......ফুপু বুঝে ফেলছে, নাকি দেখছে কিছু? এত হিংসে!! সুদূরিকার যে এটা খুব ভাল লাগে তা বুঝেই বুঝি অত রাগ?
রাতভর ফুপার হাতে ঠেঙ্গানি খেয়ে ভোররাতে এক কাপড়ে ফুপু যে কোথায় পালায়ে গেল! দিন চারেক পরেই এলো তার উকিল নোটিশ। ফুপা সারাদিন গুম হয়ে বসে থেকে শেষে কাঁদতে লাগলো। আর তখনই সুদূরিকার মনে হলো যে এখানে আর না। তবু তাকে সেখানে আরো একমাস থাকতে হলো। তার বাপের কাছে খবর দিতে ও ফুপুর বাপের খরচে তার বাপের ঢাকায় এসে তারে বুঝে নিতে এ সময়টা গেল। এ এক মাসে সুদূরিকা একবারও ফুফার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। ফুপাও যেন কী বিরাগে তার দিক থেকে মুখ ফিরায়ে থাকল।
বাপের ঘরে ফিরে এসে ফের সেই হাভাত দশা। দিন পনেরোতেই অসহ্য হয়ে সে উপায় খুঁজতে লাগল। উপায় মিলেও গেল সহজে। আরেক পাড়াত ফুপুর চট্টগ্রামের বাসায় সে চালান হয়ে গেল।
এখানকার ফুপা বড়ই চরিত্রবান। তার চরিত্র যেন ফুলের চেয়েও বেশি পবিত্র। সুদূরিকা সুদূরে থাক, নিজের স্ত্রীর দিকে ‘বিশেষ’ চোখে তাকাতেও তার যেন অনীহা। এখানে খাওয়া-দাওয়া ইচ্ছে-স্বাধীন, বিনোদন পরিমিত। সবচে বড় কথা চড়-চাপড় দেয়ার মত কেউ এ বাসায় নেই। তবু দেখ সুদূরিকার মন সময় সময় কোন সুদূরে হারিয়ে যায়। মনে পড়ে আগের বাসার ফুপার কথা। উষ্ণ রক্তের তীব্র ঝলক তার শরীরের কোনায় কোনায় শিহরণ জাগায়।
কয়েকদিনেই শরীর জুড়ে অসহ্য দাপাদাপি। এক তীব্র সুখের দুর্ণিবার কামনায় তার সারা শরীরের প্রতিটি কোষ অসহনীয় রকম উন্মুখতায় তাকে পাগল করে তোলে। সম্পূর্ণ অকারণেই সে কখনো হাসে, কখনো কাঁদে। হিস্টিরিয়াগ্রস্থ মেয়েটার দুর্দশায় বিবেচক ফুপু বিপন্ন বোধ করলেও এ থেকে তার আশু পরিত্রাণ দরকার। কর্মব্যস্ত জীবনে কাজের মেয়ে নিয়ে এত হ্যাপা কাহাতক ভাল লাগে! কাজেই ফের একমাসের মাথায় সুদূরিকা তার মায়ের কোলে ফিরে আসে।
কিন্তু নি¤œ আয়ের এ দেশেও গৃহপরিচারিকা প্রায় দুষ্প্রাপ্য জিনিস। যখনকার কথা বলছি তখনকার সরকার দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার খোয়াব দেখেনি বটে, তবে নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠীর নারীদের সামনে একদিকে তৈরিপোশাক কারখানার জনবল চাহিদা হা মেলে আছে,অন্যদিকে একবেলা পেটে জাবনা পেলে আর ফিরে শুতে অনিচ্ছুক সক্ষম-অক্ষম নাগরিকদের জন্য নানারকম ভাতা ব্যবস্থা সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিছিয়ে চলছে। কাজেই সুদূরিকার পক্ষে চাকরি হারানোর চেয়ে চাকরি পাওয়া ঢের সহজ। কোন পরীক্ষা নেই, কর্মদক্ষতার প্রশ্ন নেই, চরিত্রিক সনদের বালাই নেই, ¯্রফে এক জোড়া করে হাত-পা-চোখ-কান থাকলেই চলে। মাথা আছে কি না সে প্রশ্ন কারো মনে নেই কারণ মাথার এক্ষেত্রে দরকার নেই, বরং মাথা থাকাটা ক্ষেত্র বিশেষে বিপজ্জনক হতে পারে। কাজেই বেকার জীবনের আনন্দ এক সপ্তাহ উপভোগ না করতেই সুদূরিকার চাকরি হয়ে যায়।
এবারের চাকরি নিজ জেলার ছোট শহরে। মন চাইলে মাসে মাসে বাড়ি যাওয়ার সুবিধে আছে। প্রথম দুই মাসে সুদূরিকা তা করেও। কিন্তু তৃতীয় মাসে তার আর বাড়ি যেতে মন টানে না। নার্সারি পড়–য়া মালকিনের কলেজ পড়–য়া গৃহশিক্ষককে চা-নাশতা দিতে তার কী যে ভাল লাগে! কিন্তু জগতে গরীবের কোন ভাল লাগাই বড়লোকেরা সুনজরে দেখে না। এখানেও সে নিয়মের ব্যত্যয় হয় না। উকিল মালিকের পুলিশ বৌ একদিন তাকে এই বলে হুমকি দেয় যে ফের যদি সে নাশতা দেয়ার নাম করে নাতাশা বেবির পড়ার ঘরে ঢোকে তো তাকে সোজা বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে।
নাতাশা বেবির টিচারকে ফুলির মা নাশতা দেয়। অক্ষম আক্রোশে সুদূরিকা বালতিভরা পানিতে স্যাভলন ঢেলে তাতে ন্যাতা চুবিয়ে ঘর মুছতে শুরু করে। কোনমতে এক ঘর মুছেই সে সোজা গিয়ে ঢোকে বেবির ঘরে। দু’হাত কোমরে রেখে ছোটখাটো শরীরকে টান টান করে আগ্রাসী চোখ জোড়া সোজা শিক্ষকের চোখের ভিতর দিয়ে বুকে বিঁধিয়ে বলে, ঘরটা মুছতে পারি?
তড়াক করে শিক্ষক সাহেব উঠে দাঁড়ান, নিশ্চয় নিশ্চয়।
সুদূরিকা ফিরতে উদ্যত হয়, না, থাক। বেবির পড়ায় ডিস্টার্ব হবে।
¤্রয়িমান শিক্ষক ফের বসে পড়েন। ঘর ছেড়ে বেরুতে বেরুতে সুদূরিকা যেন আপন মনে চাপা অথচ শিক্ষক ঠিক শুনতে পায় এমন স্বরে বলে, কাপুরুষ!
শব্দটা শিক্ষক মাত্র কয়েকদিন আগে এক প্লে পড়–য়া ছাত্রের মায়ের মুখ থেকে উপহার পেয়েছেন। এখানে কাজের মেয়ের মুখে.....। লজ্জ্বা-অপমানে কান ঝাঁ ঝাঁ করতে করতেও তার হঠাৎ বেশ মজা লাগতে থাকে। এই মেয়ে এমন ওজনদার শব্দ পেল কোথায়! জিজ্ঞেস করার দরকার পড়ে না। বুদ্ধিমান শিক্ষক ঠিক বুঝে নেন যে সারাদিন হা করে গেলা বাংলা ছবিতে এ জাতীয় ডায়লগ থাকে প্রচুর। তবে এ মেয়েটার প্রশংসা করার মত যোগ্যতা এর বাচনভঙ্গি। এ যে রকম বাংলায় কথা বলে তা আয়ত্ত করা এ শ্রেণীর মেয়েদের কম্ম তো নয়ই, অনেক উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের জিভের দখলেও তা থাকে না। তাছাড়া এই মেয়ের আরেকটা বড় গুন- গানের গলা ও গায়কী। অধিকাংশ সময়ই সে গুনগুনিয়ে যে গান করে, তাতে কান পাতলে যে সুস্বর শোনা যায়, তা যেমন সুরেলা, তেমনি মিষ্টি। কখনো কখনো পাশের ঘর কি ব্যালকুনি থেকে মৃদু চাপা খোলা গলার দুয়েকটা কলিও শোনা যায়। প্রকৃতিপ্রদত্ত অমৃত কণ্ঠে মাখা না থাকলে অমন সুর কখনো বেরুতে পারে না। এর মধ্যে এক দিন তাকে একটা সাম্প্রতিক সময়ের জনপ্রিয় গান গাইতে শোনা গিয়েছিল। একটা শিশুতোষ ছড়াকে রক নাকি জ্যাজের আদলে গান করে গাওয়া হয়েছে। অতিপরিচিত ছড়ার অংশ সুর করে গাওয়া হলেও এরই সাথে আছে র্যাপ নাকি কী। এত দ্রুত একগাদা কথা নিচুস্বরে বলে যাওয়া হয় যার অর্থ উদ্ধার করতে হলে গায়িকার মুখ থেকে প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদা করে শুনে খাতায় লিখে নিয়ে পড়তে হবে। কী থেকে কী হয়- এত দিনে শিক্ষক মেয়েটার প্রতি মনোযোগী হন। আর মনোযোগী হয়েই বুঝতে পারেন যে এ ঘরে আসার ব্যাপারে মেয়েটার পরে বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এবার তার অপমান বোধ হয়, আর হয় ক্ষোভ। এখন ফুলির মা নাশতা দিতে এলে পেটে খিদে থাকা সত্ত্বেও সুখাদ্যে রুচি হয় না। আগে এই নাশতার জন্য মনে একটা উদগ্রীব অপেক্ষা থাকতো। বিকেলের নাশতাটা নিখরচায় এখানে হলে তার পেটটাও ভরে আবার রাতটাও মুড়ি চিবিয়ে কাটিয়ে দেয়া যায়। তাই কোন চক্ষুলজ্জ্বার ধার না ধেরে সব প্লেট খুটে পরিষ্কার করে খাওয়াটাই ছিল শিক্ষকের অভ্যাস। আর রিজিকের মালিক আল্লাহ্পাকের রহমতে নাশতা যা আসতো তাতে পেট ভরে ঢেঁকুর উঠতো। কিন্তু এখন ফুলির মা যা নাশতা আনে তা পেটের কোন কোনায় গিয়ে পড়ে তা মালুমও হয় না, আবার সবটা খেতেও ইচ্ছে করে না।
পেটের খিদে নাকি অন্য কোন ক্ষুধাবোধের তাড়নায় গৃহশিক্ষকের আচরণ হয়ে ওঠে ঘরবিবাগী ঘরানার। ছাত্রীর হোমওয়ার্কের খাতায় এমন কিছু আঁকিবুকি ফুটে ওঠে যাকে শুধু বিমূর্ত চিত্রকলা বলে চালিয়ে দেয়া যায় না। তাছাড়া টুকটাক আঁকাজোকার অভ্যেস থাকলেও তিনি তো আর পেশাদার ড্রয়িং শিক্ষক নন। আর নাতাশা বেবিকে ড্রয়িং শেখাবার দায়িত্বও তাকে দেয়া হয়নি। কাজেই নাতাশার মা একদিন মাসের মাঝখানে শিক্ষকের হাতে পুরো মাসের বেতন তুলে দিয়ে সোজাসাপ্টা খোদাহাফেজ বলে দেয়। সুদূরিকাও সসম্মানে নিজ দায়িত্বে বাড়ি ফিরে আসে।
এবার সুদূরিকার বিয়ে।
আপনারা বলতেই পারেন যে এ নেহাত বাল্যবিবাহ, কাজেই দ-নীয় অপরাধ। সুদূরিকার বাপের জেল হওয়া উচিৎ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। নিষ্কর্মা সুদূরিকার মাথায় কোন আইন নয়, কোন দ- নয়, কোন অপরাধবোধও নয়, নিতান্তই দুটো খিদে কাজ করে। পেটের খিদেয় মাথা ঘুরলে মাথা বলে চেয়ে খা, নয় কেড়ে খা, নয় করে খা। আর বিশেষ ক্ষুধায় কাতর হলে বেকুব মাথা ঝিম মেরে সেই ক্ষুধাকে উপভোগ করতে করতে আরো যেন উষ্কে দিতে থাকে। মেয়ের শরীরের দিকে চেয়ে আর তার ছটফটানি বুঝে গহর পাগলা সোজা পথটাই ধরে। সুদূরিকার বিয়ে হয়।
কিন্তু খিদে ঘোচে না। এখানেও সেই হাভাত দশা।
নিষ্কর্মা এক কুঁড়ের বাদশা সুদূরিকার বর। গুনের মধ্যে তিনি প্রচুর গাঁজা টানতে পারেন আর গান গাইতে পারেন। তা গান তো সুদূরিকার বাপেও ভাল গায়। গহরের জারি শুনে তারিফ করেনি এমন মানুষ এ তল্লাটে আছে নাকি? গ্রামের কাঠমোল্লা পর্যন্ত গহরের জারিগানের তারিফ করে জারিকে হালাল বলে ফতোয়া দিয়েছে। যুক্তি হিসেবে অবশ্য এটাও বলেছে যে জারিতে বাদ্যিবাজনার ব্যবহার হয় না, অন্ততঃ গহর তার আসরে বাদ্য বাজায় না। তবে সুদূরিকার স্বামীর একটা ঢোল আর সারিন্দা আছে। আছে একজোড়া করতালও। সুদূরিকার ধারণা যে বাপ তার চালচুলো নয়, ঐ ঢোল-সারিন্দা দেখেই তারে দলে টানতে মেয়ে বলি দেছে। বাপের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসেবেই কিনা সুদূরিকা একদিন স্বামীর ঘর ছেড়ে পালায়।
কিন্তু পালিয়ে কোন সুদূরে আর যেতে পারে সুদূরিকা?
গল্পটা এ পর্যন্তই। এক অখ্যাত লেখকের লেখা এ গল্পের পরের অংশটা কোথায় আছে বা এর পর আদৌ কিছু আছে কি না তা আমার আর জানা হয় না কারণ পুরনো ছেঁড়া সাময়িকীর পাতা ঠিক এর পর থেকেই আর নেই। কিন্তু গল্পটাকে আমার টানতে ইচ্ছে করে বড়। সুদূরিকার জীবনকাহিনী কি এক স্বামীর ঘর ছেড়ে গিয়ে শেষ হয় কোনদিন! এর পর কী হতে পারে তার? আবার বিয়ে? এবার নিজের পছন্দে? তারপর দুটি সন্তান- একটি ছেলে একটি মেয়ের সুখী সংসার? নাকি আবার হাতবদল? বদলাতে বদলাতে অবশেষে কোথায় ঠাঁই? ঠাঁই কি আসলে মেলে? দেহজ কামনা ও আর্থসামাজিক নিরাপত্তার নির্ভরতা খুঁজে ফেরা সমাজমানস যে ঠাঁই খুঁজে ফেরে তার সন্ধান কি পায় এই সুদূরিকা? মাথায় আমার ঘুরতে থাকে রহস্যঘেরা এক নারী- কোন অদেখা রহস্যময়ী সুদূরিকা।
নামাপাড়া বস্তির কাছাকাছি উঠতি অভিজাত এলাকা মালতিনগরে আমার বাস। মধ্যপ্রাচ্য থেকে টাকাকড়ি করে ফিরে বছর দশেক হলো এ শহরে ঠাঁই পেতেছি। শহরটা সুন্দর। বড় শহরের নাগরিক সুবিধার পাশাপাশি ছোট শহরের মাধুর্য ও গ্রামীন সারল্যমাখা বড় অদ্ভূত এ শহর। সেদিন শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির এ দিনটাতেও সকালবেলা একটু আয়েস করে গড়াগড়ি দেয়ার জো নেই। আটটা না বাজতেই গিন্নী ঠেলে তুলে হাতে ধরিয়ে দিল ইয়া বড় এক লিস্টি- বাজারের। সকালবেলার বাসী মুখের মতো মনটাও হয়ে গেল তেতো। সেই বিস্বাদ মুখ ও তিক্ত মন নিয়েই পথ চলছিলাম পায়ে হেঁটে। আমার বাসা থেকে বাজার দূরে নয়। নামাপাড়ার পাশ দিয়ে একটু হেঁটে এসপি ব্রিজ পার হলেই বৌবাজার। এখানে বৌ বিক্রি হয় না বটে, তবে বৌয়েরাই বাজার বসান, আর বর-বৌ নির্বিশেষে ক্রয় করে ফেরেন। খুব ভোরে বসা এ বাজারে মাছ-সব্জি পাওয়া যায় খুব টাটকা। সকাল আটটা মানে বাজার প্রায় সাঙ্গ। সেই অবেলায় আমি এলাম ইয়া বড় লিস্টি নিয়ে বাজার করতে!
ক্রেতাশুন্য বাজার প্রায় খাঁখাঁ। অস্থায়ী দোকানগুলো গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। বাজারের মাঝখানের সড়কটাতে রিক্সা-সিএনজি চলছে বেশ। তাদের ক্রিংক্রিং আর ভোঁভোঁ না থাকলে এলাকাটা এতক্ষণে নির্জন-নিঃশব্দ হয়ে পড়তে পারতো। এমন সময় তুমুল হট্টগোল। কয়েকজন নারী-পুরুষকে জাপ্টাজাপ্টি করতে দেখে এগিয়ে যাই। অতঃপর তাদের কান্ড দেখে থমকে যাই। আমার মুখে ভাষা সরে না।
একজন নারী একজন পুরুষের বুকের পড়ে চড়ে বসে তার গলা টিপে ধরেছে, পুরুষটির জিভ বেরিয়ে এসেছে, চোখ ঠিকরে বেরুচ্ছে। আরো দুজন নারী অসহায় লোকটার হাত ও পা চেপে ধরে রেখেছে। দৃশ্যটা নারকীয়। অথচ অনেক নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে তা দেখছে এবং ভাব-ভাষায় মনে হলো তারা আক্রান্তের পক্ষ না নিয়ে বরং আক্রমনকারীদেরকেই উৎসাহ দিচ্ছে। আমি কী করব, কী বলব তা বুঝে ওঠার আগেই শুনতে পেলাম মারমুখী নারী বলছে, মাংগির পুত, হামার সাথ বিটলামি! বসায়া বসায়া তিন বচ্ছর খাওয়ানু, বিদ্যাশ করা টিহা দিয়া দোকান কর্যা দিনু, এক্কন পাংখা গজাতে নাগজাতেই সব বেচাবুচ্যা উড়াল দেয়ার তাল! খাড়া, তোর পাংখা আগে কাটে লই।- বলেই সে লোকটার হাতে দিল এক জোর মোচড়। লোকটা তীব্র গগনবিদারী স্বরে আর্ত চিৎকার করে উঠল। রণচ-ী মূর্তিধারিনী মহিষাসুর মর্দনের ভয়াবহতায় পুরুষটির একহাত পা দিয়ে চেপে ধরে আরেক হাত ঘানিগাছের মতো ঘুরিয়ে চলল। তার তীব্র আর্তনাদ আমার কানে ইস্রাফিলের সিঙ্গা বাজিয়ে চলল। এই বুঝি দিবালোকে অদৃশ্য গ্রহ-নক্ষত্রেরা আমার মাথার পরেই খসে খসে পড়ে!
হঠাৎই আমি আমার নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক অনন্য বীভৎস্যতার শিকার রূপে। আমি পড়ে আছি রাজপথে কুকুরের বিষ্ঠার পাশে। আমার সারা গায়ে ধুলো-বালি, মুখ ভরা মাটি। আমি প্রাণপণে চিৎকার করতে চাচ্ছি; পারছি না। আমার বুকের পরে পা রেখে দাঁড়িয়ে যেন ডজন ডজন অসুরদলিনী, দুগর্তিনাশিনীর রুদ্রমূর্তি। তাদের করাল চোখের অগ্নিদৃষ্টি আমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে দিতে বলে চলছে,কষ্টের টেকা, বড় কষ্টের টেকা। বিদ্যাশে খায়া, না খায়া, গতরের রক্ত পানি করা টেকা। তুই তা জুয়া খেল্যা ফুকে দিলি?
মুই কেলাশ থিরি তামাইৎ পড়ছিলাম। মোর নাম, মোর বাপের নাম, দাদার নাম সবই মুই বাংলায় লেখতে পারি। হ্যারা বাংলা বোজে না। হ্যারা সব কতাই কয় আরবি-উর্বিতে, খালি আজানডা দেয় বাংলায়। হেই দ্যাশে খাওন-পিন্দনের কুনো অভাব নাইক্যা। তাগো খাওন, ও মোর সুবানাল্লাহ! হেইডা যদি দেইখতা! আস্তা দুম্বা রোস্ট না কি জানি কইরা চাক্কু দিয়া কাইটা কাইটা খায়। মাইয়া লোকেরেও তারা অমনে কাইটা-কাইটা লবন-মরিচ দিয়া বড় সোয়াদ কইরা খায়। মোরেও তারা.........আমার সেই টেহা, আমার গতর বেচ্যা পাওয়া ডলার ভাঙ্গানো টেহা দিয়া তুই নয়া হৌরবারি হদাই অরস?
নামবিলাসী বাপে ভালোবেসে নাম দিয়েছিল সুদূরিকা। সুদূরে না, আপনাদের হাতের নাগালে, পার তলায় চড়-চাপড় আর লাথি-গুঁতো খেয়েই আমি বড় হয়েছি। বাড়ছি, কিন্তু বড় হতে পারিনি। জীবনে কোনরকম বেঁচে থাকাই যাদের নিয়তি তারা কি আর শেষপর্যন্ত বড় হয়? কেউ কেউ হয়তো হয়- অর্থে,কর্মে কিংবা মনে। তবে সবার স্বপ্নটা কি বড় হতে পারে না? স্বপ্ন দেখতে তো আর রাজপ্রাসাদে ঘুমাবার দরকার পড়ে না। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখতে না জানলে কী করে ভাবতে পারেন আপনারা যারে বলেন শ্রেণীদ্বন্দ্বের বিপ্লব, আর কী করেই বা বদল আশা করেন এই অসভ্য হয়ে পড়া সভ্যতার? ‘মানুষের যেকোন বিজয়ের, যেকোন অর্জনের স্বপ্নটাই ভিত্তি।’- এই দামী কথাটা আমার না, আমার এক জ্ঞানী মালিকের। তিনি আরো বলতেন, ‘এই স্বপ্নবাজ মানুষেরা একদিন ছড়িয়ে পড়বে এ পৃথিবী ছাড়িয়ে বহুদূরে- গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, অন্য কোন নক্ষত্রলোকে।’ আমি জ্ঞানী না, জ্ঞানী-গুনী মানুষের মতো বড় বড় স্বপ্নও আমি দেখতে পারি না। অথচ আমিও কিন্তু জীবন পার করেছি স্বপন ঘোরে। কি দিবা আর কি নিশা- সবেতেই আমার স্বপ্ন ছিল বড় লোক হওয়ার। ছোট্ট থেকে আমি স্বপ্ন দেখতাম- আমি শহরের কোন ধনীলোকের বা অফিসারের বৌ হবো। তোমরা হেসে ফেললে? হাসো, এ তো তোমাদের কাছে হাসিরই কথা। গহর পাগলার পাঁচ নম্বর মেয়ে, খাল পাড়ের কুঁড়ে ঘরে যার জন্ম, সে স্বপ্ন দেখতো অফিসারের বৌ হবে- এ তো তামাশারই কথা। কিন্তু হাসি-তামাশার পর একটু মন দিয়ে ভেবে দেখো তো, এর মধ্যে আসল তামাশা কোনটা- আমার স্বপ্ন, নাকি এই বাস্তবতা?
মানুষ বদলায়। তারও আগে বদলায় তার স্বপ্ন। বড়মানুষদের বাসায় বাসায় বুয়াগিরি করে করে বড়মানুষের বৌ হওয়ার বয়স বয়ে গেল, কখন জানি আমার স্বপ্নও বদলে গেল। কারো বৌ নয়, বরং নিজে বড়মানুষ হওয়ার স্বপ্নটা মনের গভীরে চাড় দিতে থাকলো।
কিন্তু জগতে বড় হওয়ার খোয়াব দেখা যত সহজ, বড় হয়ে ওঠার পথ খুঁজে পাওয়া তো আর তত সহজ না। উপায় ভাবতে ভাবতে আমার কত রাত কত দিন খোয়াবঘোরে কেটে গেল! টাকা বানিয়ে বড়লোক হওয়া যায়। মহৎকর্ম করেও নাকি মানুষ বড়মানুষ হয় আর সেটাই নাকি সত্যিকারের বড়মানুষ। আমার বাপ বলতো, মন যার যত বড়, এ দুনিয়ায় সে তত বড়লোক। আপন অন্তর মাঝে ফকিরও বাদশা হতে পারে, বাদশাও ফকির। আমি অতসব মারেফতি কথা বুঝি না। আর আমার বাপের মতো অন্তরে বাদশা হয়ে রাজা-উজির মেরে বেড়ানো কি দস্যুবনহুর হয়ে গরীবের হিত করার বাসনাও আমার নেই। আমি আমার হিত করতে চাই সোজাসুজি উপায়ে, টাকা কামায়ে। কিন্তু গরীব-মূর্খ মেয়েমানুষের পক্ষে টাকা কামাবার পথটা কি আর কোনদিন সোজা হয়?
এমন সময় দেশে কাড়া পড়লো- সরকার নাকি গরীব-দুঃস্থ সব মেয়েমানুষেরে তরল সোনার দেশ সৌদি পাঠাচ্ছে নাম মাত্র খরচে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে পুরুষেরা বিদেশ যায়। কত জনের আবার ভিটে-বাড়ি বেচা টাকা খোয়া যায়, বিদেশভাগ্য না হয়। কত জনে ভুয়া কোম্পানীর হাত ধরে বিদেশ পৌঁছালেও শেষে জেলে পচে মরে। আবার কত জনের চাকরি হয়, টাকাও হয়। এ জগতের নিয়মই তাই- কারো ভাগ্যে সবই হয়, কারো শুধুই হায় হায়। শুনলাম মেয়েমানুষের বেলায় এসব ঝামেলা নেই। বন্দোবস্ত খুব পাকা। গৃহকর্মী মানে এখানকার কাজের বুয়াদের যে কাজ, সেখানেও তাই। তবে তারা খুব বড়লোক বলে কাজের পরিবেশ ভিন্ন, উন্নত। হাতের বদলে বেশিরভাগ কাজই হয় নাকি মেশিনে। খাটা-খাটনিও তাই কম।
আমি বিদেশ গেলাম।
কিভাবে গেলাম, কে আমার হয়ে অত সব যোগাড়যন্তর করে দিল সে আলোচনায় নাই গেলাম। বয়স আমার কিছু হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনো তো আর অত বুড়ি হয়ে যাইনি যে কেউ আমার একটা উপরোধও শুনবে না। চুপিচুপি বলে রাখি, আমি কিন্তু এখনো আগের মতই সাহেবদের গোপন আদরের আর কাজে-কর্মে খুব চালু হওয়ায় হালের গিন্নীদের পছন্দের।
সৌদি যেয়ে আমার মাথা কদিনেই নষ্ট হওয়ার যোগাড়। হায় আল্লাহ্! এরা বালির বুকে এ কী বেহেস্ত বানাইছে! দেশে থাকতেই শুনছিলাম যে এ দেশের বালির তলায় শুধু তেল আর তেল। সেই তেলে সারা দুনিয়ার গাড়ি চলে, কল-কারখানা চলে। আমেরিকার মত দেশ এ দেশের সাথে ‘দোস্তি’ করে নাকি ঐ তেলের টানে। তেলে জগৎ চলে, আর ‘মহব্বত’ টানবে না!
সৌদিতে কেমন ছিলাম, কী করতাম, কী খেতাম- সেসব আলোচনায় যাব না। দুনিয়া এখন আর একটা গ্রাম না, ছোট্ট এক পাড়া। এখন একদেশের খবর আরেক দেশে পৌঁছানো চোক্ষের পলক ফেলার চেয়েও সহজ। নিজ জিলার বাইরে যে কোনদিন পাও রাখেনি সেও ‘রসুলের পুণ্যভূমি’র সব খবর রাখে। খালি আল্লাহ্র ঘরই না, সুলতান থে শুরু করে সাধারণ কোন শেখের হেরেমে উঁকি দিয়ে বিবির সংখ্যা গুনতে চাইলে তাও তারা অনায়াসে পারে। আর বিদেশে গৃহকর্মীর চাকরির হাল নিয়ে বলারই বা কী আছে? কী নিজদেশ, কী ভিনদেশ- আমাদের হাল সবখানেতেই এক। সব জায়গার কর্তারাই আমাদের কাজের সাথে ‘কাম’ডা ‘ফ্রি ওভারটাইম সার্ভিস’ হিসেবে চায়। আর জগতের সব গিন্নীই আমাদের সম্পর্কে মনে করে, যতক্ষণ এই বদগুলানের দেহে আছে জান, ততক্ষণই হাড়ে হাড়ে ইবলিশ শয়তান। কাজেই আমাদেরকে দিয়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম না করালে আমাদের শয়তানি সব হাড় ফুঁড়ে বেরুতে শুরু করতে পারে। গিন্নীরা তাই ওভারটাইম না, ফুলটাইম নীতিতে বিশ^াসী। অবশ্যি আমাদের ওভারটাইম নিয়ে কোন কথা এদেশের কোন কাগুজে নীতিতে আছে কি না তা আমার জানা নেই। এই সুন্দর ইংরেজি কথাটা আমাদের বেলায় ঠিক খাটে না, কী বলেন? যেমন আমরা শুদ্ধ ভাষায় কথা বললে তা নিয়েও আপনাদের ভ্রুকুটি- যেন জগতের সব সৌন্দর্যের ইজারা আপনারাই নিয়ে বসে আছেন। তাই সাহেবলোকদের যেমন খুশি দরকারে দিন-রাতের যেকোন সময়ই তো আমাদের ‘পিক আওয়ার’। কাজেই সৌদিবিত্তান্ত বাদ দিয়ে আমি বরং সরাসরি দেশে ফেরার পরের অবস্থায় চলে যাই।
এক দুপুরে বাংলাদেশ বিমানের এক ফ্লাইটে করে দেশে ফিরে আসলাম- অনিচ্ছায় নয়, স্বেচ্ছায়। এমন না যে আমার কাজ বা ‘কাম’ করার সামর্থ্য কমে গেছিল বা আমি মেয়াদের আগেই অনেক টাকার মালিক বনে গেছিলাম। আবার এমনও নয় যে আমার ‘বড়লোক’ হওয়ার সাধ মিটে গেছিল। আমি দেশে ফিরে আসলাম কারণ ওখানে থেকেই আমি আমার রক্ত জল করা টাকার পরিণতি জানতে পারছিলাম।
হায়! পরবাসীর টাকা! তাতে মেয়েমানুষ!
দ্যাশের ভাইয়েরা ভাবেন, ভাই বড়লোকগো দ্যাশে গিয়া অঢেল কামায়া বড়লোক হয়া গ্যাছে। তাই তার টাকায় আমগো হক্ক আছে। আর বোন বিদ্যাশ গেলে ভায়েরা ভাবে,.....কী ভাবে, শোনেন আমার ঐ ভাইয়ের মুখে।
কোনমতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখি এক বিধ্বস্ত চেহারার যুবক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। উপস্থিত জনতা আমারই মতো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে কয়েক ডজন চোখের সামনে সে যেন আরো সঙ্কুচিত হয়ে গেল। কিন্তু সে মাত্র কয়েক মুহূর্ত। হঠাৎই সে মাথাটা খাড়া করে ঘাড় তেরছা করে বাঁকিয়ে কুটিল চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে জনতার উদ্দেশ্যে বললো, দ্যাশ ছাইড়ে যারা টাহার নিশায় বিদ্যাশ যায় তারা জাত খানকি.....। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুদূরিকা তার ভাইয়ের মুখে কিছু একটা চালিয়ে দিল। তার মুখের বাক্য অসমাপ্ত থাকল, উপড়ে গেল দুটো দাঁত,বাকিগুলোর অবস্থাও বোধহয় হয়ে গেল চিরকালের তরে নড়বড়ে। রক্তমাখা মুখে হাত দিয়ে যুবক মাটিতে উবু হয়ে পড়ে থাকলো। বিহ্বল জনতার কিছু অংশ জয়োধ্বনি দিল।
সুদূরিকা, সুদূরিকা......আমি বিড়বিড় করে বলতে থাকলাম। আশ্চর্য! যেন কত দিনের চেনা এমন ভঙ্গিতে সুদূরিকা আমার দিকে চেয়ে হাসলো। তারপর অপার কৌতুকে বড় বড় দুচোখ নাচিয়ে ভ্রুভঙ্গি করে গাইতে শুরু করলো,
বাবুরাম সাপুড়ে
কোথা যাস বাপুরে
আয় বাবা দেখে যা
একটুখানি খে এ এ লে যা......
এ কি সেই লাস্যময় মধুর কণ্ঠ যা শুনে নাতাশা বেবির শিক্ষক আনমনা হয়ে যেতেন? না জানি আরো কতো যুবক.....এবং একদিন কি আমিও.....? চলচ্চিত্রে ‘খেয়াল’ দেখার মতো করে হঠাৎ আমি দেখতে থাকলাম যেন আমার আর সুদূরিকার প্রেমের পুরা অধ্যায়। আহা! কী প্রগাঢ় ‘প্রেমে’ আমি তার চরণ ধরে তার মদ্যপ, গেঁজেল, জুয়াড়ী তৃতীয় স্বামীকে তালাক দিতে উষ্কানী দিচ্ছি! এবং একদিন সুদূরিকা আমাতে মজলো। সরল বিশ^াসে আমার হাত ধরে পালালো। এবং আমি তাকে নিয়ে বিশেষ পল্লীর মাসীর জিম্মায় হাওলা করে দিলাম। তারপর কবে সুদূরিকা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল? নাকি পারেনি কোনদিন? ওখানে একবার যে যায় সে কি আর বেরিয়ে আসতে পারে? আর সুদূরিকাদের জন্য গোটা পৃথিবীই কি ঐ ‘বিশেষ পল্লী’ নয়?
দূর হোক গে! কে আমি আর কে সুদূরিকা তা কে জানে! আপাততঃ সকল কষ্ট ভুলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সুদূরিকার গান শুনতে থাকি।
0 Comments