অদৃশ্য নির্মম হাত আর তার টান খাওয়া মানুষ
জাল
দেশ ভাগ হয়েছে। মানুষ ভাগ হচ্ছে। বুরহানরাও ভাগ হলো। চলে আসতে হবে পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে, বর্তমানের বাংলাদেশে। সোনামসজিদ সীমান্ত গেট খুব চঞ্চল মানুষকে গিলে নিতে আর উগরে দিতে। বুরহানদেরও গেটটা গিলে ফেলল ওপারের দিকে আর উগরে দিল এপারে। এপার কিছু মানুষ উগরে দিচ্ছে ওপারে, ওপার কিছু মানুষ উগরে দিচ্ছে এপারে। কিছু গিলছে এপার। কিছু গিলছে ওপার। কারণ মানুষ, মানুষ নয়। কারণ মানুষ মুসলমান। মানুষ হিন্দু। হিন্দু চলে যাচ্ছে। মুসলিম চলে আসছে। তাদের জীবন সম্পর্কে তারা নিজেরাই জানে না। কোনো স্বপ্ন নাই, আশা নাই। কি হবে সে ব্যাপারেও চিন্তা করে কোনো কুল পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। এরই মধ্যে মুসলমান দেশে চলে আসছে বুরহান বাবার সংগে, সংগে মা। ছোট বোনটা মায়ের কোলে। বুরহান একবার বাবার কোলে একবার নিজে হাঁটছে, তার বয়স কতই বা হবে তখন পাঁচ বা ছয়। ভালোই ভালোই পার হবার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জে আসা গেল। তারপর ট্রেন ধরে চলে যেতে হবে সিরাজগঞ্জ। বুরহান তার বাবার হাত ছেড়ে দিয়েছে স্টেশনের আগে হাটের কাছে। সেদিন হাটবার। বুরহানের বাবাও বুঝতে পারেনি। ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে। বুরহান একা একা হাটে ঘুরে বাবাকে খুঁজে পেল না।
কান্না দেখে তাকে নিয়ে গেল ডালিমভাঙ্গা গ্রামের মরভান। মরভান হাট থেকে দূরে একটা গ্রামে একটা ছোট ঘরে থাকে। ইহজগতে তার কেহ নাই। হাটের দিন তরকারি, চাল চেয়ে আনে। একহাট থেকে আর একহাট চলে যায় চেয়ে আনা চালে ডালে। সপ্তাহে দু’দিন হাট। কয়েক দিন বাবা মা আর ছোট বোন মাসুমার নাম ধরে কেঁদেছে মরভানের গলা ধরে। গ্রামের লোকজন ভীড় করে দেখতে এসেছে কিন্তু কী করা উচিত কেউ বুঝতে পারে না। তাকে নিয়ে সিরাজগঞ্জ যাবে এমন কাউকে পাওয়া গেল না। তবে কেউ কেউ কিছু কিছু বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করল। এসকল বুদ্ধির মধ্যে একটা বুদ্ধি ছিল - বুরহানকে স্টেশনে নিয়ে গিয়ে একে ওকে দেখানো, যদি কোনো সিরাজগঞ্জের লোক পাওয়া যায়, যে বুরহানকে বা তার বাবা-মাকে চিনতে পারবে। রেল স্টেশনে কয়েকদিন একে ওকে দেখিয়েও কোনো কিছু হলো না। মরভান তাকে সান্ত¦না দেয় - ‘চুপ ভাই, একটু সবুর কর। কিছু টাকা জমা হলে হামি তোকে থুয়ে আসব।’ টাকা আর জমে না, অনেক দুঃখ জমে গেল, অনেক সবুর জমে গেল বুরহানের বুকে। কিছুদিনের মধ্যে বুরহানের কান্না থেমে আসে। সে বিভিন্ন আবদার করতে শিখে গেল মরভানের কাছে। মরভানের বুকে মুখ গুঁজে রাতে শুয়ে থাকে, গল্প শোনে রূপকথার, কখনো বুড়ি তার বিগত জীবনের গল্প বলে। চুপ হয়ে শুনে বুরহান। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। বুরহান ঘুমিয়ে গেলেও সে তার গল্প বলতে থাকে। সেও ঘুমিয়ে যায় কিন্তু তার গল্প চলতেই থাকে, বলতেই থাকে। গভীর ঘুমের ভেতর তার গভীর জেগে থাকা শেষ হয় না। সে বলতেই থাকে তার যৌবনের কথা, লাল পেড়ে শাড়ির কথা, স্বামীর কথা, জাতিদাঙ্গার সময় স্বামী খুন হবার কথা। ঘুমের ভেতর জেগে থাকার ভেতর বুরহান বড় হতে থাকে, মরভানের চামড়া আরো ঢিলা হতে থাকে।
মৃতের দিকে তাকিয়ে থাকা
মানুষজন ভীড় করে দেখছে বুরহানকে। মরভান পাথর। প্রচ- পেট ব্যথা ছিল বুরহানের। কোনো কিছুতেই ভাল হচ্ছিল না। কবিরাজি, ওঝার ঝাড়ফুঁক কোনো কাজেই আসেনি। মরভান বুড়ি তার বিয়ে দিতে চেয়েছিল সুন্দর দেখে। বুরহানের ছোট বয়সেই তার বিয়ে নিসয়ে ঠাট্টা মস্করা করত। বিয়ে কী তাই বুঝতো না বুরহান। জিজ্ঞেস করত - ‘নানি কবে? কবে রে নানি বিয়ে?’ মরভান বুড়ি হাসতে হাসতে বলত - ‘হবে রে হবে। এত তাড়া কেন?’ হাটে চাইতে গিয়ে আর একটা চাওয়ানির সাথে পরিচয় হয়েছিল মরভানের। ঐ চাওয়ানির নাম সহবান। সহবানের বিয়ে হয়েছিল এক বিদেশির সাথে। কিছুদিন ঘর সংসার করার পর সেই বিদেশি উধাও হয়ে গেছে। সহবান আর ঐ বিদেশির কিছুদিনের সহবাসের ফল - মেয়ে মুকতারা। বুরহান আসার আগেই পরিচয় হয়েছিল সহবানের সাথে। বুড়ি মুকতারা আর বুরহানের বিয়ের কথা বলত সহবানকে। মুকতারার বয়স তখন দেড় দু’বছরের বেশি নয়। সহবান হেসে বলেছিল - ‘আগে বড় হোক তো ওরা।’ জাতিগত দাঙ্গায় স্বামী মারা যাবার পর ব্যথা আর বেদনা ছাড়া আর কিছু ছিল না মরভান বুড়ির। বুরহানকে পাবার পর তার সময়গুলো একটু হাল্কা হয়েছিল। বুরহানের জন্যও তার খারাপ লাগত, ছেলেটার এভাবে এক ভিখারির ঘরে মানুষ হতে হচ্ছে ভেবে। তাই সে বলত - ‘বুরহান, তোর বিয়ে দেব, তারপর বউ নিয়ে সোজা চলে যাবি সিরাজগঞ্জ, বাবা মাকে খুঁজে বের করবি।’ এগুলো বলার পর চোখ মুছে ঝাড়– দেয়া শুরু করত বা রান্নার কাজ। ঝাড়– দেবার ভেতর দিয়ে, রান্নার কাজের ভেতর দিয়ে মরভানের চামড়া আরো ঢিলে হতে থাকত।
মৃতের তাকিয়ে থাকা
স্টেশনের কিছুদূর আগেই হাটের কাছে এসে বাবার হাত থেকে নিজের হাত বিচ্ছিন্ন করে একা একা বুরহান হাঁটতে থাকে। এরপর কোনো একটা হাত যেন তাকে ধরে টান দেয়। সে হাটের মানুষের ভীড়ে ঢুকে পড়ে। কে যে তার হাত ধরে টান দিয়েছিল তা বহুদিন চিন্তা করেও বের করতে পারেনি। তার শুধু অষ্পস্ট একটা হাতের কথা মনে পড়ে। এ হাত কোনো মানুষের, কী কিসের তা বুঝতে পারেনি। সেই একটা টানের পর তখন বা এখন পর্যন্ত সে হাতের হদিস পায়নি সে। শুধু বিচ্ছিন্নভাবে মনে পড়ে হাতটার রং হলুদ, কখনো মনে হয় সবুজ সে হাত, কখনো লাল বা কালো মনে হয়। অদৃশ্য হাতের টানের পর বহুক্ষণ তার বাবাকে সে ভুলে গেছিল। বাবার কথা স্মরণ হয় এক সময়। বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে হাটের আর এক প্রান্তে এসেও দেখতে পাইনি। বুরহানের বুক উথাল পাথাল করা কান্না আসে। তার কান্না সবাই দেখেছে তার দিকে তাকিয়ে বা ভীড় করে দাঁড়িয়ে কিন্তু কেউ তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। একসময় কাঁদতে কাঁদতে হাট ভাঙে, মানুষ কমতে শুরু করে। তার প্রতি মায়া করে নিয়ে আসে মরভান বুড়ি যাকে সে নানি বলে ডাকে। ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু ভেতর থেকে কী একটা ব্যথা চাগা দিয়ে উঠত, বাবা মায়ের অস্পষ্ট ছবি ভেসে উঠত ভেতরে। এসব মনে পড়ার সময় তার খুব ইচ্ছে করত সিরাজগঞ্জ যেতে, বাবা মাকে খুঁজে বের করতে। তার বুক উছলে কান্না বের হত একেবারে ফেড়ে ফুঁড়ে। কখনো কিসের উপর, কার উপর যেন তার খুব অভিমান হত। এই একা একা অভিমানি হবার সময়ও তার কান্না ছিল। মনে হত, থাক সে আর কখনোই বাবা-মা’র কাছে যাবে না। ভেতর ভেতর সে দারুণ অসুখি। দারুণ অভাবী। তার খারাপ লাগত বুড়ি মরভানের জন্যেও। বুড়ি নানি তার জন্য কত কষ্টই না করে অথচ সে তার জন্য কিছুই করতে পারে না। কিছুতো করতে পারেই না বরং কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে কষ্ট দিচ্ছে। আবার তার মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আবার যদি সেদিনের মত একটা হাত তাকে টেনে নিত বড় ভাল হত। কখনো কখনো তার সে হাতটাকে হাটের হাত বলে মনে হয়। এরপর সে বারবার সে ঐ হাটে গেছে হাটের হাত দেখতে, হাটের হাত দেখতে পেলে সে নিজে থেকেই ঐ হাতে ধরা দেবে ভেবে। কিন্তু সে হাত আর দেখতে পায়নি সে, সে হাত তাকে টেনে নেয়নি। মুকতারা কিছুটা আনন্দের মত কোনো কোনো সময়। মাঝে মাঝে সে তার মায়ের সাথে আসে তাদের বাড়িতে। বুরহান তাকে নিজে এতটুকু থেকে বড় হতে দেখেছে। মুকতারা যখন ছোটো সময়ে আসত তখন তার নানি যদি বলত -
‘ঐ যে তোর বর যা গিয়ে জড়িয়ে ধরগে।’ সঙ্গে সঙ্গে সে এসে জড়িয়ে ধরত -
‘আমার বল্’ বলে। তার জড়িয়ে ধরা দেখে হাসত, বরকে ‘বল্’ বলা শুনে হাসত মরভান বুড়ি। তারপর আরো কিছু সময় পার হলে মুকতারা বুঝে ওঠে সবকিছু। আর সে জড়িয়ে ধরে না। তারপরেও সে এসে দাঁড়ালে, মিচকে শয়তাননির মত মুখ লুকিয়ে হেসে উঠলে, বুকের ভেতর দারুণ সুখ, দারুণ ব্যথা জাগত। মসজিদের হুজুরের কথা মনে পড়ে বুরহানের। হুজুর একদিন খুতবাতে বলছিল -
‘নারীকে পুরুষের পাঁজর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যার পাঁজর থেকে যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তার সাথে তার বিয়ে হবে।’ বুরহান খুব মনোযোগ দিয়ে, আঙুল দিয়ে বুক টিপে দেখেছে তার বাম পাঁজরের হাড় ডান পাঁজর থেকে কম আছে কি না। গুনে গুনে বুঝে উঠতে পারে না। গণনায় ভুল হয়। কখনো মনে হয় সমান। তবে কী তার বিয়ে হবে না। সে বার বার গুনে, আরো গুনে।
তারপর পৃথিবীর বুকে পাথরের মত ৭১ সালের আকাশ। প্রচুর মাংসখেকো পাখি। বার তেরশ মাইল পথ বেয়ে আকাশে ঘাঁই মেরে, হঠাৎ গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মত নেমে আসে, আবার উপরে উড়ে যায়। ৭১ সালের আকাশ। দিন নাই রাত নাই। মেঘ ডাকার শব্দ। যতবার মেঘ ডাকে ততবার দাঁড়ানো মানুষ শুয়ে পড়ে আর ওঠে না। এখন এত রাতে সে যে জঙ্গলে এসে দাঁড়িয়েছে, একটা জীবননক্সা নিয়ে, এই জঙ্গলেও বহু মানুষ, দাঁড়ানো মানুষ শুয়ে পড়েছে আর ওঠেনি। এসব কথা ভাবতে পারছে বুরহান। পেটের ভেতর আবার অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছে ব্যথা, এখনই প্রচ- আকার ধারণ করবে। গত পাঁচ বছর থেকে এ অবস্থা চলছে। কোনো কিছুতেই ভাল হচ্ছে না। কত চিকিৎসা হলো, কিছুতেই কিছু হয় না। মনে করতে চেষ্টা করল, কতগুলো লাত্থি মেরেছে বুট পায়ের মোচাড়– পাক সেনাটা। পেট ব্যথাটা তখন থেকেই শুরু। যদিও বোঝা যায় না পেট ব্যথাটা সেই লাত্থির কারণে না অন্য কারণে। তবে ভূতনামা কবিরাজ বলেছে -
‘ওসব কিছু নয়, ওকে ধরেছে সাপা ডাকিনীতে।’ ওঝা প্রতি রোববার করে তার দল নিয়ে এসে ভূত তাড়ানো গাওনা ধরে -
‘তোর স্বভাব ভালো লয়গে সমঝ্যার মা’
সুরের নেশায় ভেতরে নেশা ধরত, মাথা ঝুঁকত। দুএকদিন ভাল থাকত আবার যেই আকার সেই। বুরহান এদিক ওদিক একটু দেখে নিল। দেখল, এই রাত্রির সময়ে তার উপর চোখ রাখবার কেউ নেই। সে কল্পনা করতে পারল, পৃথিবীর এইসব গাছপালাসহ সব অন্যান্য পদার্থ থেকে সহস্র চোখ তাকিয়ে তাকেই দেখছে। চিন্তায় পড়ল নতুন করে -
সে আসলে তার শরীরের কোন অংশটুকু? সমগ্র শরীরই কি সে? তবে সে পেটের জন্যইতো এখন যাচ্ছে। পেটের দোষ হলো সে ব্যথা করে, প্রচ- ব্যথা করে। প্রচ- যখন ব্যথা করে তখন তার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। সেই ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে এখন। এখানে হাত বা চোখ বা পায়ের বা মাথার কী হবে সে কথা এখন ভাবছে না সে। হাত বা পা বা মাথার কোনো দোষ নেই। পেট ব্যথাটা একটু কমেছে এখন। পেটের এই ব্যথা কমাটাকে তার সাথে পেটের একধরনের ইয়ারকি বলে মনে হয়, মনে হয় পেট তার সাথে উপহাস খেলছে বা মনে হচ্ছে পেট তাকে আবার বেঁচে থাকার লোভ দিচ্ছে। এর আগেও কয়েকবার এমন হয়েছে। প্রচ- ব্যথা নিয়ে সে দড়ি নিয়ে জঙ্গলে এসেছে কিন্তু আসতে আসতেই ব্যথা থেমে গেছে। সে ব্যথা থেমে গেলে জীবনের প্রতি আবার মায়াবতা জেগেছে, ফিরে এসেছে দড়ি ফেলে। আর ব্যথা যখন উঠে তখন আত্মহত্যার কথা ছাড়া আর কোনো কথায় মনে আসে না, মনে থাকে না। এবারও তেমনই ঘটে সেজন্যই যেন পেটটা ইচ্ছে করেই ব্যথা কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে কোনো লোভ বা উপহাসে সাড়া দেবে না। নানি প্রায়ই চাঁদের বুড়ির গল্প বলত। এখনও দেখল, চাঁদের বুড়ি সুতা কাটা বাদ দিয়ে তার দিকে কটমট করে চেয়ে আছে। দূরে মহারাজপুরে ঈদ পরবর্তী মেলা বসেছে। সেখান থেকে যাত্রার সুরতিব্র গান ভেসে আসছে। রমণিয়া পৃথিবী। জোছনায় গোসল করছে পৃথিবী। সুখগ্রস্ত মানুষেরা খিল কপাট বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। আর বাইরে, বুরহানের এখানে অমানবিক নিস্তব্ধতা, দীর্ঘতম নিস্তব্ধতা। চাঁদটা ডুবে গেল। শীতার্ত অন্ধকার সবদিকে। বুরহানকে আর দেখা যাচ্ছে না এখন। শুধু ছোট জঙ্গলটার ভেতর থেকে নিস্তব্ধতার শরীর ব্লেডের মত কেটে দিচ্ছে একটা অদ্ভূত শব্দ, দড়ি ঘষার শব্দ। ডাল-দড়ি-গলার ঘষাঘষির ভোঁতা শব্দ। ভীড় জমিয়ে গাছগুলো সারারাত কী যেন দেখল।
সকালে গ্রামের মানুষেরা ভীড় বেঁধে জঙ্গল ভেঙ্গে বুরহানকে দেখছে। তার প্রচ- পেট ব্যথা ছিল। মরভান বুড়ি কাঁদছে না। মুকতারা কাঁদছে। পাথরের মত কাতর মরভান বুড়ি মুকতারার দিকে শুন্য চোখে তাকায়, তার দিকে শিথিল পায়ে এগিয়ে আসে। মুকতারার কান্নার বেগ বাড়ে। মরভান বুড়ি মমতার হাত দিয়ে মুকতারার হাত ধরে টানে। মুকতারা মরভানের হাতের দিকে তাকাল, যে হাত তার হাত ধরে আছে সে হাতের দিকে। সে মরভানের হাতকে একবার নীল দেখল, একবার হলুদ দেখল, একবার লাল দেখল। সে দেখল, মরভানের হাতের রং একেকবার একেক রকম হচ্ছে। মৃত মানুষ বুরহান -
তার লাশ দেখতে আসা সকল মানুষের দিকে সমানভাবে তাকিয়ে রয়েছে।
পরিধা আর পাগল
১.
মঈন আমাদের গল্পের ভেতর প্রবেশ করবে এখন। আপনারা চোখমুখমন খোলা রাখুন। হ্যাঁ, মঈন আমাদের গল্পের ভেতর প্রবেশ করল।
মঈন বসে আছে তার আটত্রিশ বছরকে কোলে নিয়ে এবং সে বসে আছে তিনবছর ধরে। যারা একটু বেশি লাজুক তারা এবার চোখ বন্ধ করুন। কারণ, এক্ষুণি এই গল্পের ভেতর প্রবেশ করবে তার শিশ্ন। তার স্বাভাবিক আকৃতির শিশ্ন। সে তিন বছর থেকে এই ছোট শহরের বড় রাস্তাটার মাঝারি মাপের একটা ফুটপাতের চায়ের দোকানের পাশে বসে আছে। তার বয়স তিন বছর আগে আটত্রিশ ছিল। এখনো তার বয়স আটত্রিশ। তার বসে থাকার বয়স বাড়ছে। তার বয়স বাড়ছে না। এখন তার বসে থাকার বয়সের পরিমান তিন। আমিও চোখ বন্ধ করলাম কারণ আমিও বেশ লাজুক এবং এখন তার শিশ্ন বেরিয়ে আসবে গল্পের শরীরে। তার শিশ্ন বেরিয়ে থাকার বয়সও প্রায় তিন বছর। এ গল্প এখন বলা হতে শুরু হচ্ছে মাত্র এমন নয়। এ গল্পের বয়স তিনশ বছর, তিনহাজার বছর, তিন লাখ বছর, মানুষবছর।
২.
তার বসে থাকার বয়সটা আরো বেশি হতে পারত। হতে পারত চার বা সাড়ে চার। কিন্তু তা হয়নি। এক্ষেত্রে সে ধৈর্যেরই পরিচয় দিয়েছে বলা যায়। কিন্তু তার ধৈর্যের বয়স একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে যখন তরুণ হয়ে গেল, তখন মঈনের ধৈর্য্য মঈনকেই আর আমলে নিল না। তার ধৈয্য মঈনের দেয়া দেয়ার ভেঙ্গে বলেই ফেলল -
‘দেখ পরিধা, শিশ্ন আর যোনির অত্যাচারে, শিশ্ন আর যোনির তাড়া খেয়ে প্রেম পালিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী ছেড়ে।’ তার বসে থাকার বয়স এখন তিন হলে তার মুখ দিয়ে বের হওয়া এই কথার বয়স তার চেয়ে কয়েকমাসের বেশি অবশ্য, একথার সত্যতার বয়স মঈনের বয়সের চেয়েও বেশি। কথাটি শুনে পরিধা বিস্ময়ে তার দিকে তাকায় আর ঘরে থাকা আয়নাতে তার নিজের চেহারা দেখে বোঝার চেষ্টা করে, তার নিজের মুখের উপর একথা লেখা আছে কিনা। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আতশি কাঁচে দেখার মত করে দেখে। না দেখতে পেয়ে, সে অন্য ঘরে গিয়ে আতশি কাঁচ দিয়ে তার ঠোঁটে, গালে, বুকে, যোনিতে কোথাও একথা লেখা আছে কিনা তাও ভাল করে দেখে। এরকম কোনো লেখা সে দেখতে পায় না তার শরীরের কোথাও। অন্য ঘর থেকে ফিরে এসে বলে -
‘তুমি একথা বলছ কেন? আমিতো একথা শোনার কোনো কারণ দেখি না।’ মঈন আর কিছু বলে না। গাছেরা সবসময় চুপ করে থাকে। কখনো কখনো কোনো কোনো মানুষ গাছের মত হবার চেষ্টা করে। মঈনও জানালার বাইরে থেকে চোখ দিয়ে টেনে নেয় একটা গাছের গা থেকে সামান্য ‘চুপ করে থাকা’। আর গাছ থেকে নেওয়া চুপটুকু মুখে পরে নেয়। সুতরাং সে চুপ করে থাকে। পরিধা যখন দেখল, গাছের গা থেকে ‘চুপ করে থাকা’ নিয়ে মঈন নিজের মুখে মাস্কের মত করে পরে নিয়েছে তখন পরিধা তার কথাকে এসিডে পরিণত করে তার চুপমাস্কের উপর নিক্ষেপ করে -
‘চুপ করে আছ কেন, বল, কেন এমন বলছ?’
মঈনের চুপমাস্ক গলে গেলে সে মুখ খুলে -
‘পরিধা, আমরা কি প্রেম করে বিয়ে করিনি?’
পরিধার মুখ ফ্যাকাসে হয় মুহূর্তেই, কিন্তু মুহূর্তের জন্য। সে নিজেকে সামলে নেয় আর বলে -
‘তোমাকে এভাবেই থাকতে হবে’। কিন্তু এভাবে না থেকে মঈন মাঝে মাঝেই তাকে বলে ফেলে -
‘শিশ্ন আর যোনির অত্যাচারে, শিশ্ন আর যোনির তাড়া খেয়ে প্রেম পালিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী ছেড়ে’। আর কখনো কখনো বলে -
‘আমরা কি প্রেম করে বিয়ে করিনি?’
৩.
পরিধাও ধৈর্য্য ধারণ করেই ছিল। এই কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হতে হতে সে প্রায় ছমাস পার করে দেয়। এ ছয়মাসেই তার ধৈর্য একটু একটু করে বড় হতে হতে ডাঁশা হয়। ডাঁশা থেকে পেকেও যায়। পেকে যাবার পর যদি পচে যেত তবে একটা ব্যাপার ঘটত কিন্তু সেটা না পচে ফেটে গেল এবং যখন মঈন বাড়িতেই থাকে তখন একদিন বাসেদ এল। সে মঈন বাসাতে থাকা অবস্থায় খুবই কম আসে বা আসে না। এলেও মঈনের সাথেই কিছুক্ষণ বসে থাকে, চা খায় আর চলে যায়। তার ভাবটা এমন থাকে, যেন মনে হয় পরিধাকে সে ভাল করে চেনেই না, তার সাথে সে কখনো তেমনভাবে কথাই বলে না। কিন্তু এবার সে এল এবং প্রথমেই পরিধার ঘরে গেল। তারা কিছুক্ষণ কথা বলল। কথা বলা হলে, তারা দুজনেই এসে মঈনকে মারতে শুরু করে আর বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মঈনকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে তারা বেডরুমে ঢুকে প্রতিদিনের মত। কিন্তু পার্থক্য হলো এখন ঘড়িতে, সূর্যে যতটা বাজছে ততটার সময় কোনোদিন বেডরুমে যায়নি। এ সময়টাতে মঈন বাসাতেই থাকে।
৪.
যেহেতু মিথ্যে মামলা দিলেও নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে নারীর জেতার সম্ভাবনা বেশি থাকে সেহেতু জিতে যায় পরিধা। জ্ঞানীরা চক্ষু বাড়াতে বলেন। আনারসের গায়ে প্রচুর চোখ আছে, তবে আনারস একটা জ্ঞানী ফল এবং প্রাণীদের মধ্যে মাছি জাতীয় পতঙ্গ।
মঈনের বাবা-মা তাদের জীবন খাটা শেষ করে মঈনকে জীবন খাটতে দিয়ে চলে গেছিল, মঈনের বয়স যখন পঁচিশ হবার জন্য বায়না ধরেছিল। এরপর, পরিধার সাথে তার পরিচয় হলে পরিধা তাকে প্রেমের কথা বলে। মঈন প্রথম দিকে ‘সে অনেক ধনি বা ধনির মেয়ে’ বলে পরিধার প্রেমপ্রস্তাবনাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পাশটা সম্ভবত খুব কঠিন ছিল। সে পাশটাকে কাটতে পারেনি। পরিধার সাথে বিয়ে হবার পর পরিধা তাকে বলেছিল -
‘তুমি তোমাদের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে আমাদের এখানেই থাক।’ এ সিদ্ধান্ত নিতে মঈন দুবছর পার করে দেয়। কিন্তু পরিধার মা বাবাও যখন মারা গেল তখন আর পরিধার জোরের কাছে না করতে পারেনি। সে বাড়িটা বিক্রি করে টাকাগুলো ব্যাংকে রেখে পরিধাদের বেশ বড় বাড়িটিতে এসে উঠে। এরপর, আরও তিনবছর পার হলে বাসেদ কারেন্ট মিস্ত্রিরূপ অবতার হয়ে চলে আসে। সে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে মঈন আর পরিধার মাঝখানে।
মঈনকে তাড়িয়ে দেবার পর। নিজেই মামলা করার পর, মামলাতে জেতার পর, মামলাতে ডিভোর্স নেবার পর, মঈনের বাড়ি বিক্রির সব টাকা পরিধা নিয়ে নেয়। আর মামলাতে হারার পর, সব টাকা হারার পর, চাকুরি হারার পর, বেশ কয়েকমাস জেল খাটার পর মঈন এখানে বসে আছে তিনবছর ধরে। রাস্তার অপরপারে পরিধা থাকে। বাসেদ প্রতিদিন আসে প্রতিদিন চলে যায়। কোনো কোনোদিন রাতে থাকে।
৫
হঠাৎ একদিন পরিধা, এই তিনবছর থেকে তাদের বাড়ির সামনে বসে থাকা মঈনের পায়ের কাছে এসে পড়ে পরিধা। সে রক্তাত্ব। সে বলে -
‘তুমি পাগল হওনি আমি জানি। আমাকে বাঁচাও, বাসেদ আমাকে মেরে ফেলবে।’ মঈন বলল -
‘বাঁচালাম যাও, ও কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তার মাঝখানে মুখ থুবড়ে মরে পড়ে থাকবে।’ এটুকু বলার পর সে মুখ তুলে পরিধার দিকে তাকায় আর মৃত্যুমাখা একটু হাসি দিয়ে দেয়ালে পুরো হেলান দিয়ে শুয়ে গেল।
মানুষজন দাঁড়িয়ে দেখতে পেল, একটা অভিজাত সুন্দরী নারী একটা পাগলের মরামাখা শরীর জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে। তার পোশাকে অজ¯্র কাগজ। মঈনের পোশাকের ভেতর থেকে কাগজ বের করে পরিধা ছুঁড়ে ফেতে লাগল। মানুষজন কুড়িয়ে পড়ে দেখে, সব কাগজে ঐ একই কথা লেখা -
‘ শিশ্ন আর যোনির তাড়া খেয়ে, শিশ্ন আর যোনির অত্যাচারে, প্রেম পালিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী ছেড়ে’।
মরা মঈনকে জড়িয়ে ধরে জীবিত পরিধার কান্না যারা দেখছিল, তারা হঠাৎ করে কিছুটা দূরে চেঁচামেচি শুনতে পায়। একজন লোক, কারেন্ট মিস্ত্রিটা ট্রাক চাপা পড়েছে বলে সেদিকেই ছুটতে শুরু করল। তার সাথে সাথে অন্যেরাও ছুটতে লাগল ট্রাক এক্সিডেন্টের দিকে। পরিধা হঠাৎ সচকিত হয়ে লোকজনের ছুটে যাবার দিকে দেখে আবার পাগলা মঈনের মরা শরীরে পড়ে কাঁদতে শুরু করল।
1 Comments
সুন্দর গল্প।
ReplyDelete