রাজু আহমেদ মামুন এর গদ্য


কবিতার ভবিষ্য এবং ভবিষ্যতের কবিতা


(লিটল ম্যাগাজিনযদিও উত্তর মেঘথেকেকবিতার ভবিষ্য এবং ভবিষ্যতের কবিতাশিরোনামে লেখা চেয়েছিলো, প্রকাশিত হয়েছে, এটি সেই লেখা।)

প্রয়োজনএক মহা শর্ত-মানুষের জগতে, মানুষের সংস্কৃতিতে টিকে থাকার। এক প্রাকৃতিক নিয়মও বটে। মানুষ এমন যে প্রতিদিন তার শরীর থেকে প্রায় আড়াই হাজারের মত কোষ অচেতনভাবেই ফেলে দেয়। অবশ্য এটা না ফেললে একজন মানুষ হয়ত এক জীবনে একটি পাহাড়ের সমান হয়ে যেত। সেদিক থেকে শিল্প বিচারে কবিতা যদি মানুষের সভ্যতায় ব্যক্তির যাপনের মধ্যে তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে তবে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কেননা মানুষ কিছুই বয়ে বেড়ায় না, যদি না তার প্রয়োজন থাকে
সম্ভবত কবিতা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো শিল্প। হয়ত মানুষের ভাষার সমান তার বয়স। সেই প্রাচীনকালে কবিতা ছিল মানুষের সর্বজ্ঞানের ধারক, অথবা কবিতার মধ্যে থাকত মানুষের সব রকম ভাবনা অভিজ্ঞতার আকরিক। যখন লেখ্য ভাষার বিস্তার হয়নি, মানুষ তার অর্জিত ভাবনা অভিজ্ঞতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিত মুখস্ত ভাষ্যে বা স্মৃতিস্থ করে। আর সে প্রয়োজনেই ভাষার এক ছান্দোস রূপ সৃষ্টি করতে হয়েছিল। যাতে মুখস্ত করতে বা মনে রাখতে সহজ হয়। কারণেই আমরা প্রাচীন কবিতায় যেমন দেখতে পাই জীবন-যাপনের নানাবিধ অভিজ্ঞতার বিপুল উপস্থিতি তেমনি মেলে নানা রকম জগ ভাবনা, জীবন ভাবনা, সমাজ ভাবনা এক কথায় প্রাচীন দর্শন-বিজ্ঞান-ইতিহাস-নীতিবিদ্যা-সামাজিক আইন জীবন-যাপনের নির্দেশনাগুলো কবিতাকারে মানুষ মুখস্ত করত এবং মান্য করত ধর্মীয় বাণী হিসেবে। কাজেই তখন কবিতা ছিল এক মহাপ্রয়োজনীয় ধারকের নাম। আর কবি ছিলেন পরম পূজনীয় ঋষি
প্রাচীন পৃথিবীতে কবিরা যেমনি কবিতা দিয়ে ধর্মগ্রন্থের জন্ম দিতেন তেমনি সাধারণ মানুষের বিনোদনের জন্য সৃষ্টি করতেন কাব্যিক উপকথা, গাঁথা, কাব্যিক নাটক, কাব্যিক উপন্যাস এমনকি সৃষ্টি করতেন কাব্যিক মহোপন্যাস বা মহাকাব্য। স্বাভাবিকভাবেই এমন প্রভাবশালী বিনোদনদায়ক শিল্প সৃষ্টির ক্ষমতাকে মানুষ বিশেষ গুণ হিসেবে মূল্যায়ণ করত এবং কবিদেরকে সর্বদা সাধারণের চেয়ে ক্ষমতা সম্পন্ন মহামানব হিসেবে পূজা করত। কিন্তু লেখ্য ভাষার বিস্তারের ফলে জ্ঞানের শাখা বৃদ্ধি পেল। সামাজিক বিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো আলাদা হয়ে গেল যার যার আপন ঠিকানায়। ইতিহাসও আর থাকল না ছান্দোস গপ্পের মধ্যে। এমনকি মিথওমিথলজিনামে এক নতুন গবেষণার বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হল। এবার আসা যাক, শিল্পের জগতে। সেখানে নাটক তার নিজস্ব ভাষায় আপন রূপ পরিগ্রহণ করল। গদ্যে সৃষ্টি হতে লাগল গল্প, উপন্যাস এবং মহোপন্যাস। এক কথায় গদ্য ভাষা গ্রাস করল প্রায় সবকিছু। কবিতার সাথে রইল গানের কথা। কিন্তু সে গানের কথাও প্রায়শই কবিতার সাথে থাকে না। সেও মাঝে মাঝে গদ্যের চালে চলে। আর গানের কথাই বা কেন বলছি, খোদ কবিতার ছান্দোস রূপের মধ্যেই তো ততদিনে ঢুকে গেছে গদ্যের প্রলয়। গত শতাব্দিতে গদ্যের সেই প্রলয়াংকারী ঝড় দুনিয়ার প্রায় সব ভাষার কবিতাকেই এতটাই বদলে দিয়েছে যে তার চিরায়ত চেহারার সাথে বর্তমান চেহারা মেলাতে গেলে কিছুটা ভিন্ন প্রজাতির মনে হতে পারে।
এবার আসা যাক এই বদলে যাওয়া প্রেক্ষিতে কবিতার খোঁজে ২০০২/২০০৩ সালের কথা, একটা লিটলম্যাগের প্রয়োজনে কবিতা কী, কবিতা কাকে বলে সেই প্রশ্ন নিয়ে ছুটলাম বঙ্গ বিশ্বের বাঘা বাঘা কাব্যাজ্ঞদের কাছে। উত্তর চাই, রেফারেন্স নয়, আপনি কী বুঝেন। এর মধ্যে পবিত্র সরকার থেকে সৈয়দ শামসুল হক পর্যন্ত অনেকেই ছিলেন। পবিত্র সরকার তো লেজে-গোবরে এক বিস্তর উত্তর দিয়ে শেষমেষ বলেছিলেন কবিতা যে আসলে কী তা ব্যাখ্যা করে বোঝানো অসম্ভব। অন্যদিকে সৈয়দ হক সোজাসুজিই বলে বসলেন- আম গাছকে যদি প্রশ্ন করা হয় আম কী? সে যেমন উত্তর দিতে পারবে না তেমনি আমিও কবিতা কী এর উত্তর দিতে পারব না। যদিও এটা ছিল তার মহাপুরুষসুলভ গোঁজামিল। অবশ্য বিষয়ে সেই প্রাচীন কাল থেকে এই সেদিনকার জীবনানন্দ দাশ পর্যন্ত অনেকেই ভেবেছেন। হাল আমলের লোকেরাও ভাবছেন। যে শিল্প তার চরিত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এমন অস্পষ্ট ধোঁয়াশে তার ভবিষ্য স্পষ্ট বোঝা তো আরও দুরূহের কাজ। এই রহস্যময়তা বা গোঁজামিলকে সমর্থন করে এই সেদিনও জীবন বাবু বলেছিলেন-কবিতার সৃষ্টি হবে এক সান্ধ্য প্রেক্ষিতে, আলো-আঁধারির মাঝে, বোঝা-না বোঝার রহস্যময়তায়। যাহোক এই রহস্যময়তা সৃষ্টি করতে গিয়ে অনেককেই দেখা যায় সৃষ্টি করে বসেন রকেট সায়েন্স। যা পাঠ করার জন্য আজীবন স্টাইপেন্ড দিয়ে লোক রাখা ছাড়া কাব্য দেবতার কোনো উপায় নেই।
তাহলে সম্মানিত পাঠক/পাঠিকাগণ, আপনাদের কাছেও কবিতা কী সেই প্রশ্ন রইলো, সময় পেলে ভেবে দেখবেন। ভাবার কাজটি চলতে থাকুক। তবে আমিও মাঝে-মধ্যে ভেবেছি। এই যেমন ধরুন, আমার কাছে মনে হয়েছে মানুষের ভাবনার যজ্ঞকাঠে যখন অনুভূতির আগুন লাগে তখন তার সর্বোদ্ধ স্ফুলিঙ্গটিকেই আমার কাছে কবিতা মনে হয়। সেই হিসাবে লিখিত কবিতাটি আসলে এক ধরনের অনুভূতি স্ফুলিঙ্গ বা ফুলকির অনুবাদ। আর কাগজে অক্ষরে কীরূপ পরিগ্রহণ করবে তা নির্ভর করে কবির শক্তির উপরে। সেদিক থেকে কবিকে আপন অনুভূতি স্ফুলিঙ্গের অনুবাদকও বলা যেতে পারে। রহস্যময়তার সমর্থনে আবার অন্যভাবেও বলা যায়, যেমন ধরুন কবিতা হল জীবনের আভা, জীবনের জ্যোর্তিময়তা। এটা ঠিক শরীরের মধ্যে থাকে না, আবার শরীর থেকে খুব দূরেও থাকে না।
এখন প্রশ্ন হতে পারে এই অনুভূতি আগুনের ফুলকির অনুবাদ জগতের কোন কাজে লাগে? আমার মনে হয় লাগে। মনের মধ্যে ভাবনার যজ্ঞভূমি সব মানুষেরই আছে। আর অনুভূতির আগুনে ভাবনার সেই যজ্ঞকাঠ সবারই প্রজ্বলিত হয়। অনুভূতি আগুনের সেই সর্বোচ্চ ফুলকিটি নিমিষকাল সবার মনেই ফোঁটে। কবি যেমন প্রকাশ করতে পেরে আত্মমুক্তি ঘটায়, সাধারণ মানুষ তা পারে না। তবে তারও মুক্তি ঘটে কবির সেই কবিতায় এক সৌন্দর্যমুগ্ধ আস্বাদনে। এখন প্রশ্ন হতে পারে কবিতা কি তাহলে অবশ্যপাঠ্য কোনো জ্ঞান বা বিদ্যা! না, কবিতাকে আমি অবশ্যপাঠ্য কোনো বিষয় বা জ্ঞান বলছি না। মননশীল পাঠকের কাছে কবিতা এক উচ্চমার্গীয় বিনোদনের উপচার মাত্র। তার আস্বাদনে পাঠক তার মনের মধ্যে একটা আনন্দলোকের উপস্থিতি টের পান। এখন একালে কবির আর সেই আগের মত মহাঋষি বা মহাযোগীর মত ভেক ধরার উপায় নেই। সে সাধারণেরই একজন। তবে একটু বিশেষ গুণ সম্পন্ন বিনোদনকর্মী, এই যা
প্রিয় পাঠক, তাহলে কবিতা শিল্প হিসাবে দূর কাল অবধি টিকে থাকতে পারে যেসব কারণে সেটি জানালাম (অন্তত আমার দৃষ্টিতে) কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- সেই সম্ভাবনার মূলে প্রতিনিয়তই অজস্র কুঠারাঘাত করছে বিপুল সংখ্যক অকবি, আধাকবি, উপকবি এবং বিভ্রান্ত অপকবির দল। এদের প্রধান চাওয়া খ্যাতি, শুধুই খ্যাতি- প্রকৃত কবিতা সৃষ্টি নয় ফলে এদের অনেকেই না বুঝে দূর দেশের কোনো খ্যাতিমান কবির মুরিদ হিসাবে নিজেদেরকে জাহির করার চেষ্টা করেন অথবা দূর দেশের কোনো কাব্য দর্শনের সোল ডিলার হিসাবে স্থানীয় কাব্য সরোবরকে দূষিত করার চেষ্টা করেন। আবার অনেকেই আছেন যারা নতুন কাব্যভাষা বা কাব্যকলা সৃষ্টির নামে প্রতিনিয়তই পাঠককে কাঁচকলা উপহার দিয়ে থাকেন। ফলে যা হবার তাই হয়, কবিতার সাথে পাঠকের দুরত্ব সৃষ্টি হয় বা কবিতা সম্পর্কে সমকালীন পাঠকের মোহমুক্তি ঘটতে থাকে। এদের মধ্যে একদল আছে যারা অনেকটা ঝরে পড়া এঁচোড়ের মত। এই ইঁচড়ে পাঁকাদের বোঝানো মুশকিল যে তারা কবিতা সৃষ্টির জন্য এখনও মানসিকভাবে পরিপক্ক নন। আরেকদল আছেন বুঝে হোক, না বুঝে হোক ল্যাবরেটরির এবড়ো-থেবড়ো এক্সপেরিমেন্টটি তুলে দেন পাঠকের পাতে, এবং কিছু বলতে গেলেই কবিতার আইনস্টাইন হিসাবে বেশ রুদ্ররূপে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে এমন সব নিম্নমানের মেধাবীরাও থাকেন যে, প্রচলিত কবিতা সৃষ্টির ক্ষমতা আদৌ তাদের আছে কিনা সে আত্মশক্তি বিচার করার ক্ষমতাও তাদের থাকে না। অথচ সেই কিনা দেবে নতুন কাব্যকলা! আর সেই সব কাব্যকলা যে কী রকেট সায়েন্স তার উদাহরণ দেয়া বোধ করি নিষ্প্রয়োজন। বাংলা ভাষার লিটলম্যাগাজিন, পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে। কথা হল নতুন কবিতা, নতুন বাক রীতি, নতুন কাব্যকলা, নতুন কাব্যদর্শন এগুলো কি প্রতিদিন এবং প্রতি ঘরে ঘরে এবং প্রতি জনে জনে সৃষ্টি হবার বিষয়? কিন্তু অকবি, আধাকবি, উপকবি এবং বিভ্রান্ত অপকবিরা মনে করে এগুলো প্রতি ঘরে ঘরে এবং প্রতি জনে জনে সৃষ্টি হবার বিষয়।
যেকোনো পরিবর্তনের পেছনে অজস্র কারণ থাকে। কোনো নতুন দর্শন সৃষ্টি হয়ে ওঠার পেছনেও তা সত্য। আবার সেই দর্শনের বিকাশ এবং উপযোগিতা সৃষ্টির জন্য একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হয় অজস্র মেধাবীদের। তবেই তা ধীরে ধীরে জনপুঞ্জে আস্বাদন উপযোগি হয়ে ওঠে। অথচ আমাদের দেশে এসবের থোড়াই কেয়ার, মনে মনে সবাই কাঞ্চনজঙ্ঘা, বাস্তবে উঁই ঢিবি।
যাইহোক, উপরোক্ত সংকট থেকে মুক্তি ঘটুক বাঙালি কবিদের। বাংলা ভাষার মত পৃথিবীর অন্যতম বৃহ জনগোষ্ঠির ভাষায় সৃষ্টি হোক অজস্র মহ কবিতার সে কামনাই করি। তবে এক্ষেত্রে যোগ্য পাঠক বা পাঠকের যোগ্যতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়
এবার আসা যাক ভবিষ্যতের কবিতা কেমন হতে পারে সেই প্রশ্নে। এখানে ভবিষ্য বলতে নিশ্চয়ই আমরা দু-এক দশক বা শতাব্দীর মধ্যে থামতে পারছি না। বিষয়টি নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, ভাবনাটিকেই কিছুটা অবান্তর মনে হয়েছে। আসলে ভবিষ্যতের কবিতা কেমন হবে তা কেবল ভবিষ্যতের মধ্যেই আছে। সেটা যদি পড়ে ফেলা যেত তবে তা আর ভবিষ্যতের থাকতো না। কাজেই ভবিষ্যতের কবিতা ভবিষ্যতেই থাক। জয় হোক কবিতার, উজ্জ্বল হোক কবিতার ভবিষ্য

Post a Comment

0 Comments