শিবলী মোকতাদির
অন্ধের ওস্তাদি
ধরেন সেই কালে- যে বছর বঙ্গবন্ধুরে হত্যা করা হলো। বা হতে পারে তার পরের সালে।
আমি তো তখন ছোট। শরীর-জ্ঞানে সদয়। আকারে-আখ্যানে বুঝি সব, তবে বিস্তারে অল্প। গ্রামে
থাকি। ছোট্ট গ্রাম, তবে তার নদীটি বিরাট। ফাঁকা ফাঁকা মাঠ ফুল-ফসলে ভরা। বাট, মানুষ
ছিলো একরত্তি। একেবারে বর্তমানের উল্টো চিত্র। নানান প্রকারের পথ দিয়ে মোড়ানো সেই গ্রামে
নানাবিধ খাল-বিল। উঁচু-নিচু পাখ-পাখালিতে সারাক্ষণই মুখরিত গ্রামের আড়া-জঙ্গল। আমি
এইসব দেখি। নদীতে বজরা এলে, পানি পানায় ভরলে উতলা হই। দূর থেকে ভেসে আসা উচ্চাঙ্গের
সুরে সুরভিত হই। চিলের চরিত্র নিয়ে ভাবতে ভাবতে, দোয়েলের দরদী ডাকে ভূতের মতো অন্ধকারে
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি।
আমাকে কেন্দ্র করে সময়, সমাজ তথা সকল সততাকে মান্য করে একদল মানুষ বিচরণ করতো
সব সময়। তারা নদীর কিনারে, টিলার টঙে, ঝোপের আনাচে-কানাচে বাস করতো আমাদের গ্রামকে
চক্র করে। আর বেহুদা বাহাস নিয়ে মেতে থাকতো সারাক্ষণ । তবে খুব অবাক লাগতো এত যে চিলচিৎকার,
এত হট্টযোগ অথচ কণামাত্র টের পেত না কেউ। হয়তো আমলেই নিতো না। জগতের কোন লক্ষণে, গ্রহের
কোন আচরণে জানি না ঠিক, তবে ব্যক্তিগতভাবে তারা সকলেই ছিলো অন্ধ আর বধির।
ভীতু আর সাহসীর মধ্যমণিতে দাঁড়িয়ে দুর্লভ অচেনা এক টানে বিশাল নদীটিকে মুহূর্তেই
স্বপ্নে খাল বানিয়ে মাঝেমাঝেই তাদের অঞ্চলে টুক করে একা একা ঢুকে পড়তাম আমি। আমার আগমন
কেউ গন্ধে কেউবা স্পর্শে টের পেত। তাদেরই একজন অন্ধ নওজোয়ান- নাম তার শুকনু। আমি ডাকতাম
শুকনু চাচা।
প্রাচীন আর তামাটে সেই সময়ে হয়তো ছোট বলেই সবকিছু বড় বড় মনে হতো। নদীরে যেমন
সাগর, টিলারে যেমন পাহাড়। সাদা জোব্বায় শুভ্র-দাড়ির মুরুব্বিরে মনে হতো মিশর থেকে আসা
সাত শ বছরের পুরানো জিনের বাদশা। ভয় লাগতো। তাদের আহার-বাহার, কর্ম-ধর্ম, আদান-প্রদান
সব কেমন অদ্ভুতুরে। কোনটা রাগ কোনটা অভিমান বুঝতে বুঝতেই সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত
আমার। তারা আহার করতো লুকিয়ে লুকিয়ে, একে অন্যের থেকে ছিন্ন হয়ে যথেষ্ট দূরত্ব বজায়
রেখে। অথচ প্রস্রাব-পায়খানার মতো লাজুক আর স্পর্শকাতর বিষয়গুলো ঘটাতো একেবারে এলেবেলেভাবে।
পারলে এ ওর কোলেতে উঠে। আর এইসব দেখে যথেষ্ট ভাবনায় পড়লে, চিন্তায় আমার চিল উড়ে গেলে
তারা কেবলই হাসতো। সে কি উচ্চস্বরে, হাসির হায়েনাতে ভর করে। বাকিরা চলতো ইশারা-ইঙ্গিতে।
তো এমনই গ্রাম্যগণ্ডির মধ্যে সেকালে সকলের ন্যায় আমরাও থাকতাম আমাদের গ্রামে
পরিবারবেষ্টিত হয়ে, একে অপরের নিকট ও আপনার রূপে। ব্যথায় ব্যাথিত, আনন্দে উদ্ভাসিত
হবার রীতি তথনও চালু ছিল বটে। ঈদের পরে ঈদ, কালির পরে দূর্গা পুজোয় সময় বয়ে যেত কেবলই।
আর এভাবেই ঋতুর আসা-যাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা কেবলই বেড়ে উঠছিলাম দুই পাড়ের একেবারে
ভিন্নধর্মী দুই জনগোষ্ঠীর প্রথা আর পাবর্ণের মধ্য দিয়ে।
আর এমনই এক চৈত্রশাসিত বসন্তকালে গ্রামে, মতান্তরে নিজেদের পাড়ায় নিত্য দিনের
ছন্দ ভেঙে উদয় হলো এক নতুন বিষয়ের। ভোরবেলা। আযানের ডাকে নামাজও শেষ। মিষ্টি আলোয় কেমন
চাপাস্বরে পাখিরাও ডাকছে খুউবই ফিসফাস আর মৃদুস্বরে। অজানা আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভরপুর।
তবে কি হুট করে চাঁদ উঠে আজই ঈদ এসে গেল অপ্রস্তুত আমার আঙিনাতে? অথচ স্কুল আছে। তার
আগে তৈরি হবার তাগাদা আছে। কি করি! ঘটনার ঘনত্ব বুঝি কি করে? এত লোক জমায়েত দিচ্ছে
আর আমি রুটির সাথে গুড় খাচ্ছি পানি ছাড়াই বিষম ওঠার ছলে। কি করি মা’কে বললে বকা নিশ্চিত। নিরুপায় হয়ে সেই দাদীর উপরে আছর করলাম।
............................................................................................................
তার আগে তৈরি হবার তাগাদা আছে। কি করি! ঘটনার ঘনত্ব বুঝি কি করে? এত লোক জমায়েত দিচ্ছে আর আমি রুটির সাথে গুড় খাচ্ছি পানি ছাড়াই বিষম ওঠার ছলে। কি করি মা’কে বললে বকা নিশ্চিত। নিরুপায় হয়ে সেই দাদীর উপরে আছর করলাম।
...................................................................................................
তিনি কি বুঝতে
কি বোঝালো কে জানে, দেখলাম পুরো স্কুলই ছুটি হয়ে গেল তার এক ইশারাতে। ভয়ে ভয়ে আকাশে
নয়ন ঢেলে দেখি নীল-কালো মেঘের মহারাজারা আচ্ছামতো ঘুরে বেড়াচ্ছে; একে অন্যকে জাপটে
ধরে। জমা হচ্ছে। অন্ধ-বধিরদের মতো নিঃশব্দে অচেনা ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। ঝড় বইতে পারে।
হয়তো সে কারণেই আজ বাতিল হলো স্কুল।
তো এমত কার্ষকারণে আমাকে আর পায় কে। এক দৌড়ে ঘটনার একেবারে কেন্দ্রস্থলে। অন্ধের
আস্কারা পেয়ে বধিরের সঙ্গে বাহাস করে ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে যা দেখলাম বুঝলাম না তার
কিছুই। তৎকালে বি এ, বি এড মুন্নু মাস্টার পাশেই দেখি দাঁড়িয়ে আছে। পানের পিক ফেলে
ঘাড় ঘুরে আমাকে বলে, কি রে বেটা বুঝলি কিছু? আমি তো ডানো খাই, মাছের বদলে মশকরা খেতেই
ভালো লাগে আমার। বললাম, না জ্যাঠা! সবাই তো মগজে তালা মেরে আছে। অন্ধের জবানে, বধিরের
ইশারাতে যতটুকু বুঝলাম; শুনতেছি ছোট চাচায় পানি ওঠানোর কল কিনে আনছে। তো এ তো দেখি
অন্য কিসিমের। টিউবয়েল তো এমন না। শুনে মাস্টার হাসে। সে কি হাসি! তার হাসির চোটে জগতের
সকল হসন্ত ভয়ে দেশান্তরিত হয় আরকি! মাড়ির দাঁতে কারণে অকারণে খোঁচা দিয়ে বলে, ওরে
গাধা! এ হলো ডিপ-টিউবয়েল। মানে শ্যালো মেশিন। আচ্ছা ডিপ বুঝিস তো? মানে গভীর। সেই যে
ভূগোলে পড়াইছি প্রশান্ত মহাসাগর, দেখেছিস? কি রকম বৃহৎ আর গভীর। অর্থাৎ গভীর হতে আনয়ন
করে যে জল। শিক্ষক মানুষ, প্রশ্নে উত্তর না লাগালে কখন কি করে বসে এমন ভাবনা থেকেই
ঝটপট বলে ফেললাম- ও প্রশান্ত! তারে তো চিনি। বধিরগঞ্জে থাকে। কাগজে আঠা মেরে চকিরহাটে
ঠোঙা বিক্রি করে। আমার এহেন উত্তর শুনে মনে হলো অশ্লীলতার দায়ে দাঁতে জিভ কেটে একেবারে
বিষণ্য বিভঙ্গে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। এমন দৃষ্টিতে তাকালো হয় আমি নয়তো মাস্টার দুজনার
একজনা একেবারে ঠিক আমড়াকাঠের ঢেঁকি। বোঝার চাইতে মজার হইলো মাস্টারের চিরকালীন এমন
সব আকার-আঙ্গিক। হাসি পায় আমার।
তো সকলের ন্যায় আমিও খানিকটা মনোযোগ দিয়ে দেখি। অন্ধ বুঝলে আমার চোখের ইজ্জত
থাকে কী? এই হইলো শ্যালো মেশিন। বাপ রে! দেখি খানিক দূরে ভাঙা আর এক চেয়ারে বসে চেয়ারম্যান
আইজুল বোকা, বেকুব, অন্ধ-কালা, বামন, বাগদি জাতের মধ্যে পাত ছুড়ে দিয়ে সকল আগতদের উচ্চস্তরে
আরো বোঝাচ্ছে- দেখ, এই হইলো পাইপ। কেমন মজবুত আর ইয়া মোটা। পাইপ মানেই পাপের শাস্তি।
তিন শ ফিট নিচে গিয়ে এ পানি উঠাইবো। ভাবা যায়!
দেখি নানান জনে হাজার অভিজ্ঞতার ছলে শ্যালো রে নিয়া কথায় কথায় ছয়লাব করে দিলো।
আমি খানিক বুঝলাম, খানিক হারালাম। তবু সকলের থেকে আলাদা করে খানিকটা বুঝতেছি আর মেশিনের
এপাশ-ওপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতেছি। কেমন আজিব আর বিদঘুটে তার অবয়ব। ডোমের ন্যায় অহেতুক এক
ডা-া হাতে সারাক্ষণ চরে বেড়ায় আমাদের সোলায়মান হাজি। কথার চাইতে বার্তার ফেরিওয়ালা
ফট করে বলে বসলো, ক্যা রে মকবুল শ্যালো কিনলু ভালো কথা, তো স্টার্ট যদি বন্ধ না হয়
বাপ এ তো খাল-পাথার এক করে দেবেনি! তাই কিনা! চোতমাসের বন্যা আর টুলুর মায়ের কন্যা!
ঘটনা কিন্তু ম্যছাকার করে ছাড়বেনি! বড়রা বুঝে হাসে। আমরা ছোটরা অবাক হই। কন্যা নিয়ে
তো আমাদের কারবার নাই। কথা তো ঠিক। মেশিনই যদি বন্যা ডেকে আনে!
এক সময় কথা যখন পাতলা হয়। ভিড় যখন হালকা হয়। দেখি চাচা বসলো আহারে। খায় আর
গল্প করে। কত কষ্টে, বুঝলেন কিনা কত দূর থেকে, সেই মাদারগঞ্জ; হোক পুরাতন কিনে আনা
লাগলো। বাজারোত তো এ মাল পাওয়া যায় না আব্বা। দাদা রে বোঝায়। দাদা আমার কলকি খাওয়া
মানুষ। নামাজ অন্তে কলকি টেনে দে ঘুম। আজ ঘটেছে ব্যতিক্রম। কি আর করা! বাক্য যেথা আগে-পিছে
লাগাচ্ছে খালি হুম! যদিও তারা লতায়-পাতায় জড়িত হয়ে কাহিনীর টানে আজ আমার চাচা আর দাদা।
তবু আমি মনোযোগ দিয়ে শুনি। একজনের চোখে আগামীর স্বপ্নে বাসা বাধছে দারুণ সব সম্ভাবনা।
অন্যজনা টালমাটাল, কি আর হবে! চোখের মধ্যে কেবল নোনা।
কথা শুনে জানা গেল কাল আসবে কলের কারিগর। সে পুতবে পাইপ আমাদেরই আমবাগানের
ভিটেতে। আর তার থেকে সামান্য নিচুতে ছয়লাব হবে পানিতে। এমন ক্রীড়া শেষে বিশ বিঘায় ইরি
ফলবে সহজে। চাচার আছে বিঘে দুই। বাকিটার যোগান দেবে বাকি জনগণে। আরো বুঝলাম তারা চুক্তি
করবে। পানির একটা রেট দেবে। মকবুল চাচা হাসে। সব ফকফকা। ঠিকের ওপর এক শ ভাগ, বেঠিকের
কোনো স্থান নাই সোনা।
এই গ্রহ ঘুরতে থাকে। বিকেল গড়ে সন্ধ্যা হয়। ঝিঁ ঝিঁ ডাকে। পেঁচা হাঁকে। পাঁকদণ্ডী বেয়ে কে যেন সঙ্গীতকে সহায় করে বাড়ি ফেরার কারণ খোঁজে।
বধিরগঞ্জের সকল বাক্য থেমে যায় এক সময়। শেয়াল তাড়ানোর ছলে কাশেমের শালি যায় কাশঝাড়ের
দিকে। রাত বাড়ে। এ গলিতে চেনা মুখ, ও গলিতে ব্যর্থ সুখ। চলে রঙের পরে ঢং। দেখতে দেখতে,
ভাবতে ভাবতে তেল ফুরিয়ে যায় হারিকেনের। উঠোনেই মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়ি। ঝকঝকে তারায়
উদ্ভাসিত আকাশ। মিটমিট করে আলো জ্বেলে এক দেশের প্লেন অন্য দেশে চলে যায়! শেয়ালের শয়তানিতে
প্রহর ফুরায়। মাঝখানে অযথাই অস্থানে ঘুমিয়ে পড়ি আমি।
..........................................................................................................................
অবশেষে বহুত ঘটনা ইরেজ করতে করতে বিসমিল্লাহ বলে আলতাফ হ্যান্ডেল ঘোরালো জোরছে। সাঁই সাঁই করে লোহার এক চাকা ঘুরতেছে আর ঘুরতেছে। অন্য হাতে চাবি মারতেই কালো এশরাশ ধোঁয়ায় চারদিক ধোঁয়ায়িত করে মেশিন চালু হয় হয় করেও শেষমেষ থেমে গেল।
..........................................................................................................................
পরদিন যথারীতি স্কুল শেষে এসে দেখি পাইপ বসানোর কাজ প্রায় শেষ। কিছুটা আপশোষ
নিয়েই ঘরে ফিরে যথা ও যেমন রীতিতেই ঘুমিয়ে রাত্রি করি পার। ঘুমে আমার পরী এসে কোমরে
পালক গুঁজে দিয়ে যায়। অন্ধ আলেক- এর জন্য নতুন সংবিধান দিয়ে বলে, এই নাও; তারে তুমি
আপেলের বনে একা একা ঘুরতে বারণ করো। বরং সে যেতে পারে দ্রাক্ষাবনে। ডুমুরের ভগ্নিপতি
এত যে লটকন সে কোথা থেকে পায়! হায় রে ছক্কা! স্বপ্ন ভেঙে গেলে কেবলই বোল্ড-আউটের নিরন্তর
হাহাকারে সমগ্র পিচ চৌচির হয়ে যায়।
বাস্তবে, অবশেষে মেশিন আজ রেডি। আলতাফ মেকার বিড়ি টানছে টেনশানে একের ঘরে অধিক।
পাশেই মেশিনম্যানের ঘর ওঠানোর কাজও শুরু হয়ে গেছে। বিশাল ফয়ছালা। এদিকে মিলাদের পর
মিষ্টির নামে মোয়াও বিলি হচ্ছে দেদারছে। সব ভালো আর ভদ্র কথা। কাহিনীর কা- দেখতে প্রাগুক্তস্থানে
বিবিধ পাড়ার বৃদ্ধ-পোলা, বালিকা আর বৌঝিতে একাকার। হরেক মানুষের হাজারো গন্ধে ভিটে
আমাদের টক-ঝাল-মিষ্টিতে ভরপুর।
অবশেষে বহুত ঘটনা ইরেজ করতে করতে বিসমিল্লাহ বলে আলতাফ হ্যান্ডেল ঘোরালো জোরছে।
সাঁই সাঁই করে লোহার এক চাকা ঘুরতেছে আর ঘুরতেছে। অন্য হাতে চাবি মারতেই কালো এশরাশ
ধোঁয়ায় চারদিক ধোঁয়ায়িত করে মেশিন চালু হয় হয় করেও শেষমেষ থেমে গেল। যে তালি ফোটানোর
কথা আচমকা সেও গেল থেমে। খানিকটা দম নিয়ে চাওয়ালি বিড়িতে কষে এক টান মেরে ফের হ্যান্ডেল
মারে আলতাফ মেকার। এবারেও মেশিনের কার্যকারিতা তথাস্তু। ভনিতার ছলে ভক ভক করে ধোঁয়া
মেরে থেমে যাওয়া। আলতাফের কাজ হ্যান্ডেল মারা। আমাদের কাজ তালি মারা। অথচ কোনো হাতেরই
কার্যকারিতা নাই। পাঁচ-দশ-পনের বারেও মেশিন কথা কয় না। ভিড় থেকে ছিটকে এসে নানান জনে
নানান মত দেয়। মত আর মাতব্বরি না শুনে পারাও মুশকিল এমতাবস্থায়। দেখি জ্ঞানের ভান্ডার
ভেঙে যে যা পারে খানিকটা করে বিলিয়ে দিচ্ছে, দিচ্ছে মেশিনের প্রাণসঞ্চারের নিমিত্তে।
তবু কিছুতেই কিছু হয় না। যত রকমের জোয়ান আছে পাড়াসুদ্ধো সবাই একবার-দু’বার চেষ্টা করে দেখে। হয় না। মেশিন খলিলের লাজুক নাতনির মতো কোনো কথাই বলতে
চায় না। খালি ভক ভক ধোঁয়া আর হাঁপানি রোগির মতো সাঁই সাঁই শব্দ করে। আর এই করতে করতে
অবশেষে থেমে যায়। সেই দুপুরে শুরু হয়ে এক-ই কাম এক শ বার করে সন্ধ্যায় পরিণত হলো যা
কিনা অকামে।
মেশিন তার নিজ ম্যানার হারিয়ে পদার্থের ন্যায় বসে আছে পুরোটাই অপদার্থরূপে।
আর তাকে ঘিরে বসে থাকা উপহাসের অংশ হয়ে আছি আমরা। সার্কাসের হাতি না হাসলে মাহুতের
কি দোষ! কি আর করা আজকের মতো এ খেলায় খ্যান্ত দিয়ে চলে যায় সকলেই যে যার উঠোন পানে।
রাতে চাঁদ স্পষ্ট হলে পানি কেনা জমির জনগণ এসে হাজির মকবুল চাচার বাড়িতে। তারা সমস্বরে
এক জোট হয়ে বলে, ভাই মকবুল বিল দিছি অগ্রিম। চাষ মারা লাগবি। পানি ছাড়া তো হবিনে বারে!
তোমার শ্যালো তো কথা কচ্চে না। খালি খালি আইল বান্ধে লাভ কি হলো? ইরির তো ছিরি দেখা
লাগবি!
মকবুল বিব্রত হয়। কাচুমাচু স্বরে বলে, আরে হবি বারে! কাল ঠিক হবি। দামি মেশিন।
এনা পড়ে আছলো তাই বিগড়ে গেছে। কাল দেখো এমন পানি উঠপিনি, হুম। যাও বাড়িত যাও।
এই কথা মকবুলের। কিন্তু পরদিন মেশিন কইলো অন্য কথা। সকাল থেকে গ্রাম্যভাষায়
সাত শ বার হ্যান্ডেল মারা হলো। শ্যালো খালি কাশে। দাঁড়াই দাঁড়াই করেও ফের শুয়ে পড়ে।
ফলে মানুষ যায় ক্ষেপে, বাচ্চা ওঠে হেসে। প্রবাহমান ঘটনার এইসব দিনরাত্রি খানিকটা দূর
থেকে ঠিকই অবোলোকন করছিলো আমাদের সকলের অজান্তে, ইয়া তাজা এক তরুণ। পেশীর পা-ব, একহারা
চেহারার অবাঞ্ছিত এক যুবক। নাম তার শুকনু। ভিন্নার্থে কানা শুকনু। মূর্খ-মানব সে, থাকে
বধিরগঞ্জেরও তিন দিগন্ত দূরে সেই ফকিরগঞ্জে। শিক্ষিতের মধ্যে ঢুকে অযথায় ভেজাল করতে
চায়নি সে। তবে কা- দেখে, অবশেষে গা ও মনের জোরেই ভিড় ঠেলে হাতরে হাতরে ভিতরে ঢোকে সে।
বলে মকবুল মামা, হামি একবার হ্যান্ডেল মারে দেখমো ক্যা বারে! গত দুই দিনের অবিরাম পরিশ্রমে
সবাই চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো অযথায় বসে আছে এদিক-সেদিক বিচিত্র জ্যামিতিকতায় হাত-পা
ছড়িয়ে। ফলে, কে আর অনুমতি দেবে?
ফায়দাটা কাজে লাগায় শুকনু। কাছে আসে। মানুষ আর মেশিনের গন্ধ শুকে শুকে। লেংটি
মেরে হতের তালুতে থুথু দিয়ে আল্লার নামে হ্যান্ডেল ঘোরায় জীবনের সমস্ত শক্তি দিয়ে।
চাকা ঘুরছে চাকা ঘুরছে বনবন করে। তীব্র থেকে হচ্ছে তীব্রতর। হঠাৎই কোথা থেকে কে জানে
বিশ্বাস আর শক্তির বাকশালী এক বিষ্ফোরণ ঘটে যায়। ঢাক ঢাক শব্দে লাফিয়ে ওঠে মেশিন। সকল
দুর্ভাবনাকে দূরে ঠেলে চালু হয় শ্যালো। অবশেষে। অলসও কলস নিয়ে দেখি এই খবরে ছুটে আসে।
ওরে শ্যালো চালু হইছে রে! তর্জনে-গর্জনে বাতাস ভারি করে ইয়া মোটা পানির ধারা উগলে দিচ্ছে
মেশিন তার মুখ দিয়ে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। জল-কাদায় কমবেশি সবাই একাকার। এদিকে শুকনু
রে কোলে তুলে আনন্দে নাচতে শুরু করেছে মকবুল চাচা।
............................................................................................................
এখন আমি ৪৮ এর আস্ত এক মানুষ। সেই গ্রাম কবেই পরিণত হয়েছে সেমি-পাকা শহরে। গ্রাম ছেড়ে শহুরে এই আমি এখন কালে-ভদ্রে গ্রামে যাই বটে। আমাদের সেই আমবাগানের ভিটের দিকে চোখ পড়লেই মনে পড়ে শুকনু চাচার কথা। শ্যালো রে সচল করার ওস্তাদ। তাকে খুঁজি। সে এখন কেমন শীর্ণ আর সরু হয়ে গেছে। ৭০ এর শান্ত এক যুবক। বয়সের বাহানায় চেপে বধিরগঞ্জে নিজ বাড়ির সামনেই সামান্য সস্তা
...................................................................................................
যাই হোক, সারা রাত চললো শ্যালো। পানিতে পানিতে টইটুম্বুর চাষের জমি। পরের দিন
যে যার হাল নিয়ে হাজির। চাষ হলো। চারাও রোপিত হলো ইরির। তিনদিন পর নতুন করে পানি যাবে
ইরিকে উজ্জীবিত করতে। কাজেই নতুন করে শ্যালো স্টার্ট দেবার পালা। বাতেন আছে এইসব দায়িত্বে।
সে নানানভাবে হ্যান্ডেল মারে। মেরে মেরে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে ধরলো চাচা রে। বলে, মামা-
শ্যালো তো আবার স্টার্ট নেয় না।
হ, কথা যা কাজ তাই। শ্যালো ফের ফিরে গেছে তার পূর্বের চরিত্রে। মহা জ্বালা।
এমনি ভাওতা মারে আর ভক ভক আওয়াজ করে। ওদিকে দিন যায়। রাতের আগে সন্ধ্যা যায়। এভাবে
দুইদিন জীবন থেকে হারিয়ে যাবার পর ইরির মালিকেরা উপায় না বুঝে শেষকালে আন্দোলনের রূপরেখা
নিয়ে হাজির। তারা বলে, খালু বিছন তো পানির অভাবে লাল হয়ে যাচ্ছে। পানি দেওয়া লাগবি।
এ তোমার কোলজে খারাপ শ্যালো দিয়ে তো হবিনেনি বাপু।
কথার নানান মোচড় শুনে, চাচা তো চিন্তায় পড়ে যায়। তাদের হেমন-সেমন বুঝায়ে কি
করা যায় এই নিয়ে ভাবতে গিয়ে ফের শুকনুর মুখটা মনে পড়ে যায়। খুঁজে খুঁজে ফের শুকনু রে
ডেকে আনা হলো। সে হাসে। অন্ধের অহমিকা দুই চোখে লেপ্টে দিয়ে। লেংটি মেরেই দুই তালুতে
থুথু দেয়। বলে, সরো সরো বাচ্চালোক। হাত দিয়ো না লোহাত, সব যাবি খোয়াত। হ্যান্ডেল উস্টে
গিয়ে দাঁত চটকে যাবি। শুকনু স্বাভাবিক নিয়মেই হ্যান্ডেল মারে। চাকা ঘুরছে, চাকা ঘুরছে
চাবি মারতেই সব ফকফকা। হাসতে হাসতে এক থাপ্পরেই কেঁদে ওঠে মেশিন। বিকট বীরত্বে গল গল
করে উগলে দিতে থাকে পানি। যেন কিছুই হয়নি এই ভাব নিয়ে শুকনু ভিড় ঠেলে বেরিয়ে পড়ে। ঘ্রাণ
আর ঘনত্ব বুঝে টুক করে কখন সবার অজান্তেই যেতে যেতে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।
একদিন ভরদুপুরে দেখি শুকনু শুয়ে আছে আমাদেরই পরিচিত এক বট গাছের ছায়ায়। সে
কি ঘুমায়? স্বপ্ন দেখে? ভয়ে পায়ে পায়ে আমি তার নিকটে গিয়ে শুধাই, চাচা কি ঘুমাও? সে
ফিক করে হাসে। দাঁত কেলিয়ে বলে, না রে বাপ! জিরাইতেছি। বিস্ময়ের বারুদ জ্বেলে আমি তারে
ফের প্রশ্ন করি, এইডা তুমি কেমনে পারো? এত লোক, মেকার আর মিস্ত্রিতে ধুলোয় কুপোকাত।
আর তুমি এক চাঞ্চেই কেমনে শ্যালো রে সচল করো? তাতেও সে নির্বিকার। কেবলই হাসে। বলে,
তাগদ লাগে রে বাপ! আমি বলি, উহু! অন্য কিছু আছে। বলো আমাকে। সে হাসে। বলে, হয়তো আছে!
বড় হলে সব বুঝবি ধন, এখন বাড়িত যা।
তার কথা মতো আমি গেছি আমার বাড়িতে। সেও গেছে আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কায় ফিরে তার গৃহে।
দিন-মাস-বছর গেছে। ঋতুর পরে আছড়ে পড়েছে ঋতু। মকবুল চাচার শ্যালোর ব্যাবসা একসময় থেমেও
গেছে। এর পরে কালের কলঙ্কে ভর করে কত শ্যালো এসেছে আর বিদায় নিয়েছে। কত পানি, কত ইরি
আর ইতরামো হয়েছে। পাখির পালকের মতো আধো আধো মনে আছে আমার। বাকিটা হারিয়ে গেছে শৈশবের
ড্রইং খাতার মতো।
এখন আমি ৪৮ এর আস্ত এক মানুষ। সেই গ্রাম কবেই পরিণত হয়েছে সেমি-পাকা শহরে।
গ্রাম ছেড়ে শহুরে এই আমি এখন কালে-ভদ্রে গ্রামে যাই বটে। আমাদের সেই আমবাগানের ভিটের
দিকে চোখ পড়লেই মনে পড়ে শুকনু চাচার কথা। শ্যালো রে সচল করার ওস্তাদ। তাকে খুঁজি। সে
এখন কেমন শীর্ণ আর সরু হয়ে গেছে। ৭০ এর শান্ত এক যুবক। বয়সের বাহানায় চেপে বধিরগঞ্জে
নিজ বাড়ির সামনেই সামান্য সস্তা এক মুদির দোকানী সে। যে গ্রামে দিনের আলোয় রাত্রি চলে।
যে গ্রামে কোকিল মানেই কুকুর ডাকে। বহুদিন পর আজ আমি ফের এসেছি তাদের টানে। সব আছে
আগের মতো। দিনের ঘণ্টা থেমে গিয়ে সন্ধ্যার শামিয়ানায় আবৃত এই রাতে তার খোঁজে তাকে
ডাকতে গিয়ে বলি- অন্ধকারে করেন কি চাচা? নিদেনপক্ষে একটা কুপি তো জ্বলান! বহুদিন পর
আবার সেই গোপন গৃহস্থের হাসি। আমাকে চমকে দিয়ে বলে, নাদানই রয়ে গেলি রে! ওরে, আমি অন্ধ।
আমার দিনই কি রাতই কি? কুপিই কি আর কারেন্টই কি? সব ফকফকা। শুনে আমি হোঁচট খাই। বধিরের
বয়ান কি শোনা যায়! অদ্ভুত এক শিহরণ আমার সারাদেহে বাধভাঙা স্রোতের মতো ছুটতে থাকে।
একই সঙ্গে দেহের লোম আর লিঙ্গ উত্থিত হয়ে ওঠে। তবুও তাকে গোপনে ডাকতে ইচ্ছে করে ওস্তাদ
কেমন আছেন? বাস্তবে পারি না আমি। বলি, এখন তো আমি বড়। বলেন, কি করে শ্যালো রে সচল করতেন
চাচা? উত্তরে সেই একই হাসি। সেদিনের মতো। এমন বিদঘুটে অন্ধকারকে ভেদ করে নাতি রে কোলে
নিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যেতে যেতে বলে, জীবনের সব ওস্তাদি ফাঁস করতে নাই রে বাপ!
............................................................................................................
পরিচিতি :
নাম : শিবলী মোকতাদির
কবি, প্রাবন্ধিক
জন্ম : ১১ জুন ১৯৬৯ বগুড়া, বাংলাদেশ।
প্রকাশিত গ্রন্থ :
ধানের রচনা দিলে পত্রে (কাব্যগ্রন্থ)
ছন্দের নান্দনিক পাঠ (প্রবন্ধগ্রন্থ)
নিষিদ্ধ পুষ্টির কোলাহল (কাব্যগ্রন্থ )
সোনার কার্তুজ (কাব্যগ্রন্থ )
রৌদ্রবঞ্চিত লোক (মুক্তগদ্য)
ব্যবহারিক বিস্ময় (কাব্যগ্রন্থ)
দুর্ভিক্ষের রাতে (কাব্যগ্রন্থ)
কায়া ও কৌতুকী (কাব্যগ্রন্থ)
e-mail : kobi.shiblymoktadir@gmail.com
0 Comments