কোনো এক অদৃষ্টের কারণে রাজবিহারী দত্ত, নদীয়াবিহারী দত্ত ও রসিকবিহারী দত্ত এই তিন ছেলে অকালে মারা গেল। তাদের মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে স্ত্রী শ্রীমতি গুণময়দেবীও অসময়ে পরোলোকগমন করেন। অর্থাৎ পূর্ণ ঘর শূন্যের কোঠায় চলে এলো। বাকি থাকল ছেলে বিপিনবিহারী দত্ত। বলছিলাম মরমি বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্তের কথা। অকালে স্ত্রী ও পুত্রদের পরলোকগমনে কবি রাধারমণ দত্ত সংসারজীবন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন। ‘রাধারমণ কৈশোর থেকেই তত্ত্বজিজ্ঞাসু ছিলেন। ঈশ্বরলাভের পদ্ধতি জানার জন্য তিনি বিভিন্ন সাধকের উপদেশ পালন করেছেন। শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব বিভিন্ন মতবাদ অধ্যয়ন করেছেন কিন্তু তাঁর প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজে পান নি।’ ১
তারপর ১২৯০ বঙ্গাবব্দে ৫০ বছর বয়সে হৃদকমলের তৃষ্ণা মিটাতে কবি ছুটে যান মৌলভীবাজার জেলাধীন ঢেউপাশা গ্রামে। সেই গ্রামে বাস করতেন বৈষ্ণব সহজিয়া ধর্মের রাগানুগা মার্গের পরমভক্ত শ্রী তিলক চন্দ্র গোস্বামীর শিষ্য শ্রী রঘুনাথ বিপ্রভট্ট গোস্বামী (সাধক রঘুনাথ ভট্টাচার্য)। শ্রীশ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ শ্রীরূপ গোস্বামীর সিদ্ধ প্রণালীর দ্বাদশতম গুরুদেব শ্রী রঘুনাথ বিপ্রভট্ট গোস্বামী। তাঁর কাছে দীক্ষিত হন রাধারমণ। শুরু হয় কবির বৈরাগ্যজীবন। আরম্ভ করেন সাধনা।গৃহত্যাগ করে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরের পাশে একটি আশ্রম তৈরি করেন তিনি। এখানে চলে তাঁর প্রেমভক্তি মার্গের সাধন-ভজন।‘কবির পুরো নাম শ্রীরাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ। জন্মগ্রহণ করে ঐতিহ্যমণ্ডিতসুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলাধীন কেশবপুর গ্রামে ১২৪০ বঙ্গাব্দে বা ১৮৩৩খ্রি.। তাঁর পিতার নাম শ্রীরাধামাধব দত্ত পুরকায়স্থ ও তার মাতার নাম শ্রীমতি সুবর্ণা দেবী। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। নিজের জন্মস্থান কেশবপুরে এই মহান কবি পরলোকগমন করে প্রায় ৮২ বছর বয়সে ২৬ কার্তিক, ১৩২২ বঙ্গাব্দে ১৯১৬ খ্রি.। মৃত্যুর পর কেশবপুরেই তাঁর মরদেহ দাহ করা হয়, সেখানে ‘রাধারমণের সমাধি মন্দির’ রয়েছে।
তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা করেছেন। কবির বাবা রাধামাধব দত্ত পুরকায়স্থ একজন কবি ও অনুবাদক ছিলেন। ‘কৃষ্ণ লীলার কাব্য’ ‘পদ্মপুরাণ’ ‘সূর্য্যব্রত পাঁচালী’ ‘গোবিন্দ ভোগের গান’ প্রভৃতি তাঁর লেখা। রাধারমণের শৈশবে তাঁর
পিতা পরলোকগমন করলেও বাবার কাছ থেকে কবিতা প্রতিভা ঠিকই পেয়েছিলেন। তাই তো দেখা যায় কবিপিতার কবিপুত্র সকলকে জয় করেছেন হাজারো গান সৃষ্টির মাঝে। কবি রাধারমণ ছিলেন একজন সাধক কবি। প্রায় ৩২ বছর তিনি সাধনা করেছেন। গানগুলো এই সময়েই রচিত। তিনি বৈষ্ণব কবি নামে সমধিক পরিচিত।’২
॥ দুই ॥
মূলত কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হবার পরপরই রাধারমণের জীবনদর্শন পুরোপুরি পাল্টে যায়। শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সাধনতত্ত্বে আত্মসমর্পণ করেছিলেন শ্রীরাধারমণ দত্ত। তিনি তাঁর গানের মাঝে ব্রজভাব, রসবোধ ও পরমানন্দবস্তুকে খোঁজে ফিরেছেন। পেতে চেয়েছেন আরাধ্যবস্তুকে। কী ছিল তাঁর আরাধ্য বস্তু। তাঁর সাধন ও ভজনতত্ত্বে একমাত্র
কৃষ্ণপ্রেমই ছিল আরাধ্য বস্তু। তাহলে তাঁর মার্গটি কী ছিল। ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম সম্প্রদায় প্রবর্তক চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) পিতৃভূমি সিলেট। বৈষ্ণব ধর্মের অনেক প্রাণপুরুষ এবং চৈতন্য পারিষদ অনেকেই সিলেটের অধিবাসী ছিলেন। ফলে সিলেটে বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব খুব বেশি। চৈতন্যদেবের সমকালে স্বরূপ দামোদর ও রায় রামানন্দ চৈতন্য প্রবর্তিত রাগাত্মিকা ভক্তিধর্মের সাধ্যসাধনতত্ত্ব সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তাঁর তিরোধানের পর বৌদ্ধ, শাক্ত শৈবধর্মের বুড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে বৈষ্ণব দেহবাদী সহজিয়া ধর্ম প্রবর্তিত হয়। সহজিয়া ধর্মে সমন্বয় ঘটেছে শাক্ত আচারের সঙ্গে বৈষ্ণব ও সহজিয়া বৌদ্ধ প্রভাবিত তত্ত্বের। এ সকল তত্ত্বের সমাহারে আনুষ্ঠানিক মিলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা ঘটে সহজিয়া বৈষ্ণব মতবাদের। সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের আদি পুরুষদের মধ্যে যাঁরা পদাবলি রচনায় সিদ্ধহস্ত তাঁরা হলেন- বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, স্বরূপ দামোদর, রায় রামানন্দ, রঘুনাথ গোস্বামী, কৃষ্ণদাস গোস্বামী, গোপাল ক্ষত্রিয়, বিষ্ণু দাস, রাধাকৃষ্ণ চক্রবর্তী, গোবিন্দ অধিকারী, সিদ্ধ মুকুন্দদেব প্রমুখ।
সহজ মানুষ হইবার সাধনা দুরূহ। সামান্য মানুষ সর্বত্রই আছে। কিন্তু সহজ মানুষ চৌদ্দ ভুবনের কোথাও নেই, তাহাকে গড়িয়া নিতে হয়। গড়িতে হয় কিভাবে ? তাহা হয় রাগানুগা ভজনে। এই ভজনের একটি ক্রম বর্তমান। এই ক্রমের প্রথমটি প্রবর্ত অবস্থা। প্রবর্ত অবস্থায় প্রথমে নামকে আশ্রয় করিয়া সাধনা চলে। তখন গুরুর আজ্ঞাপালন এবং অকৈতব কৃষ্ণপ্রেম; সাধুসঙ্গ করিয়া চলিতে হয়, দ্বিতীয় অবস্থা সাধক অবস্থা। এ সময় আশ্রয়ভাব। তৃতীয় অবস্থা সিদ্ধ অবস্থা। ইহার দুইটি আশ্রয়; একটি প্রেম, অপরটি রস। প্রবর্ত অবস্থায় ইন্দ্রিয় সংযম ও শৌচাদি আচরণপূর্বক গুরুর নিকট হইতে নাম প্রাপ্ত হইয়া নাম এবং নামীয় অভেদজ্ঞানপূর্বক তাহা অনুক্ষণ জপ করিতে করিতে অন্তর ও দেহের কলুষ নিবারিত হয় ও সাত্ত্বিক বিকারাদির উদয় হইয়া থাকে।... সাধক অবস্থায় ভাবই আশ্রয়। এই অবস্থায় কামজয় একান্ত আবশ্যক। যখন কাম নিজের বশীভূত তখন নিজের ভাব অনুসারে নায়িকা গ্রহণ করিতে হয়। সাধক অবস্থায় নিজেকে প্রকৃতি মনে করিতে হয়। কিন্তু সিদ্ধাবস্থায় নিজের প্রকৃতি ভাব সম্পন্ন হইয়া যায়, যাহার ফলে প্রেম সাধনায় অগ্রসর হইবার পথ খুলিয়া যায়। (গোপীনাথ কবিরাজ, ভূমিকা চৈতন্যোত্তর চারিটি সহজিয়া পুথি, পরিতোষ দাস।) সহজিয়া বৈষ্ণব মতবাদ সম্পর্কে যে সকল লক্ষণের কথা বলা হয়েছে তার প্রায় সব লক্ষণই রাধারমণের গীতিকবিতায় পরিলক্ষিত হয়। তিনি পৈতৃকসূত্রে বৈষ্ণব সহজিয়া ধর্মের প্রতি অনুরক্ত। তাঁর তত্ত্বজিজ্ঞাসার উত্তর যাঁর কাছ থেকে তিনি লাভ করেন, তিনি তাঁর পরমগুরুদেব শ্রীরঘুনাথ গোস্বামী। রঘুনাথ সহজিয়া মতের একজন উচ্চাঙ্গের সাধক ছিলেন। তাঁর বংশধরগণ এখনও দীক্ষাদান করে থাকেন। দীক্ষাগ্রহণের পর সংগত কারণেই গুরুদত্ত প্রণালী মতেই শিষ্যের সাধনভজন করার কথা এবং রাধারমণ তাই করেছিলেন।৩
‘মরমি সাধকেরা বলেন, তিনি যে তোমার প্রাণসখা, তাঁকে পেতে হলে তোমার দেহের ভিতরকার গোপন কোঠায় তাকে অন্বেষণ কর। মানবদেহে সৃষ্টির কোন অজানা রহস্য লুকান আছে, তার উদ্ঘাটনের জন্য মরমি কবির চিত্ত সতত উদগ্রীব। মরমি গানের জন্ম যে মানস ক্ষেত্রে তা সাধারণ কবি-মানস নয়। দীর্ঘকালের ভজন সাধন দ্বারা পূত, সমৃদ্ধ না হলে তার অন্তর নিঃসৃত ক্ষীরধারা যুগ যুগ ধরে মানব মনের চিরন্তন পিপাসা নিবারণ করতে সমর্থ হয় না। ৪
তাই তো এই মাটির দেহের মাঝে রাধারমণ সচ্চিদানন্দবস্তুকে অনন্যভক্তি যোগে পেতে চেয়েছেন। তিনি গেয়েছে-
‘দেহের মাঝে আছে রে গোলক বৃন্দাবন
দেহের বাতি জ্বালাইয়ে দেখ রে যোগল মিলন।’
এই যে যোগল মিলন এখানেই তো ভক্তের আনন্দ রসের উৎস স্থল।
‘আনন্দাদ্ব্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে,
আনন্দেন জাতানি জীবন্তি, আনন্দং
প্রয়ন্ত্যভিসং বিশন্তি’
উপনিষদের এই বাণীকে রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন এবং নানা জায়গায় এর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণও করেছেন। আনন্দ থেকেই ভূত সকল জন্মগ্রহণ করে, আনন্দের সঙ্গেই তারা জীবন যাপন করে এবং আনন্দের অভিমুখেই তারা প্রবেশ করে। এই আনন্দবাদ কিন্তু যবফড়হরংস বা সুখবাদ নয়। সুখ অগভীর এবং আমাদের বস্তুগত জীবনের ব্যাপার। আনন্দ গভীর এবং ইন্দ্রিয়গম্য সকল কিছুর ঊর্ধ্বে আনন্দের জগৎ। দুঃখ, বিরহ ইত্যাদি আনন্দের অন্তরায় নয়। সুখই- আনন্দেরই অন্তরায়। সুখে মানুষ আত্মহারা ও চঞ্চল হয় এবং অধিকতর সুখের লোভে বস্তুর পিছনে ছোটে। দুঃখেই- মানুষের আত্মসমাহিত ও আত্মোপলব্ধি ঘটে। দুঃখেই আমরা নিজেকে গভীরভাবে পাই।’৫
রাধারমণ তাঁর আনন্দরস আস্বাদন করেছেন দয়াল গুরুভজনে। অন্তরের গহীনে ভাবাবেশে অন্তরদৃষ্টি উন্মিলণের মাধ্যমে তিনি গেয়ে ওঠেন-
দয়াল বিনে বন্ধু কেহ নাই রে এ সংসারে
দয়াল বন্ধু কৃপাসিন্ধু বিপদভঞ্জন মূলাধার।
...ভাইবে রাধারমণ বলে মানবজনম যায় বিফলে
ঘাটে বান্ধা শমণতরী নাই আশা তরিবার।
সত্ত্ব: রজ: ও তম: গুণের এই যে মায়াময় সংসার তার নাগপাশ থেকে কবে মুক্ত হবে কবে গুরুর চরণ লাভ করবে এই আশাতেই বসে আছেন। ‘সদগুরুর কাছে দীক্ষিত না হয়ে কেউ মহাভাব বা ‘সহজ’ এর অধিকারী হতে পারে না। কেবল রাধাকৃষ্ণ রূপকের মধ্যে (তথা পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্বের মধ্যে) যারা সাধন-ভজন আবদ্ধ রেখেছে তারাই বৈষ্ণব সহজিয়া।’৬ ‘বৈষ্ণব সহজিয়া’ ধর্ম অবলম্বন করে রাধারমণ আত্মজ্ঞান লাভ করতে চেয়েছেন। আত্মজ্ঞান বিনে সব সাধনাই অসম্পূর্ণ। তা তিনি মরমে মরমে উপলব্ধি করেছেন। গুরুতত্ত্বের মাঝেই জীবের আত্মতত্ত্ব লুকিয়ে আছে। আত্মতত্ত্বেই আত্মজ্ঞান মিলে।
॥ তিন ॥
‘রসতত্ত্বের নিরিখে সংস্কৃত পণ্ডিতগণ রসের সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যং’। এখানে ‘রস’ শব্দটির অর্থ আস্বাদন। তাই যাকিছু আস্বাদন করা যায়, তাঁকে ‘রস’ বলা হয়। সত্য সুন্দর অনুভূতি সম্পন্ন নির্ভেজাল আনন্দঘন মানসিক অবস্থাকে ‘রস’ বলা হয়ে থাকে।’৭
সাধক রাধারমণ তাঁর অসংখ্য গানের মাঝে সেই পরমরস আস্বাদন করতে চেয়েছেন। বৈষ্ণবভাব ধারায় তিনি ব্রজভাবসাগরে ডুব দিয়েছেন সাধ্য বস্তু লাভে। সাধ্য বস্তুটা কি? কৃষ্ণপ্রেমই জীবের একমাত্র সাধ্য বস্তু। সেই কৃষ্ণপ্রেম কোথায় মিলে ?
রাধাতত্ত্বে অর্থাৎ হ্লাদিনীতত্ত্বে সেই পরমবস্তু কৃষ্ণ প্রেম লুকিয়ে আছে। তাই তো রাধারমণ গেয়েছেন-
‘ভোমর কইও গিয়া
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদে রাধার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া।’
‘তত্ত্ব চিন্তা মানুষকে তিনটে মার্গের সন্ধান দিয়েছেন। জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তিমার্গ। জ্ঞানবাদ আস্তিক্য, নাস্তিক্য ও সংশয় প্রবণ দর্শনের জন্ম দিয়েছে। কর্মবাদ সমাজ ধর্ম ও রাষ্ট্র বিধি গড়ে তুলেছে আর ভক্তিবাদ হয়েছে নিষ্ঠা ও বৈরাগ্যের উৎস। এবং ভক্তিবাদের উপজাত কিংবা পরিণতি হচ্ছে প্রেমবাদ।’৮
তিনি বৈষ্ণব দর্শনে দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে অনন্যচিত্তে সাধন করেছেন। ভক্তিমার্গে বা রাগানুগামার্গে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন পরমজ্ঞানে। ভাবরসে আস্বাদন করেছেন কৃষ্ণপ্রেমরস। নিজেকে সমর্পণ করেছেন নিষ্ঠারতিতে। ‘আত্মসমর্পণ পরমাত্মার সমীপেই সম্ভব। অংশের কাছে অংশতঃ সমর্পণ হইতে পারে। পূর্ণাঙ্গ সমর্পণ একমাত্র পূর্ণতম বিগ্রহ লীলাপুরুষোত্তমের নিকট সম্ভব হইতে পারে। অতএব সর্ব্বতোভাবে আত্মদানের পাত্রটি একমাত্র ব্রজরাজনন্দন ছাড়া আর কেহ হইতে পারে না।’৯
‘রাধারমণ বিশ্বাস করতেন যে ‘সুধামাখা গুরু নামে ভবক্ষুধা যাবে দূরে।’ গুরুপদে আশ্রয় গ্রহণ করে কেবল তিনি একাই ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভ কামনা করেননি। সহজিয়া মতবাদ অনুযায়ী (যা মহাযানী বৌদ্ধ দর্শনেও আছে) তিনি সকল জীবের মুক্তিলাভ কামনা করেছেন। তাই তিনি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন-
মজ সবে গুরু নামে তারি কাজে তারি নামে
তারি কাজে তারি প্রেমে তারি পদে শরণ নিয়ে
প্রেমানন্দে ভাস না রে।১০
‘নিত্য প্রেমের পুষ্পবনে সঙ্গোপনে যে কুসুমকলি প্রস্ফুটিত হয়েছে সে ফুল কখনও বাসি হয় না। অনুরাগের বাতি জ্বললে রসের সমুদ্রে শুকনায় সাঁতার কাটা যায়। এজন্য গুরুবাক্য সম্বল। গুরুশিষ্য একাত্ম হলে নিত্যলোকে যাওয়া সম্ভবপর। গুরুবাক্য অবলম্বনে সাধনা করে নিজেকে জানতে হবে। আপন চিত্তলোকে সচ্চিদানন্দ অনুভব করতে হবে। দেহে কে বিরাজ করছেন তাঁকে দর্শন করতে হবে। তাঁর স্বরূপ উপলব্ধি করতে হবে। রাধারমণ আক্ষেপ করে বলেছেন-
‘দেহার মাজে গুরু থইয়া শিষ্য হইলায় কার।’
আত্মদর্শনই বড় দর্শন। আগে নিজেকে জানতে হবে। অধরাকে ধরার এটাই কৌশল। এর মর্ম জানে রসিকজন।১১
তাইতো রাধারমণ প্রেমভক্তিমার্গে গেয়ে ওঠেন-
‘কি হেরিলাম প্রাণসখী
শ্যামরূপে ধিকিধিকি
রূপের কথা বলব কত
বিজুলি চটকের মত
দাঁড়াইয়াছে কদম্বতলায়।’
ভক্তিমার্গে তটস্ত হয়ে বিচার করলে দেখা যায় রাধারমণ ছিলেন ব্রজরসের ভক্ত। যুগলভজনের মাধ্যমে সেই পরম ব্রজরস আস্বাদন করেছেন তিনি। রাগাত্মিকা ভক্তিভাবে সাধন-ভজন করেছেন। রাধারমণের ভাবের ‘রস’ বস্তুটি ছিল আনন্দঘন। সেই আনন্দসরোবরে রাধারমণ ধ্যানমগ্ন হয়ে অর্জন করেছেন ভক্তি প্রেমরস।
তথ্যপঞ্জি
১. রাধারমণ গীতিমালা-সংগ্রহ ও সম্পাদনা-নন্দলাল শর্মা, অমর একুশে বইমেলা-২০১৪ পৃষ্ঠা-০৮
২. মরমি কবি রাধারমণের গান ও জীবন- সংগ্রহ ও সম্পাদনা-অমলেন্দু কুমার দাশ, ড. মোহাম্মদ আলী
খান- মরমি কবি রাধারমণ দত্ত, পৃষ্ঠা-৫৭
৩. রাধারমণ গীতিমালা-সংগ্রহ ও সম্পাদনা-নন্দলাল শর্মা, অমর একুশে বইমেলা-২০১৪ পৃষ্ঠা- ১৯-২০
৪. বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্য (দ্বিতীয় খণ্ড) সম্পাদনা শামসুজ্জামান খান, বাংলা একাডেমি,ঢাকা,
মুহম্মদ বরকতুল্লাহ-মরমি গান,পৃষ্ঠা-৮১
৫. শিল্প ও নন্দনতত্ত্ব, সম্পাদনা-ড. প্রদীপ কুমার নন্দী, অবসর প্রকাশনা, ফেব্রুয়ারি-২০১৪, সিতাংশু
রায়- আনন্দতত্ত্ব, পৃষ্ঠা-৩২৮
৬. বাউলতত্ত্ব, আহমদ শরীফ, বাঙলা একাডেমী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩, পৃষ্ঠা-৪৯
৭. শিল্প ও নন্দনতত্ত্ব, সম্পাদনা-ড. প্রদীপ কুমার নন্দী, অবসর প্রকাশনা, ফেব্রুয়ারি-২০১৪, ড.
মাফরুহা হোসেন সেঁজুতি, নজরুল সংগীতে ‘ভাব ও রস’ পৃষ্ঠা-৫১৩
৮. বাউলতত্ত্ব, আহমদ শরীফ, বাঙলা একাডেমী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩, পৃষ্ঠা-৫২-৫৩
৯. গৌর-কথা (অখণ্ড) ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, সাধ্যতত্ত্ব (গ) পৃষ্ঠা-৬৩
১০. রাধারমণ গীতিমালা-সংগ্রহ ও সম্পাদনা-নন্দলাল শর্মা, অমর একুশে বইমেলা-২০১৪ পৃষ্ঠা-২১
১১. রাধারমণ গীতিমালা-সংগ্রহ ও সম্পাদনা-নন্দলাল শর্মা, অমর একুশে বইমেলা-২০১৪ পৃষ্ঠা-২৪-২৫
মানিকরতন শর্মার আরো লেখা পড়ুন।
0 Comments