ডাইনিং হলের সিঁড়িতে দুই ধাপ নামতেই থমকে গেল অনিতা। হাতে ধরা স্টীলের প্লেট-গ্লাস, দৃষ্টি সিঁড়ির শেষে। সেখানে এক নবপরিণীতাকে ঘিরে মেয়েদের জটলায় উচ্ছ্বাসের কলকল। মুখটা আনকোরা না? কই, পুজোর ছুটির আগে যে মাসখানেক হোস্টেলে ছিল অনিতা তখন তো একে দেখতে পায়নি! নাকি ছিল, কিন্তু চোখে পড়েনি? ধুর! তা হয় নাকি? মাত্র শ’দেড়েক বোর্ডার। নামেই কর্মজীবি মহিলা হোস্টেল। অধিকাংশ নিবাসীই ছাত্রী। তাও আবার ইন্টারের। তবে একই ক্লাসের ছাত্রী বলে যে সবাই সবাইকে চিনবেই অনিতাদের কলেজ অত ছোট নয়। কিন্তু এই কর্মজীবি হোস্টেলে যে কটা ইন্টারের মেয়ে থাকে তাদের একে অপরকে না চেনার কোনই কারণ নেই। সরকারি মহিলা কলেজটা কর্মজীবি মহিলা হোস্টেলের অদূরেই। সেখানে উচ্চমাধ্যমিকের আসন সংখ্যা কলা-বিজ্ঞান মিলিয়ে শ’বারো। কিন্তু কলেজ হোস্টেলে কুল্যে আসন আড়াইশ’। ডাবলিং-ফ্লোরিং, গণরুমে গাদাগাদি, সব করেও ওখানে তিন-সাড়ে তিনশ’র উপর ঠাঁই হয় না। তারও আবার এক বড় অংশ স্নাতকদের জন্য বরাদ্দ। কাজেই দূর-দূরান্ত থেকে আসা উচ্চমাধ্যমিকের মেয়েগুলো কলেজ হোস্টেলে আসন না পেলে এসে জোটে এই কর্মজীবি মহিলা হোস্টেলে।
তা হোস্টেল ফাঁকা রাখার চেয়ে ছাত্রী বোর্ডার দিয়ে ভরে রাখা তো সব দিক দিয়েই ভাল। মেয়েগুলো দিনমান কলকল করে। স্বাভাবিক নিয়মে নিঝুম থাকতে পারতো যে ভবন তা সারাদিনই কমবেশি গমগম করে। ‘কর্মজীবি হোস্টেল নিবাসী মেয়েরা পড়াশুনো করে না’- অভিভাবক মহলে রটনা। ‘যা কিছু রটে কিছু না কিছু বটে’- ‘বটে’ এটুকু যে মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে আসা মেয়েটা এখান থেকে বের হয় একটা সেকেন্ড এমন কি থার্ড ডিভিশন নিয়ে। দুম করে ফেল করে বসাও বিচিত্র নয়। অমন দুর্ঘটনা প্রতি বছরই কয়েকটা করে ঘটে। কাজেই হোস্টেল সুপার মিনতিদি কচি কচি মেয়েগুলোকে গুলতানি মারতে দেখলে চোখ পাকিয়ে তাকান, কখনো পুরুষালি কণ্ঠে পিলে চমকানি ধমকও দেন। স্বভাবের নিয়মে তবু মেয়েরা খিলখিলিয়ে হাসে, একে অপরকে নিয়ে রঙ-রসিকতায় মাতে। তাদের জীবনে রসিকতা করার মতো রসাল ঘটনার অভাব নেই, কমতি নেই রসবোধেরও। ষোড়শী-অষ্টাদশী সব কন্যা। অধিকাংশের কাছেই জীবন রঙধনুর মতই দিগন্ত বিস্তারি, প্রজাপতির পাখার চেয়েও হালকা-কোমল, দখিনা বাতাসের মতই মসৃণ গতিময়। কারও কারও অবশ্য এরই মধ্যে জীবনের কর্কশতা, পথের বন্ধুরতার সাথে পরিচয় ঘটে গেছে, তবু হতাশার ক্রুর গহ্বর তাদেরকে স্থায়ীভাবে জঠরে আটকে রাখতে পারে নি। বয়সের স্বাভাবিক নিয়মে তারা সব ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াতে চায়, উঠে দাঁড়ায়। জীবনটাকে সাজাতে সম্ভবনাময় সব আগামীকে চ্যালেঞ্জ করতে তারা প্রস্তুত। তাই তাদের চোখে-মুখে সবসময় খেলা করে দারুণ আত্মপ্রত্যয়ভরা চাপা কৌতুক। হোস্টেল সুপার মিনতিদির কাছে এসবই বয়সের বদমায়েশি।
এই হোস্টেলেই আবার আছে সুদীপাদি, আশাদি, মনোয়ারা আপুরা। কর্মজীবি এই আপা-দিদিরা সংখ্যায় অল্প। তবু কোন অদৃশ্য সমীহ, নাকি ভয়ের চাপে ছাত্রী মেয়েগুলো সন্ধ্যার পর একদম চুপচাপ হয়ে যায়। সারাদিন খাটাখাটনি। সন্ধ্যায় হোস্টেলে ফেরা। মাস শেষে বেতনের টাকার এক বড় অংশ নানাজনের বরাদ্দ বাবদ পাঠানো। কারো চাকরি ‘এই আছে এই নেই’ টেনশন, কারোবা পদোন্নতির পথে জটিলতা। এহেন আপা-দিদিদের ক্লান্তি ভাসা মুখ, আর বিরক্তি মাখা চোখের দিকে চেয়ে ছাত্রী মেয়েরা চোখ নত করে। নিজেদের জীবনে অমন ভবিষ্যত? উহু, এটা তারা আজ কল্পনা করে না। বরং তারা কল্পনা করে সেই ক্ষণ- যখন তাদের বিয়ে হবে কাক্সিক্ষত পুরুষের সাথে, কিংবা দয়িতকে পাবে- একান্ত করে।
ওদের সবার জীবনে দয়িত আসেনি। কারো এসেছে, কারো আসি আসি করছে। যাদের এসেছে তারা আকাশে উড়ছে। যাদের আসি আসি তারা বাতাসে ভাসছে। আর যাদের এখনো আসেনি তারা আকাক্সক্ষাভরে অন্যদের ওড়াউড়ি দেখছে।
অনিতাও তাই দেখেছে এতদিন। দেখেছে সাদা চোখে, বাড়তি কৌতূহল না লাগিয়ে। কিন্তু আজ কি সে ভিন্নরকম কিছু দেখলো?
কেন যেন অনিতার মনে হলো আজ- এই স্যাঁতসেঁতে নোনা ধরা বিষণ্ন হোস্টেলভবন, যৌবন পড়পড় বিমর্ষ চেহারার ঐ কর্মজীবি নারীর দল, বদমেজাজি হোস্টেল সুপার, এমনকি সারাদিন তেতেপুড়ে ঘাম জবজব চেহারা নিয়ে থাকা বাবুর্চিখালা ও তারা র্দুমুখ সহকারীগুলো পর্যন্ত কাল থেকে অন্যরকম হয়ে উঠবে। পুজোর ছুটির আগের হোস্টেলবাস, আর আগামী দিনের বাসে ঘটবে বহু ব্যবধান।
আসলে সবাই থাকে আগেরই মতো, বদলে যায় শুধু অনিতা। আর জগতের সব প্রেমে ডোবা মানুষ যেমন ভাবে , পৃথিবীটাকে যে চোখে দেখে, ঠিক তেমনই হয় অনিতার। হোস্টেলের পিছনে বহুকাল ধরে গাদা করে রাখা ছাইগাদার উপরে সে ফুটে থাকতে দেখে কোন নাম না জানা ফুল। আর হোস্টেলের সামনের একচিলতে এতকালের হতশ্রী বাগান- সে তো এখন নন্দন কানন। জবরদখল করে থাকা আগাছাদের ভীড়েও যে ওখানে এত রকম ফুলের গাছ আছে তা কি আর এত দিন চোখে পড়েছে! কে বলে জানালার অপ্রতুলতার দরুন হোস্টেল ভবনে বাতাস ঢোকে না? নারীজাতের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানে জানালার বদলে যে ঘুলঘুলি, তা দিয়ে বাতাস তো কিছু কম আসে না। কী মিঠে সে বাতাস! আর কে বলে হোস্টেলসুপারের চেহারাটা খাণ্ডারনী! বসন্তের দাগভরা কালো মুখটাতে আরো বেশি কালচে পুরু কুচকানো ঠোঁট আর লালচে বড় বড় ঘুমজাগা চোখ অনিতার চোখে তো এখন মোটেই খারাপ দেখায় না। বরং মিনতিদির একমাত্র ছেলে ক’বছর আগে নাকি গাড়িচাপায় মারা গিয়েছিল, আর তার স্বামী নাকি মারা গেছে ছেলেটা পেটে থাকতেই; এসব খবর তার দুর্ব্যবহারটাকেও কেমন সহনীয় করে দেয়।
দিন যায়। ওরা কাছাকাছি আসে। ওরা গল্প করে। ওদের জীবনের গল্প। কতটুকু তাদের জীবন? নাহ্, একেবারে ছোট নয়। আঠারো বছর। সুকান্তের সেই কবিতার মতো না হোক, ওরাও ধরে কিছু স্বকীয় জোর। আর সেই জোরেই ওরা একে অপরের হাত ধরে। আর ধরে রাখে, শত বিপত্তির সম্ভাবনা সত্বেও।
ওরা হাসে। ওরা কাঁদে। নিজেদের গল্প বলে নিজেরাই হাসে-কাঁদে। মনিকা বলে ওর বাসর রাতের গল্প। লোকটা কিভাবে তাকে চেপে ধরেছিল কোন সম্ভাষণ ছাড়াই। অনিতা বলে ওর সেই দাদাবাবুর কথা যে ওকে খুব ব্যথা দিয়েছিল নয় বছর বয়সে। আবার সেই ছেলেটার কথাও বলে যে ওকে চিঠি লিখেছিল, গায়ে ফুল ছুঁড়ে মেরেছিল, হাস্নাহেনা ঝোপের আড়ালে টেনে নিয়েছিল, শত চেষ্টাতেও অনিতা ‘লাভ য়্যু’ বলেনি বলে সে নিজের হাত চিরে জোর করে ওকে রক্ত সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিল।
মনিকা বলে, তাহলে তো সেই ছেলেটার সাথে তোমার বিয়েই হয়ে গেল।
অনিতা বলে, ধুর!
মনিকা একটা দীর্ঘশ^াস চেপে যায়। সে দেখতে যথেষ্ট সুশ্রী। অথচ আজ অবধি কেউ তাকে ‘লাভ য়্যু’ বলেনি। আর জোর করে কিছু করার চেষ্টা! নাহ্, স্বামী ছাড়া কেউ কখনো তার পরে জোর খাটায়নি। গ্রামের সব ছেলেরাই যেন ছিল মনিকার দাদা কিংবা দাদাবাবু। মনিকার দিদি কণিকা বয়সে মনিকার চেয়ে ছয় বছরের বড় এবং দাদা চার বছরের। দিদিটা যাকে বলে ডাকসাইটে সুন্দরী। তার সৌন্দর্যের পাশে ছোটখাটো মনিকা অনেকটাই ম্লান। তাই রোমিওদের দিল চিরকাল দিদির জন্যই ধাড়কান করেছে। মনিকা তাদের চোখে ছিল নেহাতই পুঁচকে মেয়ে। আবার মনিকার হাবভাব চালচলনে এমন একটা কিছু ছিল যে তারা তাকে খানিকটা বিরক্তি ও স্নেহভরে ‘ইঁচড়েপাকা’ বলে প্রশ্রয় দিত। মনিকা চিরকাল দিদির প্রেমপিয়াসীদের ফুল আর চিঠি বয়েছে। মা কিংবা দাদার হাতে ধরা পড়ে মার খেয়েছে। কিন্তু নিজের জন্য তৃষ্ণার্ত কারো দেখা পায়নি।
দেখতে দেখতে এক বছর পেরিয়ে যায়। আবার কলেজে পুজোর ছুটি। দিন দশেকের জন্য উভয়ের ছাড়াছাড়ির সম্ভাবনা। অনিতা বলে, ছোড়দি, তুমি আমাদের বাড়ি চলো। আমাদের বাড়ির ঠাকুরদালানে যে পুজো হয় তা এখন বারোয়ারি হলেও জাঁকজমকে কলকাতার তুল্যি। তুমি গেলে দেখবে কী মজা! আমাদের কাছের-দূরের সব আত্মীয়-কুটুম্ব ঠাকুর দেখতে আসে, বাড়িতেই যেন মেলা বসে যায়।
মনিকা জানে যে অনিতাদের অবস্থা ভালো। পোশাক-আশাকে অনিতা সাধারণ হলেও ওরা যে বনেদি পরিবার তা ওর নানা কথায় জানা যায়। ওর দাদুর আমলেও ওদের বাড়িতে খুব ঘটা করে দূর্গা ও কালিপূজা হতো। দেশভাগের পরেও ওরা বহুবছর পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল। কিন্তু পরে নানা কারণে দূর্গাপূজাটাকে বারোয়ারি করতে হয়েছে। তবে কালিপূজা এখনো ওরা পারিবারিক একক আয়োজনেই করে,যদিও তাতে আর আগের মেজাজ নেই।
অনিতা বলে, কী হলো ছোড়দি, কিছু বলছো না যে? যাবে না আমাদের বাড়ি?
মনিকা হাসে। যেন ক্লিষ্ট সে হাসি। তারপর হাসি মুছে একটু গম্ভীরভাবে বলে, তোমার তো এখনো বিয়ে হয়নি মেজদি, হলে বুঝতে- বিয়ের পরে মেয়েদের নিজের ইচ্ছে বলে কিছু থাকতে নেই।
বুঝেছি। তোমার সাথে কথা বলে কিছু হবে না। রোসো, কাল শেখর দাদাবাবু এলে তাকেই বলবো।
না মেজদি। এ কাজ কোরো না। তোমার দাদাবাবু তোমাকে খুব সুনজরে দেখেন না।
কেন? তার সম্পদে আমি ভাগ বসাইছি নাকি?
তাতো খানিকটা বসাইছোই। আমার মন যে তাতে বসেনি তা সে বোঝে।
কী বললে ছোড়দি! সত্যি করে বলো তো তোমাদের মাঝে কী হয়েছে? সেদিন দাদাবাবু নিতে এলে তুমি যেতে চাইছিলে না। তারপর ফিরে এলে ফোলা চোখ নিয়ে। আমি জানতে চাইলে হেসে উড়িয়ে দিলে। তোমাদের ব্যক্তিগত বিষয় ভেবে আমি আর চাপাচাপি করিনি। কিন্তু আজ বলতেই হবে।
বলার কিছু নেই মেজদি। ও আমাকে সন্দেহ করে। আর সন্দেহটা তোমাকে নিয়ে।
হায় ভগবান!
ভগবানের নাম কোরো না মেজদি। ভগবানে আমার আস্থা নেই কারণ সেও পুরুষ।
মনিকার এ কথা অনিতা মানতে পারে না। ভগবান নারী-পুরুষ যেই হোক সে দয়াবান। দুঃখ-কষ্টে মানুষ তার নাম নেবে না!
মেজদি, তুমি ধর্ম-কর্ম মানো, গুরুর কাছে দীক্ষাও নিয়েছো। আমি ওসব নিয়ে ভাবি না। আমি কেবল ভাবি এই পুরুষ জাতটার ধর্ম নিয়ে। তুমি জানো আমার দিদি কতোটা রূপসী- তোমাকে ছবি দেখাইছি। যদিও ছবিতে দিদির আসল রূপের সিকিভাগও ফোটে না, তারপরও তুমি বলেছে যে তোমার জীবনে দেখা সেরা রূপবতী আমার দিদি। দিদি এখন ইন্ডিয়া আছে। ওখানেই বিয়ে হয়েছে। কিন্তু দিদি কেমন আছে, শুনবে?
তুমি বলেছিলে এক সফটওয়্যরি ইনজিনিয়ারের সাথে দিদির......
আমি এতদিন তাই জানতাম। দাদা আর বাবা মিলে দিদিকে ইনডিয়ায় রেখে এসেছিল সেজপিসিমার কাছে। কৃষ্ণনগরে পিসেমশাইয়ের বাড়ি। তার এক মাসতুতো বোনের ছেলের সাথে দিদির বিয়ে হয়- এত দিন এই জানতাম।
এখন কী জেনেছো?
দিদির স্বামী ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। একটা ফার্মের আন্ডারে থেকে বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের কাজ করে দেয়।
বলো কী!
আরো আছে। লোকটা দোবেলা দিদিকে পেটায়। টাকা চায়। বলে, বাংলাদেশের ‘শেয়াল-কুকুরে চাটা, শকুনে খাওয়া এঁটো পাত’ কি সে মাগনা মাথায় তুলে রাখবে?
তুমি কবে কার কাছ থেকে এটা জানলে? আর ‘এঁটো পাত’ মানে কী?
আমি কিভাবে জানলাম সেটা বড় কথা না। কথা হলো এসব জেনেও আমরা প্রচার করি যে দিদি ভালো আছে, মহাসুখে রাজরানী হয়ে আছে। আর এঁটো পাত বুঝলে না? মেজদি! তুমি না বাংলাদেশের মেয়ে?
বুঝেছি। অনিতা একটা দীর্ঘশ^াস ত্যাগ করে চুপ করে থাকে। মনিকা আপন মনে বলে চলে, আপনা মাসে হরিণা বৈরী- দিদিটার সৌন্দর্যই তার কাল ছিলো। দশ বছর বয়স থেকেই তার পায়ের তলায় প্রেমের উমেদারদের হৃদয় লুটোপুটি খেতো। চিঠি বয়ে নেয়ার শর্তে আমি কত যে লজেন্স পেতাম! অথচ কি জানো, যে রাতে দিদির সেই দুর্দশা ঘটলো, তার পরদিন থেকে আর কোনো প্রেমাস্পদের টিকির দেখাও মিললো না। এমনই সব নিমকহারাম!
কিন্তু দিদির বিয়েটা কেন এমন হলো? -জিজ্ঞেস করতে যেয়েও অনিতা থেমে যায়। এমন প্রশ্ন করা যে বোকামি তা সে বুঝতে পারে।
পুজোর ছুটি ফুরোয়। ওরা ফিরে আসে আবার হোস্টেলে। অনিতা বাড়ি থেকে অনেক রকম নাড়ু ও মিষ্টান্ন এনেছে। মনিকাকে সে সেগুলো খেতে দেয়। তারপর জিজ্ঞেস করে পুজো কেমন হলো, ছুটি কেমন কাটলো- এসব। মনিকা জবাব দেয় না। কী একটা পাঠ্য নাকি অপাঠ্য বই মুখের পড়ে ধরে পড়ে থাকে। অনিতা মনিকাকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে নাড়ু খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে। মনিকা কোনমতে একটা মুখে পুরে প্লেটটা ঠেলে সরিয়ে দেয়। তার এমন ভাবে অনিতা কিছু আশ্চর্য হয়। গেল বছর লক্ষ্মীপুজোর পরে অনিতার বাবা বাড়ি থেকে যে খাবার এনে দিয়েছিলো তার বেশিরভাগই মনিকা খেয়েছিলো। মনিকার অমন লোভীর মতো খাওয়া দেখে অনিতা যে কী খুশি হয়েছিলো! অকপট মেয়েটা প্লেট ভরে নাড়ু-মুড়কি খেতো আর বলতো, তোমাদের বাড়ির নাড়ুগুলো এতো ভালো বানায় কী করে মেজদি? নারকেল তিল সব এত পরিষ্কার সাদা বানাও কী করে? আর কী সুন্দর গন্ধ! সেই মেয়ে কিনা এবার......
আজ রাতে ডাইনিঙে দুজনের কেউই ভালো করে খেতে পারে না। অনিতার কেবলই মনে হয় মনিকা কী যেন একটা গোপনভার বুকে করে আছে। মনিকার বুকের অদৃশ্য ভার অনিতার বুকটাকেও ক্রমাগত ভারী করে তুলতে থাকে। এই এক বালাই- মনিকার মনে কষ্ট থাকলে সে কষ্ট অনিতাতেও সংক্রমিত হয়, আবার অনিতা দুঃখ পেলে তা মনিকার বুকেও বাজে। ওদের এই মিল-মহব্বত দেখে হোস্টেলে অনেকেই ওদের নাম দিয়েছে মানিক জোড়। কেউ আবার একটু বাড়াবাড়ি করে ডাকে জোড়া কইতর। তা ওরা যে যাই বলুক, কোন মানুষের একান্ত ব্যথা যদি আরেকজনের বুকে বেদনা হয়ে বাজে তবে তাদের সম্পর্কের নিশান যেমন দৃষ্টির অগোচর থাকে না, তেমনি সেই সম্পর্ক ক্ষীণ আয়ুষ্মানও হয় না। দেবতা নিক্ষেপিত ত্রিশূলই হোক, কি মানুষের ছুঁড়ে দেয়া কাদা, সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ নিতেই তখন সম্পর্ক প্রস্তুত থাকে। আর তাই কৌতূহলী মেয়েদের কৌতূহলকে বাড়িয়ে তোলার সুযোগ দিয়ে ওরা প্লেট ভর্তি ডালভাত এঁটো গামলায় ফেলে একে অপরের হাত ধরে ডাইনিং রুম ছেড়ে যায়।
ঘরে ঢুকে অনিতা সোজা দরজা বন্ধ করে দেয়। এ ঘরে অনিতা ছাড়াও আছে আরেকজন বোর্ডার সুতনুকাদি। সুতনুকা চাকরিজীবি। সে কারণে তার পুজোর ছুটি আরো সংক্ষিপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু এবার পুজোর ছুটির সাথে মাতৃত্ব ছুটি মিলিয়ে গ্রহন করায় তার ফিরতে আরো চার মাস (তখন মাতৃত্ব ছুটি ছিল চার মাস)। কাজেই আজ এ ঘরে তারা শুধুই দুজনা।
নির্জনতায় রহস্য থাকে। আবার নির্জনতা রহস্যযবনিকা উন্মোচন ঘটায়। নির্জনতা পুরাতন রহস্যের দ্বার খুলে নতুনেরে পথ দেখায়।
ওরা পথ দেখে। ওরা বিস্মিত হয়। ওরা চিনে নেয় ওদের জীবনের সব কানাগলি। ওরা জেনে নেয় ওদের মধ্যকার যা কিছু রহস্যময়। ওরা উপভোগ করে আপাত স্বাধীনতার আপাত আনন্দ।
মনিকার চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে চিরুণী করে দিতে দিতে অনিতা বলে, তোমার চুলগুলো কী মোলাম, ছোড়দি- ঠিক যেন এক গোছা রেশম! আর কী মিষ্টি গন্ধ- ইচ্ছে হয় সারাক্ষণ নাক ডুবায়ে রাখি।
অনিতার বুকের খাঁজে মুখ গুঁজে চোখ বুজে শুয়ে থেকে কিছু না বলে মনিকা শুধু এক চিলতে হাসে। অনিতা কখনো তার চুলে, কখনো পিঠে হাত বুলিয়ে চলে। কী মিষ্টি-নরম এই মেয়েটা! ঠিক যেন পাখির ছানা। অথচ এই নরম-কোমল শরীরের কোথায় যেন লুকায়ে আছে ভয়ানক রাগ ও জেদ। এ মেয়ের মনও বড্ড কঠিন। নইলে অমতে বিয়ে দিয়েছে বলে বিয়ের দিন এক ফোঁটাও না কেঁদে স্বামীর ঘর করতে গিয়ে দ্বিরাগমনে আর বাপের বাড়ি ফেরে না এমন ঘটনা ঘটে নাকি কোন হিন্দুর ঘরে! গত এক বছরে অনিতা মনিকাকে যেটুকু চিনেছে তাতে অনিতা এটা বোঝে যে এ মেয়ে বুকে পুষে আছে এক খন্ড তুষকাঠের আগুন।
হোস্টেল সুপার মিনতিদির কাছে এমন নালিশ অভিনব নয়। তার ছাব্বিশ বছরী চাকরি জীবনে তিনি এমন ঘটনা বেশ কয়েকটা শুনেছেন-বুঝেছেন এবং যুঝেছেন। যুদ্ধে সচরাচর তারই জয় হয় কারণ ওসব জুটিদের মনে নৈতিকতার জোর না থাকায় তারা মিনতিদির মুখের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। হোস্টেলে তাদের সিট কেটে দিলে তারা সে নালিশ বেশিদূর ছড়াতে বা উপরে তুলতে জোর পায় না। পাবে কী! ছেলেতে-মেয়েতে সম্পর্কই যেখানে বৈধতার সনদ ছাড়া মর্যাদা পায় না সেখানে মেয়েতে মেয়েতে সম্পর্ক!
তা ওরা কী এমন করে যা দেখে হোস্টেলের মেয়েরা তাদেরকে.........?
ওদের কথা, একের প্রতি অন্যের আচরণ- ওরা একে অপরের দিকে অপাঙ্গে তাকায়, চোরা কটাক্ষ বিনিময় হয়। ওরা হাসে- ফিসফিসিয়ে কী সব বলে নিজেদের মধ্যে হাসে। ওরা গান গায়- একের কোলে অন্যের মাথা রেখে মধুর সুরে গাওয়া গান। ওরা অনুক্ষণ যেন পুলকিত-শিহরিত। ওরা নির্জনতাপ্রিয়। ওরা ভিন্ন ভিন্ন কক্ষের নিবাসী হওয়া সত্ত্বেও এক কক্ষে রাত্রিবাস করে। ওরা.......
তা এক ঘরে রাত্রিবাস করলেই কি ইডা ধরি নিয়া যায় যে.......
আমাদের এখানে রাতে ঘুমানোর কিছু নিয়ম আছে। কোন নিবাসী নিজের রুম ছাড়া অন্য কোন রুমে ঘুমানো নিয়মের ব্যত্যয়।
উরা ভুল করছে। আমি উগারে বুঝায় কমুনে। উরা আর এমন করবিনানে।
আপনি ওদেরকে চেনেন না। আসলে কোন বাবাই এদেরকে চিনতে পারে না। ওরা আপনার সৎ পরামর্শ মনে নেবে না। তা নিলে আমারটাই নিত। আমি ওদেরকে এর আগে দুই বার ওয়ার্নিং দিয়েছি।
কী কন ম্যাডাম! এমুন হয়! এমুন হতি কেউ কুনোদিন শুনিছে!
আপনি কোন যুগের মানুষ নিতাই বাবু? এখন এসব আকছার ঘটছে। বিদেশে ওরা বিয়েও করছে।
রাম রাম! এ কোন ঘোর কলি!
কর্মজীবি মহিলা হোস্টেলে ওরা ওদের আসন হারায়। দুর্গন্ধের মতো বায়ুবাহিত হয়েই বুঝি কুকথারা ছড়িয়ে পড়ে। অনিতাকে তার বাবা বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে প্রহার করতে উদ্যত হলে বালবিধবা পিসী তাকে রক্ষা করে। কিন্তু মনিকাকে রক্ষায় তেমন কেউ না থাকায় স্বামীর হাতে তাকে নিগৃহীত হতে হয় বড় নির্মমভাবে। লোকটা স্ত্রীর প্রতি যে জঘন্য আচরণ করে তা গণধর্ষণকেও হার মানায়।
অনিতা সহজেই পরিবারের ক্ষমা পায়। সকল দেব-দেবীর নামে শপথ করে পুরো বিষয়টাকে অস্বীকার করায় তার বাবা-মা এটাকে ‘অমূলক অপবাদ’ বলে ধরে নেয়। কিন্তু ক্ষমা পায় না মনিকা। জামাইয়ের মুখে ঘটনার ফিরিস্তি শুনে তার বাপ-মা পারে তো নিজেদের গলাতেই দড়ি দেয়। একটা গণধর্ষিতা মেয়েকে তারা ভারতে পাঠিয়ে যেনতেন প্রকারে বিয়ের ব্যবস্থা করেছে, তাতে দুঃখ থাকলেও সেটা তাদের কাছে অচিন্তনীয় ছিল না। অমন ঘটনার সম্ভাবনা মাথায় রেখেই এদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা টলমল মনে তুলসীতলায় সন্ধ্যাদীপ জ¦ালে। অমন সম্ভাবনা আছে জেনেও এদেশের অগণিত মেয়ে দৃঢ়পায়ে পথ চলে। যখনকার কাহিনী তখন মোবাইল, এ্যাপস, ভাইরাল প্রভৃতি শব্দগুলো এদেশের গণজীবনের অংশ না হলেও গণধর্ষণ ছিল এবং সেসব হুমকি উপেক্ষা করে মেয়েরা গণহারে পথে বেরুতেও শুরু করেছিল। কাজেই মনিকার বাবা-মা কণিকার দুর্ভাগ্যের চেয়েও মনিকার কাণ্ডে বেশি বিস্মিত ও মর্মাহত হলো। মেয়ে যে এভাবে তাদের মুখে চুনকালি মাখাবে এ তাদের কাছে একেবারেই অভাবিত।
স্বামীর প্রচারের কল্যাণে মনিকার কেলেঙ্কারীর গল্পগাছা জানতে-শুনতে এলাকার কেউই বাদ থাকে না। সেসব গল্পের এমনই পাখা যে তা বাগেরহাটের কোন এক অখ্যাত গ্রাম ছাপিয়ে বিভাগীয় শহর খুলনার অতবড় কলেজটাতেও ছড়িয়ে পড়ে। কলেজের মেয়েরা তাদের নিয়ে পিছনে কানাঘুষা-ফিসফাস করে, কেউবা সামনেই ফিক করে হেসে দেয়। এদিকে তাদের আবাসন সঙ্কটও দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হতে থাকে। হোস্টেল থেকে বিতাড়িত মেয়ে দুটো মেস কিংবা বাসা কোনটাতেই দীর্ঘমেয়াদে টিকতে পারে না।
মনিকা তার স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স পায়। অনিতার বিয়ের প্রস্তাব আসে। ভেঙ্গে যায়। অনিতার বাবা মেয়েকে ভারতে পাঠাবার কথা ভাবতে থাকে।
মনিকা ও অনিতা পরস্পর নানা কৌশলে একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। দুপক্ষের পরিবার থেকেই আর কলেজে যাওয়ার পারমিশন নেই। শুধু পরীক্ষার সময় তারা পরীক্ষা দিতে যেতে পারবে এই শর্তে চলে যার যার ঘরে বসে পড়াশুনার নামে বই কোলে করে বসে থাকা।
এ পর্যায়ে অনিতাকে উদ্ধার করে তার এক দাদাবাবু। ভদ্রলোক অনিতার এক পিসতুতো দিদির স্বামী। দিদিটা মরেছে বছর দেড়েক আগে- প্রসবকালে। দাদাবাবু পিডাব্লুডির এনজিনিয়ার। বড় চাকুরে। কিন্তু সেসবের জন্য নয়। অনিতা মজে যায় তার পৌরুষদীপ্ত চেহারায়, নাকি ব্যক্তিত্বের টানে- কে জানে!
অনিতার তখন বরিশাল শহরে সাজানো-গোছানো জমাট সংসার জীবন। শিবতুল্য স্বামীর সোহাগ, দিদির রেখে যাওয়া ছেলের মুখে আধো আধো বুলি, উপচে পড়া সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য..... এরই মাঝে একদিন এসে উদয় হয় মনিকা।
অনি, কতদিন হয় তুমি আমাকে একটাও চিঠি লেখো না। আমি লিখলে তুমি হয়তো সে চিঠি হাতে পাবে না। তুমি কেমন আছো তা খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই চলে এলাম।
ভালো করেছো। তুমি বসো। বেশ গরম পড়েছে। এসিটা ছেড়ে দিই, কী বলো?
এসি! আচ্ছা দাও।
এই নাও রিমোট। তুমি টিভি দেখতে থাকো। আমি ওদিকে রান্নাটা একটু দেখিয়ে আসি। উনি আবার আমার হাতের মাঝের ঝোল ছাড়া মাছই খেতে চান না।
আচ্ছা।.....একটু শোন, অনি।
বলো।
উনি এই ছয়মাস আগেও তোমার হাতের রান্না ছাড়া দিব্যি বেঁচে ছিলেন। আজকের দিনেও রান্নায় তোমার ছোঁয়া না থাকলেও উনি একরকম চালিয়ে নেবেন। কিন্তু আমার কথাগুলো আমি বলার সময় বেশি পাবো না। বোধহয় আর ঘন্টাখানেক পরেই তোমার স্বামী খেতে আসবেন।
হ্যা, ওরকমই। সাইটে না গেলে দেড়-দুইটার দিকেই আসেন।
অনি, তুমি আমাকে একবারেই ভুলে গেছো। কিন্তু কী করে?
এ কেমন প্রশ্ন ছোড়দি? আমি তোমায় ভুলেছি কে বললো?
না, হয়তো সম্পূর্ণ ভোলোনি। শুধু শেষের দিনগুলো ভুলেছো। কী ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তায় ভরা গ্লানিময় সেসব দিন! অথচ কতই না মধুরতায় ভরা! আমরা একে অপরের হাত ধরলে অপমানের যন্ত্রণা ভুলে যেতাম। শেষদিকে তো কোন অপমান আমাদের গায়েই লাগতো না। আমাদেরকে তখন কেউ বাসাভাড়া দিতে চাইতো না। কিভাবে যেন শহরে রটে গিয়েছিল যে দুটো কলেজেপড়া মেয়ে স্বামী-স্ত্রীর মতো একসাথে.....আমরা এক মেস থেকে আরেক মেস, মেস থেকে এক কুঠুরীর বাসা, বাসা থেকে তাড়া খেয়ে ......
থামো ছোড়দি। এসব কথা এখন বলতে আছে? চারদিকে চাকর-বাকর। কে কখন.....
তোমার স্বামী আমাদের কথা জানে না অনি?
উনি বিয়ের আগেই শুনেছিলেন। ছিঃ ছিঃ! একদিন এ নিয়ে একটু রসিকতাও করেছিলেন। আমি লজ্জায়......ছিঃ!
তুমি আজ এটা নিয়ে এতো লজ্জিত! অথচ আমরা সেসব দিনে এর ছিটে-ফোঁটাও লজ্জা অনুভব করিনি। যদি করতাম তাহলে তাড়া খাওয়া কুকুরের মত আশ্রয় বদলে বেড়াতে পারতাম না।
ওসব আর মনে রেখো না ছোড়দি। আমার এখন সেসব ভাবতেও কেমন ভয় আর লজ্জা হয়।
লজ্জা আর লজ্জা! তোমার এখন সমস্ত ব্যাপারটাতেই বড় লজ্জা। এই যে আমি এখানে এসেছি তোমাকে একবার দেখবো বলে, নিশ্চয় তাতেও তোমার খুব লজ্জা হচ্ছে, তাই না?
সত্যি বললে তাতো হচ্ছেই। উনি ব্যাপারটা জানেন। এখন কিভাবে নেন.....!
তাহলে আমি উঠি। আমি চাইনা যে তোমার জীবনটা আমার মতো হোক। মনটাকে আর মানাতে পারছিলাম না, তাই এসেছিলাম, অনি। শুধু কৌতূহল তুমি কী করে আমাকে মুছে ফেলতে পারলে!
তোমাকে মুছবো কেন ছোড়দি? তবে কিছু বিষয় আছে যা সময়ের সাথে আপনি মুছে যায়। স্বামীর আন্তরিক ভালোবাসা পেলে......
থাক। আমাকে ওসব বোঝাতে এসো না। শুধু বলোতো, সেসব দিনে আমার কেন স্বামীর পুরুষালি
আদরের চেয়ে তোমার চাঁপাকলি হাতের পরশ ভালো লাগতো?
তুমি ভুল বুঝছো, ছোড়দি.....
ছোড়দি ছোড়দি কোরো না তো। আমরা এখন একে অন্যের নাম ধরে বলতে পারি। সেই স্নেহ, একান্ত আপন করে অনুভবের সেই সময়, আত্মীয়তা করে সম্বোধন- সেসব এখন আমাদের অতীত। আমরা এখন একে অপরের শুধুই পরিচিত।
ওরকম নির্দয়ভাবে ভেবো না, প্লিজ। তোমাকে আমি ভুলে গেছি এ তুমি কী করে ভাবছো? আমাদের সেই সব সুন্দর সময়, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সুখে-দুঃখে দুজন দুজনের হাত ধরে থাকার প্রতিজ্ঞা- সেসব কি ভুলবার?
তাহলে কী তোমাকে এমন পাল্টে দিলো অনিতা? কোন সে জাদু?
অদ্ভুত এক ব্রীড়াময় হাসি হেসে বললো অনিতা, জাদু আছে গো ছোড়দি। তোমাকে কী করে বোঝাবো জানি না......আমার মনে হয় তোমার স্বামী সোহাগ করতেই জানতো না। তাই তুমি বোঝই নি যে ওরা কেমন মাদকতাময়!
‘ওরা’!
ঐ হলো। আমি একজনকে দিয়েই বাকি সব প্রেমিকপুরুষদের চিনেছি। তুমি জানোই না যে ওরা কী আফিম খাওয়াতে পারে!
আফিম! আফিম কি আমাদের মাঝেও ছিল না অনিতা?
ছিলো। কিন্তু সমাজ আর পরিস্থিতির চাপে কিছু কিছু আফিম জল হয় মনিকা, হতে বাধ্য হয়। আফিম জিইয়ে থাকে আমাদের আস্থায় আর চর্চার মননে।
সদর দরজায় শব্দ হলো। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিয়ে অনিতা বললো, ঐ উনি এলেন। উঠলে কেন ছোড়দি? বসো। টেনশন নিও না, তোমাকে দেখে রাগ করবেন এতো সামান্য মানুষ উনি নন। আর ভয় পাওয়ার যে কিছু নেই সে আত্মবিশ^াসও তার আছে।
সে আমি বুঝেছি। তিনি যে মহান-সুযোগ্য পুরুষ তা আর বুঝতে বাকি নেই।
অনিতা দরজা খুলে দিলো। ঘরে ঢুকলো এক দীর্ঘদেহী পুরুষ। পৌরুষদীপ্ত চেহারায় বিজ্ঞতার ছাপ। এক পলক দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, মনিকা?
ছোটখাটো মনিকা যেন দুমড়ে-মুচড়ে এতোটুকু হয়ে যায় দেখে ভদ্রলোকের মনে কী যে মায়া হলো! ‘তোমরা কথা বলো, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি’ বলে তিনি ডুপ্লেক্স বাড়ির দোতলায় উঠে গেলেন।
হঠাৎই অনিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো মনিকা। তারপর হাসতে-হাসতে, কাঁদতে-কাঁদতে বলতে লাগলো, তোমার সৌভাগ্য মেজদি, তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী। তুমি খুব ভালো আছো, তুমি ভালো থাকবে। আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে! আমি জীবনে এমন কিছু হয়তো পাবো না, কিন্তু সে নিয়ে আমার আক্ষেপ নেই। সবার যে সব হবে জীবনে, তা তো নয়। শুধু একটা কথা মনে রেখো মেজদি, সমাজের মানুষেরা যেমনই ভাবুক, আমাদের ভালোবাসাতেও বন্ধুত্ব আর সাহচর্যের পাশাপাশি একে অপরের সুখ আর মঙ্গল কামনাই প্রধান ছিলো।
ঠিক তখন দোতলায় বেডরুমের এটাচ্ড্ বাথরুমে নিজেকে ফ্রেশ করতে করতে অক্ষয় কুমার মজুমদার ভাবছিলো, লেসবিয়ান মেয়েটা এই কোয়ার্টার্সের ঠিকানা পেলো কী করে? তার মানে কোন না কোন ভাবে ওদের যোগাযোগ আছে। এর কাছ থেকে অনিতাকে ছিন্ন করার উপায় কী? না, অনিতাকে এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। শেখর বাবু যে ভুল করেছে, তেমন ভুল কখনোই অক্ষয় বাবু করবে না। তাছাড়া অনিতাকে এখন অবিশ^াস করার কোন মানে নেই।
ফেসওয়াশ ধোয়া মুখে টাওয়েল চাপতে চাপতে আয়নায় নিজের বাদামী চোখের সম্মোাহনী দৃষ্টি, খয়েরী ঠোঁট আর চিবুকের মাঝখানের টোলটার দিকে চেয়ে নিজেকে নিজেই চোখ মেরে অক্ষয় বলে, পুরুষ হয়ে জন্মে নারীর সাথে কম্পিটিশন? তাতে আবার হার? এই অক্ষয় কুমারের অঙ্কশায়িনী হয়েছে যে তার সাধ্য কি সে যে-সে পুরুষে মজে? সেখানে এক নারী! তবে কিনা ঐ মেয়েটা দেখতে কেমন পুতুল পুতুল- ওর তো যেকোন পুরুষের কাক্সিক্ষতা হওয়ার কথা, অথচ......।
হঠাৎই এক অনন্যসাধারণ অথচ খুব চেনা অনুভুতিতে আক্রান্ত হলো অক্ষয় কুমার। মন চাইলো ছুটে নীচে নেমে দেখে, মেয়েটা চলে গেলো না তো? আর কিছুক্ষণ থাক, অন্ততঃ লাঞ্চটা যেন একসাথে করা হয়। অতিথি আপ্যায়ন বলেও তো একটা কথা আছে।
পিঠের পরে চেনা হাতের আলতো পরশ- অনিতা। স্বামীর মুড ভালো আছে বুঝে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মুখ ঘষতে ঘষতে বললো, আমি ওকে আসতে বলিনি, ও আপনি খুঁজে এসেছে।
বৌকে টেনে সামনে এনে বুকে চেপে ধরে অক্ষয় বলে, তা বেশতো। তোমার বান্ধবী তোমাকে দেখতে আসতেই পারে। ওকে বরং আজ থেকে যেতে বলো।
ও চলে গেছে।
ঠিক তখন বাগেরহাটগামী বাসের উদ্দেশ্যে বরিশাল বাস টার্মিনালে দাঁড়িয়ে অনিতা ভাবছিলো, এই শেষ। আর কখনো সে অনিতার সুখ দেখতে আসবে না। এবার নিজের সুখ খুঁজতে হবে। হয়তো সে সুখ অনিতার মতো হবে না।
কে না জানে যে প্রতিটি মানুষের সুখই তার নিজের মতোই স্বতন্ত্র।
0 Comments